বাংলা ভাষার মূল্যায়ন

1263

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
পন্ডিত নোয়াম চমস্কির দৃষ্টিতে ভাষার দুইটি স্তর, ভাষা ব্যবহারকারীর ‘ক্ষমতা’ বা ‘দক্ষতা’ এবং ‘প্রয়োগ’ বা ‘সম্পাদনা’। মানুষ বাক্য উৎপাদনকারী যন্ত্রবিশেষ, সে সংখ্যাহীন বাক্য সৃষ্টিতে সক্ষম। চমস্কি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষের এই সৃজনশীল ক্ষমতার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেন। মানুষের বাক্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া চমস্কীয় বীক্ষায় একটি জটিল নিয়ন্ত্রকরূপে আকৃত, যে নিয়ন্ত্রকের তিনটি মুখ্য প্রকরণ, ‘বাক্য’ বা ‘সংশ্লেষ’, ‘অর্থ’ বা ‘তাৎপর্য’ এবং ‘ধ্বনি’। সংশ্লেষ প্রকরণ দুটি উপপ্রকরণে গঠিত, ‘ভিত্তি’ যার সঙ্গে ‘অভিধান’-এর অপরোক্ষ সংযোগ আর ‘রৌপান্তরিক’ উপপ্রকরণ। ভাষার ‘অন্তর্গ্রন্থনা’ থেকে একদিকে পরিস্ফুটনী রৌপান্তরিক অর্থ বা তাৎপর্যে অন্যদিকে পরিস্ফুটনী রৌপান্তরিক এবং ধ্বনিবির্তনী নিয়মাবলি। প্রথম ধাপে ভাষার অন্তর্গ্রন্থনা থেকে বহির্গ্রন্থনা এবং দ্বিতীয় ধাপে উচ্চারণীয় বাক্য।
চমস্কীয় দৃষ্টিতে ‘ভাষাজ্ঞান’ অর্থ একটি ভাষায় অসংখ্য বাক্যে ভাষার অন্তর্গ্রন্থনা সংযোজন এবং তাৎপর্যগত ও ধ্বনিগত ব্যাখ্যা প্রদান ক্ষমতা। ভাষার বহির্গ্রন্থনা ভাষার ধ্বনিগত আর অন্তর্গ্রন্থনা ভাষার তাৎপর্যগত নিয়ন্ত্রক ব্যাকরণিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে। ভাষার বহির্গ্রন্থনার ও অন্তর্গ্রন্থনার বিষয়টি উদাহরণের সাহায্যে স্পষ্ট করা যেতে পারে। ‘আমি দেখি’ এবং ‘আমি দেখলাম’ এই দুটি বাক্যের পার্থক্য বর্তমান ও অতীতকালের মধ্যে, কিন্তু কিছু বাক্য আছে সেগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এইভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, যেমন ‘বাদল এ কাজ করেছে’ এবং ‘এ কাজ বাদলের দ্বারা সাধিত হয়েছে’ এই দুটি বাক্যের সম্পর্ক নিছক বর্তমান-অতীত কাল অপেক্ষা গভীরতর। একই বাক্যের কর্তৃবাচ্য ও কর্মবাচ্য রূপের পার্থক্য বহির্গ্রন্থনার ক্ষেত্রে যেরূপ অন্তর্গ্রন্থনার ক্ষেত্রে তা নয় বরং বলা চলে বহির্গ্রন্থনায় বাক্য দুটি পৃথক হলেও তারা অন্তর্গ্রন্থনায় অভিন্ন কারণ দুটি বাক্যের তাৎপর্য এক। সে কারণেই বলা চলে যে, ‘কর্মবাচ্য বাক্য কর্তৃবাচ্য বাক্য থেকে গঠিত হয়’ অথবা এমনও বলা যায় যে ‘কর্তৃবাচ্য রূপ’। একটি কর্তৃবাচ্য বাক্যকে কর্মবাচ্য বাক্যে রূপান্তরিত করার জন্যে কর্মবাচ্য বাক্যে বিশেষ্যের বা বিশেষ্য বাক্যাংশের স্থান পরিবর্তন, কারক-অব্যয়ের ব্যবহার ও ক্রিয়াকে কর্তৃ থেকে কর্মবাচ্যে রূপান্তর প্রয়োজন। এই পরিবর্তনকে চমস্কি ‘রূপান্তর’ বলেছেন। ব্যাকরণে রূপান্তর তত্ত্বের সরল অর্থ একটি বাক্যকে অন্য বাক্যে রূপান্তর, প্রথম বাক্যটি ‘কেন্দ্রবাক্য’ অর্থাৎ কর্তৃবাচ্য বাক্য হলো কেন্দ্রবাচ্য আর কর্মবাচ্য বাক্য তার রূপান্তরিত রূপ। কর্মবাচক ছাড়া বাংলায় কেন্দ্র বাক্য রূপান্তরের উদাহরণ নঞর্থক বা প্রশ্নবোধক বাক্য ইত্যাদি।
রৌপান্তরিক ব্যাকরণের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য তা উৎপাদনী বা সঞ্জনক। একটি ব্যাকরণ সংশ্লিষ্ট ভাষার সমস্ত এবং কেবল মাত্র ব্যাকরণিক বাক্য উৎপাদনে সক্ষম, অর্থাৎ একটি ব্যাকরণকে এমন হতে হবে যাতে ব্যাকরণিক সূত্রানুসারে ঐ ভাষার সম্ভবপর সমস্ত বাক্য উৎপাদন করা যেতে পারে। এখানে ‘উৎপাদন’ অর্থে একটি ভাষার সম্ভবপর বাক্য সংগঠনসমূহ সৃষ্টির সম্ভবপরতাকেই বোঝান হচ্ছে। একটি ব্যাকরণকে ঐ ভাষার সম্ভবপর সমস্ত বাক্য ‘উৎপাদন’, ‘সুনির্দিষ্ট’ এবং ‘আভাস’ দানে সক্ষম হতে হবে। উৎপাদনী বা সঞ্জনন ব্যাকরণ একটি ভাষার প্রকৃত বা ব্যবহৃত বাক্যসমূহ নিয়ে উৎকন্ঠিত নয় বরং একটি ভাষার সম্ভবপর সমস্ত বাক্য তার বিবেচনার বিষয়। যে কোনো ভাষায় বাক্যের সংখ্যা সীমাহীন কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ঐ ভাষার ব্যাকরণও অফুরন্ত, বরং বলা চলে তা সীমিত সংখ্যক সূত্রের সাহায্যে অসংখ্য সম্ভবপর বাক্য উৎপাদনে সক্ষম। রৌপান্তরিক উৎপাদনী বৈয়াকরণ যে প্রকৃত ভাষা অপেক্ষা সম্ভবপর ভাষার ক্ষেত্রে অধিকতর উৎসাহী অর্থাৎ একটি ভাষার একজন ভাষাভাষীর যে ভাষাজ্ঞান বা ভাষা ক্ষমতা, সেটি যে তাঁর মূল বিবেচ্য বিষয় তার কারণ তিনি ভাষার যতটুকু ব্যবহার করেন সেটি তার ভাষা জ্ঞান, ক্ষমতা বা দক্ষতার আংশিক প্রয়োগ বা সম্পাদনা করা মাত্র। রৌপান্তরিক উৎপাদনী ব্যাকরণের তত্ত্ব অনুযায়ী একজন ভাষাভাষী সংশ্লিষ্ট ভাষার একগুচ্ছ সূত্র আয়ত্ত করে যা তার ভাষাবোধ ও ব্যবহার ক্ষমতার মৌল ভিত্তি। তাই প্রকৃত বাক্য নয় বরং সূত্রসমূহের অনুধাবনই ভাষাতত্ত্ব বা ব্যাকরণের মূল লক্ষ্য বলে বিবেচিত। অবশ্য প্রকৃত বাক্য পর্যালোচনা করে একজন ভাষাভাষীর প্রয়োগ বা সম্পাদনা রীতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে কিন্তু সেটি থেকে তার ভাষাজ্ঞানের আংশিক উদঘাটন সম্ভব মাত্র। একজন মানুষের ভাষা ক্ষমতা এবং ভাষা প্রয়োগের মধ্যে পার্থক্য এই কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা যখন কথা বলি তখন তা প্রায়শই ব্যাকরণ সম্মত হয় না। সে কারণেই ব্যাকরণের লক্ষ্য মানুষের ভাষা ব্যবহার নয় বরং ভাষাজ্ঞান।
চমস্কীয় দৃষ্টিতে ‘ভাষাজ্ঞান’ অর্থ ঐ ভাষার অসংখ্য বাক্যে ভাষার ‘অন্তর্গ্রন্থনা’ এবং ‘বহির্গ্রন্থনা’ সংযোজন এবং ‘তাৎপর্যগত’ ও ‘ধ্বনিগত’ ব্যাখ্যা প্রদান ক্ষমতা। কোনো বিশেষ ভাষাভাষীর ব্যাকরণ-জ্ঞানের অর্থ, ঐ ভাষার অসংখ্য সম্ভবপর অন্তর্গ্রন্থনা উৎপাদনে ও ঐগুলো সংলগ্ন বহির্গ্রন্থনায় প্রকাশ এবং ঐসব বিমূর্ত বিষয়ের তাৎপর্য ও  ধ্বনিগত ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষমতা। ভাষার বহির্গ্রন্থনা ঐ ভাষার ধ্বনিগত এবং অন্তর্গ্রন্থনা ঐ ভাষার তাৎপর্য নিয়ন্ত্রক ব্যাকরণিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে, অবশ্য ভাষার বহির্গ্রন্থনার কোনো কোনো দিকও ভাষার তাৎপর্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এভাবেই চমস্কি ভাষার ধ্বনি ও তাৎপর্যের গভীর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন, চমস্কায় বাক্ষায় ধ্বনিখন্ড। শীথিল নয়, অর্থাৎ বাক্যে ধ্বনি একটানা তবে তাকে খন্ডন করা যায়, ধ্বনিপ্রবাহ ও ধ্বনিখন্ডের শ্রাব্য গুণাগুণ, স্বনন, প্রক্রিয়া এবং স্বণিত ও শ্র“ত গুণাগুণের প্রতিষঙ্গ বিশ্লেষণ করা চলে। রূপান্তরিত উপপ্রকরণের নিঃসার প্রথমে মার্জনী উপপ্রকরণে এবং সেখান থেকে কিছুটা উদঘাটিত ও সবটা ব্যাকরণ-বর্জিত হয়ে রূপ নেয় পরিস্ফুটনায়-এই হলো ধ্বনি প্রকরণের গ্রন্থনা। চমস্কীয় দৃষ্টিতে ভাষার ব্যাকরণের তিনটি অংশ, সংশ্লেষ, তাৎপর্য এবং ধ্বনি। সংশ্লেষ সংখ্যাহীন সংগঠন উৎপাদন করে এবং তা তাৎপর্য ও ধ্বনি অংশ দ্বারা অর্থ ও শ্র“তির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। এই দৃষ্টিতে ভাষায় সংশ্লেষ অংশই প্রধান এবং তাৎপর্য ও ধ্বনি অংশ তার ব্যাখ্যাকারী মাত্র। যদি ভাষার ‘অন্তর্গ্রন্থনা’ কে ‘তাৎপর্যে’ র সঙ্গে অভিন্ন বিবেচনা করা যায় তা হলে অবশ্য ‘তাৎপর্য’ বা ‘অন্তর্গ্রন্থনা’ থেকে প্রস্ফুটনী ‘সংশ্লেষ’ এবং সংশ্লেষ থেকে ধ্বনি প্রস্ফুটনী অথবা সংশ্লেষ থেকে একদিকে তাৎপর্য ও অপরদিকে ধ্বনি প্রস্ফুটনী পাওয়া যেতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, ব্যাকরণের সংশ্লেষ প্রকরণ ‘ভিত্তি’ এবং ‘রৌপান্তরিক’ সূত্রের সমাহার। ‘আভিধানিক’ শব্দে একটি শব্দের সংশ্লেষ, ধ্বনি এবং তাৎপর্যগত বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। ধ্বনি প্রকরণ ধ্বনি সূত্রের সমাহার। তাৎপর্য প্রকরণ সংশ্লেষ সংগঠন অনুযায়ী এক একটি শব্দের আভিধানিক এবং পরিস্ফুটনী সূত্রের সমন্বয়। সংশ্লেষ প্রকরণ প্রতিটি বাক্যের একটি অন্তর্গ্রন্থনা ও একটি বহির্গ্রন্থনা উৎপাদন করে। ‘অন্তর্গ্রন্থনা’ হলো ভিত্তি উপপ্রকরণের বহিঃপ্রকাশ অর্থাৎ মৌলবাক্য সংগঠন এবং আভিধানিক অর্থগত বৈশিষ্ট্যের ফল আর তাৎপর্য প্রকরণের সংগঠন। ‘বহির্গ্রন্থনা’ হলো রৌপান্তরিক উপপ্রকরণের বহিঃপ্রকাশ অর্থাৎ শব্দের এবং ধ্বনি বৈশিষ্ট্যের চূড়ান্ত ক্রম এবং ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সংগঠক।
বাংলাদেশে ভাষাতত্ত্বে চর্চার শুরু ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এবং তা বাংলা সংস্কৃত বিভাগকে কেন্দ্রে করে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান এবং সম্ভবত তারই অনুপ্রেরণায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ‘বৌদ্ধ গান ও দোঁহা বা ‘চর্যাপদ’ নিয়ে গবেষণায় অগ্রণী হয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ছাত্র ছিলেন সেহেতু তাঁর ভাষাতত্ত্ব শাস্ত্রে অভিষেক পূর্বহ্নেই সম্পন্ন হয়েছিলো। ফ্রান্সে উচ্চ-শিক্ষার সময় তিনি বিশিষ্ট প্রাচ্য ভাষাবিদ যুঁল ব্লকের সংস্পর্শে আসেন এবং তার ভাষাতাত্ত্বিক দক্ষতাকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে ভাষাতত্ত্ব চর্চায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং তা শুধু ফরাসি বা ইংরেজি ভাষায় নয় বাংলা ভাষাতেও বটে। ভাষাতত্ত্বের কালানুক্রমিক, তুলনামুলক ও বর্ণানুক্রমিক তিনটি পদ্ধতিতেই শহীদুল্লাহ্ এবং তাঁর শিষ্য বা প্রশিষ্যগণ বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব চর্চায় আতœনিয়োগ করেছেন এবং কিছু অবদান রেখেছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব চর্চা করে আসছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতত্ত্ব শাস্ত্রে উৎসাহী হবার পূর্ব থেকে। সুনীতি বাবুর ভাষাতত্ত্বে প্রধান কাজগুলো ইংরেজি ভাষাতে সম্পন্ন। তাঁর ‘ঞযব ঙৎরমরহ ধহফ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ঃযব ইবহমধষর খধহমঁধমব’ (১৯২৬) এবং ‘অ ইবহমধষর চযড়হবঃরপ জবধফবৎ’ (১৯২৮) বাংলা ভাষা বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক ও  যুগান্তকারী কর্ম এবং বাংলাভাষায় কালানুক্রমিক ও বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের মূল ভিত্তি। ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’ (১৯২৯) বাংলা ভাষার ভাষাতত্ত্ব-চর্চার ইতিহাসে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কালানুক্রমিক- তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ (১৯৬৫) বস্তুতপক্ষে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ঙ. উ. ই. খ.- এর একটি পরিপূরক গ্রন্থ। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রায় প্রতিটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতামত পরীক্ষা এবং যেসব ক্ষেত্রে একমত হতে পারেননি তা যুক্তি সহকারে উপস্থাপিত করেছেন। প্রসঙ্গেক্রমে বাংলা ভাষার উদ্ভব কাল ও উদ্ভব প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতের কতা উল্লেখ করা যায়, তিনি গ্রীয়ারসন-সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মাগধী প্রাকৃত এবং মাগধী অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভবের তত্ত্ব সমর্থন করেন নি, তাঁর মতে বাংলা ভাষা গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে উদ্ভুত এবং বাংলা ভাষার জন্ম কালকে তিনি আরো চারশত বৎসর পূর্বাহ্নে নির্দেশ করেছেন। তবে গৌড়ীয় প্রাকৃত বা গৌড়ীয় অপভ্রংশের অস্তিত্বের পক্ষে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেও প্রাকৃত বা অপভ্রংশের গৌড়ায় রূপের বিস্তৃত পুনর্গঠন তিনি করেননি। তিনিও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো নব্য ভারতীয় আর্য-ভাষার প্রাচ্য শাখার গ্রীয়ারসনকৃত শ্রেণীবিন্যাসকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করেছেন, গ্রীয়ারসনের বাংলা উপভাষার শ্রেণী বিন্যাসকে তিনি সুনীতিবাবুর মতো নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী সাজিয়েছেন। বাংলা ভাষায় অনার্য প্রভাব সম্পর্কে তিনি বিজয়চন্দ্র মজুমদারের দ্রাবিড় প্রভাবতত্ত্বকে নাকজ করে দিয়ে মুন্ডা প্রভাবের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং মুন্ডার সঙ্গে বাংলার ধ্বনি ও রূপগত সাদৃশ্য প্রদর্শন করেছেন। মোট কথা শহীদুল্লাহ্ তাঁর ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিবর্তন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণাসমূহকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে নিুোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় ঃ বাংলা ভাষার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস/হিন্দ-যুরোপায়ন হইতে আধুনিক বাঙ্গালা পর্যন্ত ক্রমিক ধারা/বাঙ্গালা ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে বিবিধ মত-মাগধী বনাম গৌড়ীয়/নব্য ভারতীয় আর্যভাষাসমূহের প্রাচ্য শাখা/প্রাচীন বাঙ্গালা হইতে আধুনিক বাঙ্গালা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তর/বাঙ্গালা ভাষায় অনার্য প্রভাব, মুন্ডা প্রভাব, বৈদেশিক প্রভাব/বাঙ্গালা উপভাষাসমূহ/বাঙ্গালা ধ্বনিতত্ত্ব/আধুনিক বাঙ্গালা শব্দের ব্যুৎপত্তি/স্বরাঘাত/প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার স্বরধ্বনির বাঙ্গালায় বিবর্তন/ব্যঞ্জনধ্বনির বাঙ্গালায় বিবর্তন/কারক বিভক্তির ইতিহাস/ক্রিয়াপদ-বর্তমান কাল নির্দেশ ও আদেশ ভাব/কর্মবাচ্য/প্রযোজক/ক্রিয়া/অসমাপিকা ক্রিয়া/যুগ্মক্রিয়া বাঙ্গালা কৃৎ তদ্বিত প্রত্যয়/স্ত্রী প্রত্যয়/লিঙ্গ প্রকরণ/শব্দাবলী/বাক্যরীতি/হিন্দ-য়ুরোপায়ন ভাষা স্তরের কালক্রম/বাংলা ভাষার কুলজী।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঐ গ্রন্থে বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে বিভিন্ন মতামত পরীক্ষা করে “সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার জননী” সংস্কৃত পন্ডিতদের এই মত খন্ডন এবং সংস্কৃত ভাষাকে বাংলা ভাষার সাক্ষাৎ জননী নয় দূরসম্পর্কের আত্মীয় রূপে বর্ণনা করেছেন। বাংলা ভাষার অব্যবহিত পূর্বরূপ হিসেবে তিনি যথাক্রমে অপভ্রংশ, প্রাকৃত, অশোক অনুশাসন বা পালি এবং আদিম প্রাকৃতকে নির্দেশ করেছেন। কিন্তু তাঁর গ্রন্থে উপেক্ষিত হয়েছে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার পালি-প্রাকৃত-অপভ্রংশ এই তিনটি স্তরের ধ্বনি, রূপ ও বাক্যতত্ত্ব বর্ণনা। এই গ্রন্থে তিনি ইন্দো-ইউরোপীয়, প্রাচীন ভারতীয় আর্য, নব্য ভারতীয় আর্য, প্রাচীন বাংলা, আদি-মধ্য ও নব্য-বাংলার ধ্বনি ও রূপতাত্ত্বিক বিবর্তন বিস্তৃতভাবে প্রদর্শন করেছেন অথচ ইন্দো-ইরানীয় এবং মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার তিনটি স্তরই তাঁর আলোচনা থেকে বাদ পড়ে গেছে।
শব্দের বা বিভক্তির ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র অপরিসীম দক্ষতা ছিল, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এবং পাকিস্তান কেন্দ্রীয় উর্দু উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত উর্দু অভিধানে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উর্দু শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে তিনি মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বিভিন্ন বাংলা শব্দ বা পদ বা বিভক্তির সুনীতিকুমার প্রদত্ত ব্যুৎপত্তি বহু ক্ষেত্রে তিনি গ্রহণ করেননি এবং যুক্তিসহকারে নিজস্ব ব্যুৎপত্তি প্রদান করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, গ্রীয়ারসন বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস প্রকাশের পরে কেন তিনি নতুন করে বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব গবেষণালদ্ধ ধারণা থেকেই উদ্ধুদ্ধ হয়েছিলেন নিজস্ব মতামত তুলে ধরার জন্যে ফলে বাংলা ভাষার ইতিহাস পুনর্গঠনের কর্মে যে নতুন যাত্রা সংযোজিত হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীতে ভাষাতত্ত্ব চর্চা করলেও বাংলাভাষার ইতিহাস পুনর্গঠনে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রচলিত, কালানুক্রমিক-তুলনামূলক পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন। তার কারণ সম্ভবত এই যে, তাদের পূর্বে বাংলা ভাষার ইতিহাস রচিত হয়নি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ফ্রান্স এবং জার্মানিতে ধ্বনিতত্ত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন কিন্তু তাঁর ঐ জ্ঞান কালানুক্রমিক- তুলনামূলক পদ্ধতিতে ভাষার ইতিহাস পুনর্গঠন প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। অথচ আধুনিক ধ্বনিতত্ত্বে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রথম বাঙালিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বাংলাদেশের ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ সম্পাদনা এবং বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র বাংলা ভাষাতত্ত্বে বিশেষ অবদান। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের বিশ্লেষণে প্রখ্যাত ইংরেজ ধ্বনিবিদ ডেনিয়েল জোনস্-এর ইংরেজি ভাষার ফোনিম নির্ণয়ের পদ্ধতি অনুসরণে শিষ্টকথ্য বাংলার ফোনিমসমূহ নির্দেশ করেছিলেন, তিনি বিচ্ছিন্নভাবে বাংলা ধ্বনিমূলগুলো সনাক্ত করলেও ভাষায় ব্যবহারে ঐ ধ্বনিমূলগুলোর মধ্যে যে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয় তার আলোচনাকে সে বিশ্লেষণে সম্প্রসারিত করেননি। সে কাজটি সম্পন্ন করেন বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় বর্ণনামূলক ধ্বনিতাত্ত্বিক আলোচনার পথিকৃৎ মুহম্মদ আবদুল হাই। তিনি বিলেতে অধ্যাপক জে. আর ফার্তের তত্ত্বাবধানে বাংলার নাসিক্যধ্বনি এবং নাসিক্যভবন সম্পর্কে যে ধ্বনিতাত্ত্বিক গবেষণা করেন তার ফল ইংরেজি ভাষায় অ ঢ়যড়হবঃরপ ধহফ ঢ়যড়হড়ষড়মরপধষ ংঃঁফু ড়ভ হধংধষং ধহফ ঘধংধষরুধঃরড়হ রহ ইবহমধষর. (১৯৬০) গ্রন্থে প্রকাশিত। দেশে প্রত্যাবর্তন করে অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই ঝঃধহফধৎফ বা শিষ্ট কথ্য বাংলা ভাষার ধ্বনি এবং ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণে ব্রতী হন এবং তাঁর গবেষণালব্ধ ফল ‘ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ (১৯৬৫) নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। মুহম্মদ আবদুল হাই-এর এই গ্রন্থটি অধ্যাবধি বাংলা ভাষায় রচিত বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব পর্যালোচনার সর্বাধিক গভীর বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ। আবদুল হাই এ গ্রন্থে বাংলা স্বরধ্বনির সংখ্যা, দ্বিস্বর এবং অর্ধস্বরের গঠন, ব্যঞ্জন ধ্বনিগুলোর ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিচয়, বাক্প্রবাহে ধ্বনির রূপ, সন্ধি ও সামগ্রিকীভবন, ধ্বনিগুণ এবং স্বরতরঙ্গ বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণে বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পূর্বে তিনি যে দৃষ্টান্তের পর্যালোচনা করেন তার অজস্রতা ও ব্যাপকতা সত্যই বিস্ময়কর। এতে বোঝা যায় যে আলোচ্য গবেষণাটি যথার্থ ফিল্ডওয়ার্ক বা ক্ষেত্রীয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে সম্পন্ন।
মুহম্মদ আবদুল হাই-এর ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব বাংলা ভাষায় বাঙালির মুখের ভাষার ঝঃধহফধৎফ বা শিষ্ট রূপের প্রথম বিস্তৃত ফোনেটিক বিশ্লেষণ। এ গ্রন্থে যদিও তিনি মূলত উচ্চরণ স্থান ও উচ্চরণ রীতির মাপকাঠিতে কথ্য বাংলার ধ্বনিগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন কিন্তু সে কাজে তিনি নকল তালু ও কাইমোগ্রাফ যন্ত্রের সহায়তা গ্রহণ করেন। শুধু বিচ্ছিন্ন ধ্বনি সনাক্তকরণ নয় বাক্প্রবাহে বিভিন্ন অবস্থানে অন্যান্য ধ্বনির সংস্পর্শে তাদের যে রূপান্তর তাও তিনি বিস্তৃতভাবে পর্যবেক্ষণ এবং ধ্বনিগুলোর সে বৈশিষ্ট্যকে ‘ধ্বনিগুণ’ শীর্ষক অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করেছেন। মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা ভাষায় প্রথম বাংলা ধ্বনিগুলোর ধ্বনিগুণের পরিমাপক, অধ্যাপক জে.আর ফার্থের ‘প্রসডিক’ পদ্ধতিতে তিনিই প্রথম বাংলা ধ্বনিগুলোর বিস্তৃত ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকারী। অধ্যাপক আবদুল হাই-এর পর অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বের প্রবর্তক লিওনার্ড ব্লুমফিল্ডের পদ্ধতির অনুসরণে অধ্যাপক চার্লস ফার্গুসনের সঙ্গে মিলিতভাবে বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের বিশ্লেষণ করেন। ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরীর বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব বিশ্লেষণ ফোনেমিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন, এই বিশ্লেষণে তাঁরা নতুনভাবে বাংলা অর্ধস্বরধ্বনি নির্ধারণ ও বিশ্লেষণ এবং প্রাগ স্কুলের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য পদ্ধতি অবলম্বনে সর্বপ্রথমে বাংলা ধ্বনিগুলোর বৈপরীত্যসূচক বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু তাঁদের আলোচনা ছিলো ইংরেজী ভাষায় এবং ‘খধহমঁধমব’ পত্রিকায় প্রকাশিত সুতরাং বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের এই অভিনব বিশ্লেষণটি বাংলাভাষী পাঠকদের জ্ঞানের বাইরে থেকে যায়। মুনীর চৌধুরী পরবর্তীতে ‘বাংলা একাডেমী’ পত্রিকায় ‘সাহিত্য, সংখ্যাতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব’ বিষয়ে বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখলেও পূর্বোল্লেখিত প্রবন্ধের অনুবাদ বা ঐ বিষয়ে বাংলায় কিছু লেখেননি। