হবিগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গতকাল রবিবার দুপুরে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রশিদ আহমেদ মিলন এ আদেশ দেন। এর আগে সংশোধিত সম্পূরক চার্জশীট আদালতে উপস্থাপন করা হলে বিচারক তা গ্রহণ করেন। এদিকে শুনানী শেষে আদালতের বাইরে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদল নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হলে অন্তত ১০ জন আহত হয়। তাদেরকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
দীর্ঘ প্রায় ৩ বছর তদন্ত শেষে খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউছসহ ১১ জনের নাম নতুন করে অন্তর্ভূক্ত করে গত ১৩ নভেম্বর তৃতীয় দফা সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডি সিলেটের সিনিয়র এএসপি মেহেরুন্নেছা পারুল। কিন্তু চার্জশীটে আরিফুল হকের নাম এবং জি কে গউছের ঠিকানা ভুল থাকায় আদালত তা গ্রহণ না করে সংশোধন করে তা পুনরায় দাখিলের নির্দেশ দেন। এর প্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তা রবিবার নির্ধারিত তারিখে সংশোধিত চার্জশীট আদালতে জমা দেন। দুপুরে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রশিদ আহমেদ মিলনের আদালতে চার্জশীটে উপর শুনানী শুরু হয়। প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী শুনানী শেষে বিচারক উল্লেখিতরা ছাড়াও মাওলানা তাজ উদ্দিন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, মোহাম্মদ আলী, বদরুল ওরফে মোঃ বদরুল, মোঃ মহিবুর রহমান, মোঃ কাজল মিয়া ও হাফেজ মাওলানা এয়াহিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন।
এতে সন্তোষ প্রকাশ করে মামলার আইনজীবী আলমগীর ভূঁইয়া বাবুল বলেন, আজকে থেকেই দৃশ্যমানভাবে কিবরিয়া হত্যা মামলার বিচার শুরু হল। আমল আদালত আইনী প্রক্রিয়ায় মামলাটি প্রস্তুত হলে এটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যাবে। যেহেতু এ মামলাটি স্পর্শকাতর, চাঞ্চল্যকর মামলা, সেহেতু আইন অনুযায়ী নির্ধারিত ৯০ কার্যদিবস এবং পরবর্তীতে আরো ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মামলার বাদি এডভোকেট মোঃ আব্দুল মজিদ খান এমপি বলেন, কিবরিয়া হত্যার বিচার শুরু হয়েছে। আমরা আশা করি অদূর ভবিষ্যতে কিবরিয়া হত্যার বিচার বাংলাদেশের মাটিতে হবে। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হবে। মানুষের সাধারণ জীবন যাপন করার যে গ্যারান্টি ছিল, বাংলাদেশ সরকারের আইনে তা নিশ্চিত হবে। যেহেতু চার্জশীট গৃহীত হয়েছে, পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়েছে এবং যাদের জামিন চাওয়া হয়েছিল তাদের জামিন না-মঞ্জুর হয়েছে। আমি বাদী হিসেবে নই, বাংলাদেশের সকল মানুষই মনে করে বাংলাদেশে আইনের শাসন নিশ্চিত হয়েছে। আমাদের আইনের বিজয় হয়েছে বলে আমি মনে করি।
এদিকে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসামী পক্ষের আইনজীবী সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মামলার স্থগিতাদেশ চেয়ে হাইকোর্টে দরখাস্ত করা হয়েছে। এটি পেন্ডিং রয়েছে। হাইকোর্টের এডভোকেটের সার্টিফিকেট দেখানোর পরও আদালত আমাদের আবেদন গ্রহণ করেননি। সবসময়ই হাইকোর্টের এডভোকেটের সার্টিফিকেট গ্রহণ করা হয়। অজ্ঞাত কারণে গতকাল (রবিবার) হাইকোর্টের এডভোকেটের সার্টিফিকেট গ্রহণ করা হয়নি। এ মামলা আমলে নেয়া হয়েছে। আমরা জামিনও পাইনি। পিটিশন থাকার পরও চার্জশীট আমলে নেয়া হয়েছে। আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা আমাদের ক্লায়েন্টের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে এর প্রতিকারের জন্য অবশ্যই উচ্চ আদালতে যাব।
এদিকে কিবরিয়া হত্যার বিচার দাবি করেছেন আদালতে উপস্থিত সাধারণ মানুষ। তবে তাদের দাবি যেন প্রকৃত আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। নির্মম এ হত্যাকান্ডের মতো যেন আর কোন ঘটনা না ঘটে।
এদিকে চার্জশীট গ্রহণকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই আদালত চত্বরে জড়ো হতে থাকে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল কর্মীরা। এর পরই আসে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মীরা। নিমতলায় পাশাপাশি স্থানে অবস্থান নেয় উভয়পক্ষ। দু’পক্ষই এ সময় পাল্টাপাল্টি শ্লোগান দিতে থাকে। একপক্ষ আসামীদের ফাঁসি দাবি করে স্লোগান দেয়। অপরপক্ষ মামলা মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যায়িত করে শ্লোগান দেয়। এ সময় দফায় দফায় তাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্ক দেখা দেয় আদালতে উপস্থিত মানুষজনের মধ্যে। শুনানী শেষে বিচারক আদেশ দিলে ছাত্রদল ও যুবদল এর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে। একই সময় আসামীদের বিচার দাবি করে শ্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। আদালতের সামনের রাস্তায় উভয় মিছিল মুখোমুখি হলে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। নিক্ষেপ করা হয় ইটপাটকেল। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়। তাদেরকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে একটি প্রাইভেট কার ও কয়েকটি ইজিবাইক ভাংচুর করা হয়।
অপরদিকে এ মামলার চার্জশীট গ্রহণ উপলক্ষে সকাল থেকেই আদালত চত্বরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আদালত চত্বরে অবস্থান নেন জেলা পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারাও। তারা দু’পক্ষের উত্তেজনা পশমিত করার চেষ্টা চালান। উভয়পক্ষের মাঝখানে তারা সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকেন।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারী সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় অংশ নিয়ে ফেরার পথে সন্ত্রাসীরা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া ও তার ভাতিজা শাহ মঞ্জুর হুদাসহ ৫ জনকে হত্যা করে। নিহত অন্যরা হলেন- স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল হোসেন, সিদ্দিক আলী ও আব্দুর রহিম। হামলায় আহত হন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে সভাপতি ও হবিগঞ্জ-৩ (হবিগঞ্জ সদর-লাখাই) আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট মোঃ আবু জাহির, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আলমগীর ভূঁইয়া বাবুল, বর্তমানে অতিরিক্ত পিপি আব্দুল আহাদ ফারুক, তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক (বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী) রাজন চৌধুরী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ সরদারসহ অর্ধশতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক বর্তমানে সাধারণ সম্পাদক ও হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের এমপি এডভোকেট মোঃ আব্দুল মজিদ খান বাদি হয়ে সদর থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন। হত্যা মামলাটির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি’র তৎকালীন এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান তদন্ত শেষে একই বছরের ২১ মার্চ আদালতে একটি চার্জশীট দাখিল করেন। একই আদলে ওই বছরের ২০ এপ্রিল সদর থানার তৎকালীন ওসি এমএস জামান বিস্ফোরক মামলাটির তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। উভয় চার্জশীটেই জেলা বিএনপি’র তৎকালীন সহ-সভাপতি একেএম আব্দুল কাইয়ূম, বিএনপি কর্মী জয়নাল আবেদীন জালাল, জমির আলী, জয়নাল আবেদীন ওরফে মোমিন আলী, মোঃ তাজুল ইসলাম, মোঃ শাহেদ আলী, মোঃ সেলিম আহমেদ, আয়াত আলী, মহিবুর রহমান ও কাজল মিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে মহিবুর রহমান ও কাজল মিয়া ছাড়া বাকি ৮ জন বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হন। বর্তমানে উচ্চ আদালতের নির্দেশে তারা জামিনে রয়েছেন। এ চার্জশীটের বিরুদ্ধে কিবরিয়া পরিবারের নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ আড়াই বছর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২০ জুন দ্বিতীয় দফায় তদন্ত শেষে সিআইডির সিনিয়র এএসপি মোঃ রফিকুল ইসলাম নতুন ১৪ জনকে অন্তর্ভূক্ত করে মোট ২৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশীট দেন। এতে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নান, চারদলীয় জোট সরকারের উপ-মন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই আলহাজ্ব মাওলানা মোঃ তাজ উদ্দিন, নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার আমডাংগা গ্রামের মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল¬াহ (২৯), গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ গ্রামের হুজি নেতা মুফতি হান্নানের ভাই মুহিব উল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি (৩০), চাঁদপুর জেলা সদরের মৈশাদি গ্রামের শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল (৩৮), সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সাহারপাড় গ্রামের হাফেজ সৈয়দ নাঈম আহমেদ আরিফ ওরফে নিমু (৩০), হবিগঞ্জ জেলা শহরের চৌধুরী বাজার এলাকার মোঃ বদরুল আলম মিজান (৩০), বানিয়াচং উপজেলার সিকান্দরপুর গ্রামের মিজানুর রহমান ওরফে মিজান ওরফে মিঠু, একই উপজেলার কৃষ্ণপুর নোয়াগাঁও গ্রামের মোহাম্মদ আলী, নবীগঞ্জ উপজেলার কালিয়ারভাঙ্গা গ্রামের বদরুল ওরফে মোঃ বদরুল, ভারতের কাশ্মীরের মোঃ আব্দুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট (৪২), কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার বাশগাড়ি গ্রামের মুফতি শফিকুর রহমান, কুমিল¬া জেলার দাউদকান্দি উপজেলার নয়ানগর গ্রমের মুফতি আব্দুল হাইকে নতুন করে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এ চার্জশীটে বিরুদ্ধেও নারাজি দেন কিবরিয়া পরিবার। এর প্রেক্ষিতে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারী মামলাটি পুন:তদন্তের আদেশ দেন।