আমার শিক্ষা জীবন

88

সুমনা আক্তার সাথী
(পূর্ব প্রকাশের পর)
সবাই আমাকে এবং স্যারকে দিয়ে সন্দেহ করছে আসলে আমি বলবো স্যার আমাকে ওদের তুলনায় একটু বেশি ভালোবাসেন বলে ওরা বাজে মন্তব্য করছে। আমার দৃষ্টিতে স্যার এমনটা নয়। তিনি বেশ ভালো। অন্য মেয়েদের সাথে তিনি কিরূপ আচরণ করেন তা আমি জানিনা। জানতে চাইও না। আমি আমারটা জানতে চাই। এবং জানতে গিয়ে দেখেছি তিনি খুব স্বাভাবিক একজন মানুষ। আমার সাথে তিনি শিক্ষক সুলভ আচরণ ছাড়া খারাপ আচরণ কোনো দিন করেননি। সবাই আসলে মিছামিছি তাদের সন্দেহ করতো। বছর শেষে একদিন স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। স্কুলের পাশের লাইব্রেরী থেকে একটি ফুলের তোড়া ওই লাইব্রেরীর মালিক ছামিয়ার হাতে দিয়ে বললো ছামিয়া তুমি এটা নিয়ে যে কোন একজন শিক্ষককে দাও। ছামিয়া মাঠের মাঝে কোন শিক্ষককে না পেয়ে ওই বিএসসি স্যারের হাতেই তুলে দিল। গোটা স্কুলের ছাত্রছাত্রী ছাড়াও অন্যান্য লোকজন ওই দৃশ্য দেখল। কেউ কিছু বললো না। পরিশেষে ছামিয়ার ক্লাসের কিছু খারাপ মেয়ে এসে বললো কিরে ছামিয়া স্যার তোকে কি দিলেন, তুই তো খুব দাম দিয়ে স্যারকে ফুল দিয়েছিস। বিনিময়ে কি পেলে। ছামিয়া রেগে আগুন হয়ে বললো বিনিময়ে স্যারের এক বিন্দু ভালোবাসা পেয়েছি। তারপর এই খবর তার গ্রামেও ছড়িয়ে পড়লো। এতো বড় মিথ্যে অপবাদ ছামিয়া কিভাবে সহ্য করবে। তবুও সে ধৈর্য ধারণ করলো এবং আল্লাহকে সাক্ষী রাখলো এবং ভাবলো পৃথিবীতে ভালো হতে গেলে বুঝি এতো বড় বড় অপবাদের বোঝা মাথায় তুলে নিতে হয়। তারপর তার এক বান্ধবি ছনিয়া সে ছামিয়াকে একটি ছেলেকে ভালোবাসার জন্য উঠে পড়ে লাগল। ছামিয়া ভাবলো মিথ্যে কথা বলে সবাই আমাকে ভুল বুঝে। তবে এবার আমি ভুল করব এবং অপরাধ করে বাজে কথা শুনব, বলেই একটি ছেলের প্রস্তাব পেয়ে তাকে ভালোবাসে। যার নাম ছাকিব। দেখতে বেশ সুন্দর। তাকে যখন ভালোবসালো তখন থেকেই তার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। লেখাপড়ায় ছামিয়ার মনোযোগ নেই। একদম অমনোযোগী। পড়ালেখা করতে তার ভালো লাগে না। সব সময় শুধু ছাকিব কে নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে। ছাকিব এর প্রেমে একদম যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিদিন দু’জনার দেখা হতো। কথা হতো। ছাকিব বলতো প্রিয়া আমি তোমাকে যতবার দেখি মন চায় আরো দেখতে। অনেক সময় ছামিয়া বলতো পাগলামিরও একটা সীমা আছে, তুমি তো সেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ ছাকিব। ছাকিব বলতো পৃথিবীতে তুমি একমাত্র মেয়ে, যার জন্য আমি মরতেও পারি। ছাকিবের ভালোবাসায় ছামিয়া এতো অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো কখনো বুঝতেই পারেনি ছাকিব তার সুন্দর জীবনের ভয়ানক দুশমন। সে তার জীবনে প্রবেশ করার অর্থই তার সুন্দর জীবনটা ধ্বংস করা। প্রেমের নামে এক মরণপণ তৈরী করা। ছাকিবের প্রেম ছিলো শুধুই অভিনয়। শুধু অবহেলা। ছাকিবের মতো এমন নরপশুর জন্যে ছামিয়াকে সবার চোখে একটি নষ্টা মেয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে হলো। মা-বাবা ভাই বোন সবার চোখে অপরাধী হতে হলো। সব হারিয়ে বাড়ির মধ্যে কারাগারের মতো একটি ঘরে তার স্থান হলো। জীবন গড়ার প্রধান হাতিয়ার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে হলো। তবু তার মতো নরপশুর সাথে হেসে খেলে দিন কাটাতে পারলো না। অবশেষে সেও ছামিয়াকে বুঝতে পারলো না। বললো তুমি সব সময় সুখে থেকো আমার থেকে মুক্ত করে দিলাম।
