কাজির বাজার ডেস্ক
আসন্ন ঈদুল আজহায় সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। পুঁজি সংকটে আছেন ট্যানারির মালিকরা। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা চামড়া পাচারের আশঙ্কা করছেন।
ট্যানারির মালিকরা জানিয়েছেন, ডলারসংকটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে চামড়া খাতে বিক্রি কমেছে। এলসি খুলতে না পারায় প্রয়োজনমতো রাসায়নিক আমদানি করা সম্ভব হয়নি। আর এতে অনেক ট্যানারিতে সংগৃহীত কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং বিক্রি কমায় পুঁজিসংকটে আছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। তাই গত বছরের চেয়ে এবারে কুরবানির পশুর চামড়া কম কিনতে পারবেন তারা। কুরবানির পশুর চামড়া নষ্ট হলে তার দায় তারা নেবেন না।
অর্থনীতির বিশ্লেষক সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, চামড়া খাতে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। পুঁজিসংকটে আছে অনেক ট্যানারির মালিক। তাই আসন্ন ঈদুল আজহায় কুরবানির পশুর চামড়া ট্যানারির মালিকরা কতটা কিনতে পারবেন তা এখনই হিসাব করে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। না হলে চামড়া খাতে গতবারের মতো নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, এবারে সরকারিভাবে ১ কোটি ১০ লাখ কুরবানির পশুর চামড়া পাওয়া যাওয়ার কথা জানানো হয়েছে। ট্যানারির মালিকরা কঠিন পরিস্থিতিতে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন।
ডলারসংকট আন্তর্জাতিক বাজারের সমস্যা। আমাদের অনেক পুরানো বায়ার ঝুঁকি এড়াতে চামড়াজাত পণ্য কেনা বন্ধ রেখেছেন। ডলারসংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই আমাদের দেশের চামড়া খাতে বিক্রি কমেছে।
তিনি বলেন, এলসি খুলতে না পারার কারণে রাসায়নিক আমদানি করতে পারেনি অনেক ট্যানারি। এতে আগে সংগৃহীত কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ট্যানারির মালিকরা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কুরবানির পশুর চামড়া কম সংগ্রহ করবেন।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ‘গত বছরের ঈদুল আজহায় ট্যানারির মালিকরা ৭০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন। এবারে সরকারিভাবে যে হিসাবই দেওয়া হোক না কেন আমরা ৮০ লাখ থেকে ৮৫ লাখ কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করত পারব কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।’
ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, এবারে কুরবানির পশুর চামড়া কেনার জন্য ২৭৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জেনেছি। ট্যানারির মালিকদের এ সংকটে ব্যাংক ঋণ এর দ্বিগুণ করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, কোনো চামড়া সংগ্রহকারী যদি সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে কুরবানির চামড়া কিনে আমাদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করেন তবে সে দায় ট্যানারির মালিকদের না। এবার বাজার মূল্য বিবেচনা করে বলা যায়, একটি বড় গরু যার দাম ১ লাখ টাকা তার চামড়া লবণ মাখিয়ে ৯০০ টাকার বেশি দামে কেনা সম্ভব না। আর লবণ ছাড়া ৬০০-৭০০ টাকা।
প্রসঙ্গত, প্রথমবারের মতো দেশে প্রতি পিস কুরবানির গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যে গরুর দাম ১ লাখ টাকার মধ্যে বা যে চামড়ার সাইজ ২০ ফুটের মধ্যে, ঢাকায় তার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার টাকা। প্রতি পিস চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণের পাশাপাশি বর্গফুট হিসাবেও দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
এবার ঢাকার মধ্যে কুরবানির গরুর চামড়ার মূল্য ধরা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এতে গতবারের চেয়ে এবার প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম বাড়ল ৫ টাকা। খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা।
করোনার সময়ে চামড়া ব্যবসায়ে ধস নামে। ট্যানারির মালিকরা ঠিকমতো ব্যবসা করতে না পারার কারণে অনেকের পুঁজি কমেছে। করোনার পর চামড়া খাতের মন্দা কাটতে না কাটতে শুরু হয়েছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে টানাপোড়েন চলছে। শুরু হয়েছে ডলারসংকট। বছরখানিক থেকে ডলারসংকটের কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো এলসি খোলার সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে চামড়াজাত পণ্যের কাঁচামালের আমদানি কমেছে।
বিশেষভাবে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত অনেক রাসায়নিক চাহিদামতো আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। যা আমদানি হচ্ছে তার দাম বেশি পড়ছে। ফলে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়ছে। আবার রাসায়নিকসংকটে অনেক ট্যানারিতে কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের অন্যতম ক্রেতা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ। ডলারসংকটের প্রভাব পড়েছে এসব দেশের অর্থনীতিতেও। ওই সব দেশের বায়াররা বাংলাদেশ থেকে চামড়াজাত পণ্য কেনা কমিয়েছে।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার মানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ডলারসংকটের কারণে চামড়া খাতে রপ্তানি কমেছে। সব কিছু মিলিয়ে চামড়া খাত কঠিন সময় পার করছে।
বড় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তো আর ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা যাবে না। এবারে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান কতটা কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করতে পারবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের সংকট বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে প্রথম ১১ মাসে ৯৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। অন্যদিকে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২২ কোটি
ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আগের অর্থবছরের তুলনায় পৌনে ২ শতাংশ কম।
ব্যবসার এমন পরিস্থিতির মধ্যেও ব্যবসায়ীরা কুরবানির পশুর চামড়া চোরাইপথে প্রতিবেশী দেশে বিক্রির আশঙ্কা করছেন। তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চোরাইপথে কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জোরালো দাবি জানিয়ে আবেদন করেছেন।
প্রসঙ্গত, ভারতে বিজেপি সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর গরু হত্যায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। আর এতে ভারতের ট্যানারিগুলোতে কাঁচা চামড়ার সংকট দেখা দিতে থাকে। এর আগে সাময়িক সময়ের জন্য বাংলাদেশ থেকে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হলেও এখন আর এ সুযোগ নেই। বাংলাদেশের ট্যানারিগুলোর কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম ঈদুল আজহা। এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পশুর চামড়া পাচার হয় বেশি।
চামড়া খাতের ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, ভারতে পাচার হয়ে গেলে বাংলাদেশের ট্যনারির মালিকরা কাঁচামালসংকটে পড়বেন। আর এতে দেশে চামড়াশিল্পে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে।