কষ্ট

41

মিজানুর রহমান মিজান

কামরুল অতি আদরের মা-বাবার এক মাত্র পুত্র সন্তান। জন্মের পর পরই ধন-সম্পদ পিতা এক আদম বেপারীর খপ্পরে পড়ে বিক্রি করে ক্রমশ দারিদ্র্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে থাকেন। বোধ শক্তি ধারণ এর পাশাপাশি কামরুল চিন্তা-চেতনায়, ধ্যান-ধারণায় সংসারের বড় ছেলে হবার সুবাদে বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজার এবং ঊর্ধ্বমুখি জীবন যাত্রায় পরিবারের হাল ধরার চিন্তা হৃদয় রাজ্যে পোষণ শুরু করে।
আট সদস্যের পারিবারিক ব্যয়ভার নির্বাহের সাথে সামাজিক দায়-দায়িত্ব, কর্তব্য পালনের এক যুদ্ধ যাত্রী সৈনিক রূপে সৎ ও সততার পথে পরিচালিত হবার দৃঢ় মনোবলে এগিয়ে যাবার পথ চলা শুরু। যে সময় কৈশোরের উজ্জ্বল, উচ্ছ্বল প্রাণ স্পন্দনে অতিবাহিত হবার কথা। সে সময় কামরুল বেড়ানো, খেলাধূলা পরিত্যাগ করে শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী রূপে শুধুমাত্র স্কুলের এবং পরবর্তী সময়টুকু কৈশোর সময় হিসাবে ছোট খাট ব্যবসায় ও ব্যবসার চিন্তা নিয়ে অতিবাহিত করে। ক্রমান্বয়ে, ধীরলয়ে যৌবনে পদার্পণ। অপর দিকে বি. কম পাসের মধ্য দিয়ে এলাকায় সুখ্যাতির অধিকারিত্ব অর্জন। সাথে যথাযোগ্য মর্যাদায় সাংসারিক একটা শক্ত ও মজবুত ভিত এবং অতি উচচ মর্যাদার আসন বিবর্জিত অবস্থানে পৌঁছে।
এক দিন ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে বৃহত্তরতায় পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচ্যে। কাজ, পরিশ্রম আর শরীরের লোনা জলকে সঙ্গী করে তিলে তিলে গড়ে তোলে স্বপ্নসৌধ, সাধ ও সাধ্যাতীতের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে দালান বিহীন অট্টালিকা, পাল বিহীন নৌকা, ইঞ্জিন বিহীন গাড়ি। অল্পে তুষ্ট নীতির মহামন্ত্রে দীক্ষা লাভে শিক্ষা সপ্তম বৎসরান্তে মা, মাটি ও মানুষের আকর্ষণে স্বদেশে এসে অনেক প্রকার বিভিন্ন নমুনার সুযোগ থাকা সত্ত্বে ও অতি সাধারণ ভাবে একটি নুতন জীবন গ্রহণের পথে পা বাড়ায় চাওয়াহীন পাওয়াকে সঙ্গী করে। রোসনা নামক মেয়েকে জীবন সঙ্গী করে চালায় জীবন তরী। দু’টি মেয়ে সন্তানের গর্বিত পিতা হিসাবে তার সকল চাওয়া পাওয়া সঁপে দেয় সংসারের প্রতি। কামরুল মনে করত নিজে না পরে যদি পিতা মাতা, স্ত্রী, সন্তানকে সাধ্যমত পরাতে সক্ষমতা অর্জন করি। তথা সংসারের সবাইকে উন্নততর জীবনযাত্রায় গড়ে তোলাই ছিল এক মাত্র লক্ষ্য, ধ্যান-ধারণা। এর প্রমাণ মেলে স্ত্রীর একটি পত্র থেকে, ” আপনি একটি ভাল শার্ট কিনে গায়ে দেন, আর কত কিপটে হবেন। আমরা যা পাচ্ছি তাই যথেষ্ট”। কামরুল নিজের দিকে তাকাল না। আত্মবিসর্জন দিল সব কিছুকে জীবনে অপরের তুষ্টতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে। যার যথার্থ প্রমাণ ক্ষুদ্র এ উক্তিতেই বেরিয়ে আসে, মেলে স্পষ্ট স্বাক্ষরতায়।
সুদীর্ঘ পনের বৎসরের প্রবাস জীবনের ইতি টানে কামরুল জটিল ও কঠিন দুরারোগ্য হাঁটুর জয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে। তৎক্ষণাৎ স্ত্রী, সন্তানরা কামরুলকে অপাংক্তেয়, অকর্ম, পঙ্গু ভেবে ফেলে যায়। আজ সে স্ত্রী, সন্তানদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে পাঁচ শত টাকার কাপড় দেয় নাই। যে যৌতুককে মনে প্রাণে ঘৃণা করতো, করে। আজ সে অপরাধে ও অপবাদে জড়ালে কামরুলের আত্মা-মন -প্রাণ কাঁচের গ্লাসের মত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তাৎক্ষণিক।
যে স্ত্রী বলে, ” পিতা, ভাইকে সান্ত্বনা দেবার জন্য মোহরানা ও খোরপোষের টাকা এখন নেব। কিন্তু এক বৎসরের মধ্যে নেবার চেষ্টা করবে অপর ব্যক্তির মাধ্যমে স্বামীকে একা পেয়ে ও ”। এ কথায় এক দিকে কামরুলের হাসি পায়, অপর দিকে হৃদয়টা ভেঙ্গে খান খান”। হাসি পায় এ ভেবে স্ত্রী স্বামীকে একা পেয়েও বলে না আসতে। তাছাড়া স্ত্রী বা স্বামী প্রতিটি ক্ষণ উদগ্রীব থাকে সান্নিধ্য পাবার আশায়। তার পরিবর্তে স্ত্রীর এ কি কথা এক বৎসর পর। মা-বাবাকে সান্ত্বনার নিমিত্তে টাকা নেয়া হচেছ।
দু:খ আসে কি স্বার্থপর ,” সুসময়ে অনেকেই …কারো নয়”। কি বিচিত্র , অদ্ভূত মানুষের মন। মাতাপিতার কাছে কি বন্দি ? প্রথমেত সেই চলে গেল উদগ্রীব হয়ে। কামরুল এ মুহূর্তে শুধু মাত্র ব্যাপারটিকে বুঝার চেষ্টা করে। গভীরে যাবার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু সব কিছু তাল গোল পাকায় মাথার মধ্যে।
কামরুল চিন্তার মহারাজ্যে প্রবেশ করে শুধু সাঁতার কেটেই চলে বাল্য, কৈশোর বাদ দিলেও যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় চৌদ্দটি বছর কার, কাদের জন্য বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গায়ের লোনা জলকে সঙ্গী করে অমানুষিক কাজ আর পরিশ্রমের ফসল উৎপাদিত হয়ে, উৎপন্ন দ্রব্য থাকা সত্তে ও কামরুল আজ বঞ্চিত। বুকের ভিতর এক বুক কষ্ট নিয়ে মানুষ নামক ভিন্ন মানুষের কারণে কামরুল সন্তানকে সন্তান বলতে পারে না, মনুষ্যত্ব বিহীন মানুষের সর্বদা হুমকি, আমিত্ব ও অহংকারের অন্ধত্বের নিকট।
লেখক : সাহিত্যিক, দীপ্তি সম্পাদক, বিশ্বনাথ, সিলেট।