যে ছামিয়া সব হারিয়েও বলে ছাকিবকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। সেই ছাকিব নাকি বলে, যদি পার আমায় ক্ষমা করে দিও। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়। তবুও বেঁচে আছে ছামিয়া। জীবন হেরে যায় মৃত্যুর কাছে। সুখ হেরে যায় দুঃখের কাছে। মিথ্যে ভালোবাসা হেরে যায় বিশ্বাসের কাছে। আর ছামিয়ার সত্য ভালোবাসা হেরে গেল ছাকিবের ছলনার কাছে। সব হারিয়ে আজ সে এক দুঃখে ভরা জীবনের উৎসমুখে সমবেত হয়েছে। বিধাতা যেন ছামিয়াকে এই দুঃখভরা জীবন থেকে সরিয়ে সুখভরা জীবনের উৎসমুখে দাঁড় করেন এবং সুখভরা জীবন দিয়ে তাকে শান্তিপূর্ণ করেন। এটাই আমার কামনা।
ছামিয়ার স্কুল জীবনের শেষ দিন। অর্থাৎ অন্যরকম একটি দিনের কথা লিখতে বসেছি। যে দিনটির কথা ছামিয়া আগে কখনো ভাবেনি। একদিকে দীর্ঘ ৯ বছরের অভ্যস্ত জীবন। পরিচিত পরিবেশের মায়া ছিন্ন করার কষ্ট। অন্যদিকে স্কুলের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে কারাগারের মতো বিশাল বাড়ির ভেতরে আটকে থাকার দুঃখ। মনের মধ্যে এক পৃথিবী কষ্ট তৈরী হয়েছে। এই স্কুলের প্রতিটি ইট-কাঠের সাথে ছামিয়ার কেমন যেন মায়াময় সম্পর্ক অনুভব করেছিলো সেদিন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা মন্ডলী অগণিত ছাত্রছাত্রী পরিবেশের সঙ্গে এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক রচিত হয়েছিলো ছামিয়ার। এগুলো ছেড়ে যেতে হৃদয় হাহাকার করেছিলো তার। শিক্ষকদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এক সাগর দুঃখে তার দু’চোখ গড়িযে অশ্র“ পড়ছিলো। ছামিয়া লেখাপড়া করতে চেয়েছিলো। কিন্তু পারিবারিক বাধা প্রদানে সে তার এই আশাটুকু পূর্ণ করতে পারলো না। তার শিক্ষকদের দেয়া অমূল্য উপদেশ আর দোয়া নিয়ে সে বাসায় ফিরল। ২৫/০৩/১৪ এই তারিখ ছিলো ছামিয়ার বিদ্যালয়ের শেষ দিন। স্কুলের শেষ দিনে ছামিয়ার মনের অবস্থা কাউকে ঠিক বুঝতে পারবে না। ছামিয়ার ক্ষুদ্র জীবনে এই দিন আসলেই স্মরণীয় একটি দিন। স্মৃতির এ্যালবামে পাতাঝরা দিনের মতো এই দিনটি গচ্ছিত থাকবে চিরদিন। সবশেষে কিশোর কিশোরী ভাই ও বোনদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ থাকবে কেউ যেন ছামিয়া এবং ছাকিবের মতো না হয়। জীবনে চলার পথে শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে নিজেকে জীবন যুদ্ধে জয়ী করতে হবে। সর্বদা মনে রাখতে হবে হেরে যাওয়ার নাম জীবন নয়, লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই জীবন। আর জীবন মানেই যুদ্ধ। সেদিন যদি ছামিয়া বন্ধুদের সাথে বাজি না ধরে ছাকিবকে ভালো না বাসতো তাহলে হয়তো তার জীবনে এতো বড় দুঃখ নামতো না। সে আজও জানে না তার নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে। তবু সে আশা করে সুন্দর স্বচ্ছলভাবে বেঁচে থাকবে। শান্তিপূর্ণ জীবনের অংশীদার হতে। জীবন বাস্তবতাই এভাবেই কেটে গেল আমার স্বাদের শিক্ষা জীবন। (সমাপ্ত)