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ভাষাতাত্ত্বিক ‘ঝড়সব ঝঁঢ়ৎধ-ঝবমসবহঃধষ চযড়হড়ষড়মরপধষ ঋবধঃঁৎবং ড়ভ ইবহমধষর’ (১৯৮৪) ইংরেজিতে। সাংগঠনিক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে কথ্য বাংলার ধ্বনি ও রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়াস রয়েছে আমার ‘ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৭০) গ্রন্থে। আমার ভাষাতত্ত্ব শিক্ষা লিওনার্ড ব্লুমফিল্ডের ছাত্র চালর্স এফ. হকেটের কাছে। সুতরাং আমার ভাষাতাত্ত্বিক ধারণা বর্ণনামূলক পদ্ধতির সাংগঠনিক বিশ্লেষণ রীতি দ্বারাই গঠিত। আর সে কারণে আমি ‘ভাষাতত্ত্ব’ গ্রন্থে সাংগঠনিক রীতিতে একটি ভাষার ধ্বনি ও রূপ সংগঠন বিশ্লেষণের পদ্ধতি এবং তার প্রয়োগে বাংলা ধ্বনি ও রূপ সংগঠন বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছি। তবে আমার কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ থিসিস ‘ইবহমধষর এৎধঢ়যবসরবং’ (১৯৬০) এবং মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত মনোগ্রাফ ‘ওহঃৎড়ফঁপঃরড়হ ঃড় ঊধংঃবৎহ ইবহমধষর উরধষবপঃ’ (১৯৬৩) বাংলায় অনুদিত বা প্রকাশিত হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে স্বীকার্য যে আমি কথ্য বাংলার ধ্বনিসংগঠন বিশ্লেষণে চার্লস ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরীকে এবং রূপ সংগঠন বিশ্লেষণে চার্লস ফার্গুসনকে অনুসরণ করছি। ধ্বনিমূল, সহধ্বনিমূল, রূপমূল, সহরূপমূল ধারণা প্রয়োগ করে চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বের যে বিকাশ হয় বাংলা ভাষায় বাংলা ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় আমি তা সংযোজন করার প্রয়াস পেয়েছি। আমর গ্রন্থে কালানুক্রমিক ও  তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে যে অধ্যায় রয়েছে সেখানে আমি ‘খধহমঁধমব’ গ্রন্থে ব্লুমফিল্ড-এর আলোচনার অনুসরণ করেছি।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব-চর্চা রূপান্তরমূলক যুগে প্রব্রেম করে সত্তর দশকে যখন আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে ভাষাতত্ত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে “বাংলাভাষা তত্ত্ব” (১৯৭৫) নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সাধারণ পাঠককে পরিচিত করানোর প্রয়াস পান। আলোচ্য গ্রন্থে তিনি ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনায় সাংগঠনিক পদ্ধতি এবং শব্দতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে প্রধানত চমস্কি প্রবর্তিত পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় চমস্কির পদ্ধতি তিনিই প্রথম প্রয়োগ করার দাবিদার। ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি কেনেথ এল পাইক এবং চার্লস হকেট আর শব্দতত্ত্ব বিষয়ে চমস্কির পদ্ধতি মূলত অনুসরণ করলেও হ্যারিস এবং বোলিনজার আদর্শের সহায়তাও গ্রহণ করেন। বাক্যতত্ত্ব আলোচনায় এ গ্রন্থে ফ্রিজের কথা স্মরণ রেখে চমস্কি পদ্ধতি গৃহীত হয়। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং ‘বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম’ সম্পর্কে গবেষণা করেন যা ‘জবষধঃরারুধঃরড়হ রহ ইবহমধষর’ (১৯৮৬) নামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত।
এ ছাড়াও আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৮৫) নামে একটি বৃহদাকার গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এ গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে ভাষাতত্ত্বে বিভিন্ন শাখা ও পদ্ধতি, ঐতিহাসিক ও তুলনামুলক ভাষাতত্ত্ব, ভাষার শ্রেণিবিন্যাস, উপভাষাতত্ত্ব লিখনরীতি, ভাষাতত্ত্ব-চর্চার ইতিহাস, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব এবং বাগার্থতত্ত্ব সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে। বাক্যতত্ত্ব অধ্যায়ে তার আলোচ্য বিষয়, প্রথাগত ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্ব, সাংগঠনিক বা গঠনমূলক ব্যাকরণ বাক্যতত্ত্ব এবং রূপান্তরমূলক ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্ব। এ গ্রন্থে বাংলা বাক্যতত্ত্ব ও রূপান্তরমূলক সূত্র প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, চলতি বাংলার বাক্যতত্ত্ব বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে চমস্কি প্রবর্তিত রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের সূত্র সম্পূর্ণ প্রয়োগযোগ্য নয়। চমস্কি কারক সম্পর্কে কোনো সূত্রের উল্লেখ করেননি। পরবর্তী কালে ফিলমোর (১৯৬০) সে সব ভাষায় বাক্যতত্ত্ব বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কারকের গুরুত্ব বিদ্যমান, কারক বিষয়ক নতুন সূত্রের ব্যবহার করে বাক্যতত্ত্ব বিশ্লেষণের নতুন সূত্র সংযোজন করেন। বাংলা বাক্যতত্ত্বে ব্যাকরণগত উপাদানের জটিলতার জন্যে রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের কয়েকটি সূত্রের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ এর এডিনবরাস্থ গবেষণা কমিটির বাংলা রূপান্তর ‘বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম : গঠন ও প্রকৃতি’ (১৯৮৫) গ্রন্থে বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম, সর্বনামীয় বাক্যাংশ এবং সম্বন্ধবাচকতা গঠনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। বিষয়বস্তু অনুসারে গ্রন্থটি দুটি পর্যায়ে বিভক্ত, প্রথম পর্যায়ে বাংলা সম্বন্ধবাটক সর্বনামীয় বাক্যাংশ গঠনের বিভিন্ন দিক এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কয়েকটি রূপান্তরমূলক সূত্রের সাহায্যে বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিক গঠনের মধ্যে সম্বন্ধবাচক সর্বনাম যেভাবে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব, সে সম্পর্কে তত্ত্বগত দিক নির্দেশ। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের আলোচ্য বিষয়, বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম, এই শ্রেণীর সর্বনাম দ্বারা গঠিত বাকাংশ, সম্বন্ধবাচক সর্বনাম ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বা আপেক্ষিক সর্বনাম জটিল বাক্যে অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে যেভাবে সর্বনামীয়করণ প্রক্রিয়া সাধিত হয় তার বর্ণনা এবং রূপান্তরমূলক সূত্রের প্রয়োগে বাংলায় সর্বনামীয়করণের বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণ। বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম বা সর্বনামীয় বাক্যাংশের ওপর তেমন বিস্তৃত আলোচনা ও তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা না থাকায়, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদকে বিভিন্ন শ্রেণীর সর্বনামীয় বাক্যাংশ ও সূত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা উদ্ভাবন করতে হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ঝঃধহফধৎফ বা শিষ্ট চলতি বাংলা ভাষার সঙ্গে নোয়াখালি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও বাক্য গঠনগত পার্থক্য নিরূপণে সাংগঠনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলেও বাক্যতত্ত্বে চমস্কি পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভব কি না তা পরীক্ষা করেন এবং বাংলাভাষার বাক্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ঐ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন। তাঁর এ গ্রন্থটি নাম অ ঝঃঁফু ড়ভ ঝঃধহফধৎফ ইবহমধষর ধহফ ঃযব ঘড়ধশযধষর উরধষবপঃ (১৯৮৫). বাংলাদেশে চমস্কি প্রবর্তিত ‘রূপান্তমূলক সৃষ্টিশীল’ ভাষাতত্ত্বের সবচেয়ে উৎসাহী প্রবক্তা ও অন্যতম পথিকৃৎ হুমায়ুন আজাদ, তিনিও ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদেশে হুমায়ুন আজাদের গবেষণা  (চলবে)