কাজিরবাজার ডেস্ক :
নিজ কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেতা খালেদা জিয়া মঙ্গলবার (৬ জানুয়ারি) সকাল থেকে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
গতকাল সোমবার (৫ জানুয়ারি) বিকালে পুলিশি বাধায় পূর্বঘোষিত ‘কালো পতাকা সমাবেশে’ যোগ দিতে না পেরে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।
বিকেল ৫টার কিছু আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এ ঘোষণা দেন খালেদা।
গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় মাঝে মধ্যেই কাশছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন। একটু আগে করা পুলিশের পেপারস্প্রে’র ঝাঁজ তখনো সক্রিয় ছিলো গুলশান কার্যালয়ের বাতাসে।
পুলিশি বাধায় বের হতে না পেরে ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া বলেন, গত বছরের এই দিনে একটি ‘ভোটারবিহীন নির্বাচনের’ মধ্য এই ‘অবৈধ’ সরকার জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে। তাই আজ আমরা সারাদেশে কালো পতাকা সমাবেশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের সেই কর্মসূচি পালন করতে দেয়নি।
সুতরাং, পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি চলবে। পরে পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠিক হলে আমরা কালো পতাকা সমাবেশ করবো- বলেন তিনি।
সরকারকে ‘জালিম’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, এই সরকার কেবল দেশকে ‘অবরুদ্ধ’ করেনি। কারাগারে পরিণত করেছে। এভাবে চলতে পারে না। সেই জন্য আমরা এই ‘অবৈধ, অনৈতিক’ সরকারের বিরুদ্ধে জনসভা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনারা দেখেছে কীভাবে আমার মেয়েদের ওপর, আপনাদের ওপর পেপার স্প্রে করেছে।
সরকারের বাধার মুখেও সারাদেশে জনগণ স্বত:স্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামতে চেয়েছিলো দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, এই অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামতে চেয়েছিলো। কিন্তু সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী, ছাত্র ও যুবলীগের গুণ্ডা-পাণ্ডারা চারদিক দিয়ে আমার ছেলেদের ওপরে হামলা চালিয়েছে।
সরকার তাকে ‘অবরুদ্ধ’ করে রেখেছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, আজ তারা বলছে, আমার নাকি নিরাপত্তা বাড়নো হয়েছে। অন্য সময় তো আমার নিরাপত্তা দেওয়া হয় না। আমি যখনই কোনো কর্মসূচিতে যেতে চাই, তখনই নিরাপত্তার কথা বলে আমাকে ‘অবরোধ’ করে রাখা হয়।
তিনি বলেন, আমার নিরাপত্তা দিতে চাইলে আমি যেখানে যেতে চাই সেখানে তারা চলুক। কিন্তু আমাকে এভাবে বার বার বালুর ট্রাক, জলকামান, ট্যাংকলড়ি দিয়ে আটকিয়ে রাখা হয় কেন?
এখনো আমার কার্যালয়ের সামনে বালুভর্তি ১১টি ট্রাকসহ ২৬টি ট্রাক দাঁড় করে রাখা হয়েছে। এর কারণটা কী?- জানতে চান খালেদা।
সংকট নিরসনে সংলাপে বসার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বার বার বলেছি, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু সেই নির্বাচন দিতে এরা (সরকার) ভয় পায়। কারণ, তারা জানে নির্বাচন দিলে তাদের কী করুণ পরিণতি হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, আজকে তারা গুলি করে, পেপার স্প্রে করে, গ্যাস ছেড়ে, হামলা-মামলা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো স্বৈরাচার জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। বরং তাদের ভয়ঙ্কর পরিণতি ভোগ করতে হয়।
গণমাধ্যমের ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, আমরা শুনেছি, কিছুক্ষণ আগে একুশে টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি কোনো সমাধান নয়। তারা (সরকার) কথা বললে সেটি প্রচার করতে হবে। আর আমরা কথা বললে তা প্রচার করা যাবে না। এটি গণতন্ত্রের নমুনা নয়। কাজেই এই ফ্যাঁসিস্ট সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যায় না।
খালেদা জিয়ার বক্তব্যের মাঝখানে খবর আসে ফের পেপার স্প্রে করছে পুলিশ। এ সময় পুলিশকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, কেন রে ভাই! এই গ্যাস কেন মারা হচ্ছে? আমি তো কথা বলছি, কথা বলতেও কি দেবেন না?
খালেদা বলেন, পুলিশের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তবে বিশেষ একটি জেলার পুলিশ পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এ বাহিনীর মধ্যে সরকারের এজেন্ট ঢুকে পড়েছে।
তিনি বলেন, আপনারা (পুলিশ) যা করছেন তা আপনাদের পরিবারের সদস্যরাও ভালো মতো মেনে নিচ্ছে না। তারাও এই ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছে।
সরকারের কঠোর সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিলো মানুষ ও ভোটারবিহীন নির্বাচন। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এই ‘অবৈধ’ সরকার কীভাবে একের পর এক আইন করে যায়। ভবিষ্যতে এসব আইনের একটিরও কার্যকারিতা থাকবে না। হয়তো জোর করে কিছুদিন এ আইন টিকিয়ে রাখা যাবে।
সংসদে বিরোধী দলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, সংসদে আজ কোনো বিরোধী দল নেই। যারা আছে, তারা গৃহপালিত বিরোধী দলের চেয়েও নিকৃষ্ট।
সরকার সারাদেশ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, তারা (সরকার) জনসভা করতে চায় করুক। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের জনসভা করতে দিক। দেখি, কাদের পক্ষে জনসমর্থন বেশি। যেহেতু জনগণ তাদের সঙ্গে নেই, সেহেতু ভয়ে ভীত হয়ে আমাদের জনসভার ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে তা নিষিদ্ধ করেছে।
তিনি আরো বলেন, জনসমর্থন হারিয়ে আজ তারা জনগণের রক্ত নিয়ে টিকে থাকতে চায়। কিন্তু এভাবে টিকে থাকা যাবে না। এই রক্ত দিয়েই জনগণ তাদের বিদায় করবে।
টানা ২৪ মিনিটের বক্তব্য শেষ করে দ্রুত গুলশান কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলার নিজ দফতরে চলে যান খালেদা জিয়া।
এর আগে এক প্রশ্নের জবাবে খালেদা বলেন, বাসা ছেড়ে অফিসে থাকতে কিছুটা তো কষ্ট হচ্ছেই। তারপরও থাকতে হচ্ছে। কী আর করা!
এর আগে বিকেল পৌনে ৪টার দিকে খালেদা জিয়া সমাবেশে যোগ দিতে অফিসের বাইরে যাবার জন্য তার ব্যক্তিগত গাড়িতে ওঠেন। এসময় তার সঙ্গে কালো পতাকা হতে বেশ কয়েকজন নারী নেত্রী উপস্থিত ছিলেন।
বাইরে বের হওয়ার জন্য বারবার হর্ন দেওয়া হলেও পুলিশ তালাবদ্ধ গেট খুলে দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে নেতা-কর্মীরা গেট ভাঙার চেষ্টা করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে পিপার স্প্রে করা হয়।
৫ জানুয়ারির পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
প্রায় ৫০ মিনিট বসে থাকার পর তিনি গাড়ি থেকে নেমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
সোমবার বেলা ১২টার দিকে পুলিশ কার্যালয়ের বাইরের ফটকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূতির দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ ঘোষণা করে রাজধানীর নয়াপল্টনে সমাবেশের পাশাপাশি সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি নেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ঢাকার সমাবেশে যোগ দিয়ে নিজে সরকার পতনের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ঘোষণা দেন জোট নেত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
ঘোষিত কর্মসূচির একদিন আগে শনিবার (৩ জানুয়ারি) রাত ১১টা ৪০ মিনিট থেকে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান নেন খালেদা জিয়া। সেখান থেকে রাতেই বের হয়ে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে তাকে যেতে দেয়নি পুলিশ। এরপর থেকে এরপর থেকেই গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন খালেদা জিয়া। আর তার কার্যালয় ঘিরে রেখেছে পুলিশ।
খালেদা জিয়াকে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিএনপি।
অন্যদিকে ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ রাজধানীর ১৬টি স্পটসহ সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পযায়ে বিজয় র্যালি ও সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। এ অনুযায়ী সোমবার সকাল থেকেই রাজধানীজুড়ে অবস্থান নিয়েছেন সরকারি দলের নেতাকর্মীরা।
পাল্টাপাল্টি এ কর্মসূচির কারণে রাজধানীতে রোববার (৪ জানুয়ারি) বিকেল ৫টা থেকে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ঢাকা মেট্রোপলিট্রন পুলিশ (ডিএমপি)।