শাহিদ হাতিমী
আজ ১৮ রমাজান। এগিয়ে আসছে রমাজানের শেষ দশক। মুমিন জীবনে প্রস্তুতি চলছে শেষ দশক এতেকাফের বিষয়ে। আগ্রহ জাগছে লাইলাতুল কদর অন্বেষণের জন্য। এতেকাফ এবং শবে কদর নিয়ে সামনের দিনগুলোতে আলোচনা হবে। আমাদের সমাজে দেখা যায় ইফতারের সময় যে আমেজে বা প্রস্তুতি নেয়া হয় সে অনুপাতে সাহরীতে সরবতা কম। অথচ সাহরীতে রয়েছে অনেক বরকত। সাহরী খাওয়া সুন্নাত। প্রিয়নবী সা. ইরশাদ করেন, তোমরা শেষ রাতে খাবার খাও। নিঃসন্দেহে তাতে বরকত নিহিত রয়েছে, -বুখারী-মুসলিম।
কেউ কেউ রাতব্যাপী আড্ডা দিয়ে সাহরীর সময় ঘুমিয়ে পড়েন। দিনের বেলা বন্ধুদের সাথে আলাপ করেন গতরাতে সাহরী না খেয়ে রোজা রেখেছি। কেন আপনি সাহরী না খেয়ে রোজা রাখবেন। ইফতারের মতো সাহরীকেও গুরুত্ব দিন। গতকাল আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে ঐতিহাসিক বদর দিবস। বদর দিবসের শিক্ষা কী আমরা ভুলে যাবো? নিম্নে বদর দিবসের কয়েকটি শিক্ষনীয় দিক আলোকপাত করা হল।
এক. বদর হলো- ঈমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী এক উপখ্যান। বদরযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সাহাবী সৈনিকদের সন্দেহ ছিল না বলেই তারা ইসলাম গ্রহণ করার শুরুর দিন থেকেই অনেক ত্যাগ কোরবানী দিয়ে আসছিলেন। সন্দেহ ছিল কাফির ও মুশরিকদের দলে। তারা তখনও ভাবত যে, যারা তাদের বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে চলে গেছে তারা একদিন নিজেদের ভুল বুঝে পুনরায় ফিরে আসবে কিন্তু বদরের পরে তাদের এই আশায় গুড়েবালি পড়ে। বদরের পর মুশরিকরা এই কথা স্বীকার করে নেয় যে, এরা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। মুহাজির সাহাবিরা তাদেরকে এই যুদ্ধে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের এই সংগ্রাম দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়, সাময়িক চটকদার কোন কিছুর জন্য নয়। তাদের এই সংগ্রাম হলো দুনিয়ার বুকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
দুই. বদর হলো, গনিমত ও আসাবিয়াতের (জাতীয়তাবাদ, গোত্রপ্রীতি) বিরুদ্ধে তাওহিদ ও আকাঈদের সংগ্রামের নাম। মুসলমানরা এসেছিলেন ঈমান ও তাওহীদের চিন্তাকে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, সকল মানুষের কাছে ইসলামের আকীদাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আর মক্কার মুশরিকরা এসেছিল তাদের এক অংশ এসেছিল গনিমতের জন্য, অপর অংশ এসেছিল আসাবিয়াত বা গোত্রপ্রীতির কারণে।
তিন. বদর হলো, যারা বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকে তাদের জন্য নয় বরং যারা বাঁচিয়ে রাখার জন্য বেঁচে থাকে তাদের যুদ্ধ ছিল এই বদর। এটাকি? এটা হলো, নবীদের একটি আখলাকের নাম। সবাই এই কাজ করতে পারে না। হয়ত নিজের সন্তানের জন্য কিংবা নিজের ভবিষ্যতের জন্য পরিশ্রম করতে পারেন কিন্তু এটা হলো বেঁচে থাকা, এর নাম বাঁচিয়ে রাখা নয়। আর অন্যটি হল বাঁচিয়ে রাখা। এই কথা বলতে শেখা, ‘দরকার হলে আমি নিজেকে উৎসর্গ করব তবুও আমাদের উম্মাহ যেন বেঁচে থাকে, আমি না খেয়ে থাকব কিন্তু আমার ভাই যেন খেতে পারে, আমার পরে যারা আসবে তারা যেন সুখে থাকে এই জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেব। আমরা মুসলমানরা এটাকে ইছার বলে থাকি। যার অর্থ, বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা নয়, বাঁচিয়ে রাখার জন্য বেঁচে থাকা। বদরের যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের ভ‚মিকাকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলেই আমরা এর প্রমাণ পাই।
চার. বদর হলো, ইসলামের জন্য, উম্মাহর জন্য কি করা সম্ভব এটা প্রমাণ করে দেয়ার নাম। সমগ্র উম্মাহ ১৫০০ বছর যাবত যা করছে সেটা তো বদরের সেই ৩১৩ জন মহান সাহাবীর ত্যাগের বদৌলতেই। তাদের কাছে খুব বেশী কিছু ছিল না, ৩১৩ জনের জন্য মাত্র ১০০ র মত সাওয়ারী ছিল, নবী করীম সা. সহ তিনজনের ভাগে একটি করে সাওয়ারি ছিল। কাফেরদের দুইশত ঘোড়া ছিল আর মুসলমানদের ছিল মাত্র দুইটি। রাসূল সা. মুশরিকদের দুইশত অশ্বারোহীকে দুই জন দিয়ে মোকাবেলা করার জন্য একজনকে সেনাবাহিনীর ডান পাশে আর অপরজনকে বাম পাশে নিয়োজিত করেন। কিন্তু তাদের এই সংগ্রাম ছিল রিসালাত-ই মুহামদ্দীর জন্য, তাদের এই সংগ্রাম ছিল ইসলামের জন্য। আল্লাহর এই দ্বীনের পথের সংগ্রাম এত হিসাব কিতাব করে হয় না। তাহলে কি দিয়ে হয়? মানুষ হিসেবে নিজের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দিয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমেই হতে পারে।
পাঁচ. বদরের যুদ্ধ ছিল, হয় টিকে থাকার না হয় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার যুদ্ধ। যুদ্ধে অবতীর্ণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা. দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! ক্ষুদ্র এ দলটি যদি আজ শেষ হয়ে যায়, তবে কিয়ামত পর্যন্ত তোমার নাম নেওয়ার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ রাসুল সা. -এর এই দোয়া থেকেই স্পষ্ট হয়, বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট কী ভয়াবহ ছিল। মহান আল্লাহ দয়া করে সেদিন ফেরেশতাদের দ্বারা মুমিনদের সাহায্য করেছিলেন। এখন একটি প্রশ্ন, বদর কি শেষ হয়ে গিয়েছে? বদর সমূহ কোনদিনই শেষ হবে না। আবু লাহাব ও আবু জেহেল বা তাদের দোসররা যতদিন এই দুনিয়াতে থাকবে ততদিন বদরও থাকবে। আবু লাহাব ও আবু জেহেলের অনুসারীরা যেহেতু শেষ হবে না, সেহেতু বদর সমূহও শেষ হবে না। তাই আসুন বদরের সাহাবীদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে ইসলামী সভ্যতাকে পুনরায় বিজয়ী সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই।