রমজানে চিনি খেজুরের বাজার অস্থিরতার আশঙ্কা

22

কাজির বাজার ডেস্ক

পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে সরকার সম্প্রতি চিনি ও খেজুরের আমদানি শুল্ক কমালেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। খেজুর এখন বিলাসী পণ্যের দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজায় চিনি ও খেজুর সরবরাহে বিঘœ ঘটতে পারে। এতে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে দেশে উৎপাদিত লাল চিনির কেজিতে খুচরা পর্যায়ে দাম সর্বোচ্চ ২৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। তবে এ ঘোষণার প্রায় ৬ ঘণ্টা পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ধিত এ দাম প্রত্যাহার করা হয়। ফলে আগের মতোই দেশি খোলা চিনির কেজি ১৩২ এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১৪০ টাকায় মিলবে। গত অর্থবছরে দেশি চিনি উৎপাদন হয়েছে ২১ হাজার টনের মতো। এটি দেশের চাহিদায় তুলনায় অতি নগণ্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা রয়েছে প্রায় ২০ লাখ টন। ফলে প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এ পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মৌলভীবাজারে এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা আসন্ন রমজানে চিনি ও খেজুরের স্বাভাবিক সরবরাহ পাওয়া নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
জবাবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেছেন, রোজার সময় কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন অনেকেই সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেন। আমদানি ও বাজারজাতকারীরা যত বড় ব্যবসায়ী হোন না কেন, অযথা পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আয়োজিত এ মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। সভায় নিত্যপণ্যের শীর্ষ পর্যায়ের পাইকারি ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাজারে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার দিকে নজর থাকবে সরকারের। যৌক্তিক দামে ভোক্তা যাতে পণ্য কিনতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা হবে। কোনো আমদানি ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহ না করলে সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট মিলে অভিযান চালানো হবে।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অন্তত রমজানে সব পণ্যের যৌক্তিক দাম রাখেন। ১৮০ টাকার খেজুর যেন ৩৮০ টাকা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাইকারি পর্যায়েও খেজুরের দর লিখে রাখতে হবে।
এর আগে সভায় ব্যবসায়ীরা তাদের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, নিত্যপণ্য আমদানি করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আমদানিকারকরা যে দাম নির্ধারণ করে দেন, সেই দরে পাইকারদের বিক্রি করতে হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দাম বাড়লে একচেটিয়া পাইকারি ব্যবসায়ীদের দোষ দেওয়া হয়। দাম বাড়ার পেছনের কারণগুলো খুঁজতে হবে।
তিনি বলেন, ভারতে ৪০ টাকায় চিনির কেজি বিক্রি হয়। অথচ বাংলাদেশে কেজিতে ৪৩ টাকা শুল্ক দিতে হয়। শুল্ক কমানোর পর মাত্র ৫০ পয়সা কমেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা নষ্ট করে দিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। জুন মাসে বাজেট হয়, এর পর আর শুল্ক সমন্বয় করা হয় না। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পরিচালক আবু মোতালেব বলেন, ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। সুদ না কমালে পণ্যমূল্য কখনোই কমবে না। তা ছাড়া ডলারের সংকটের কারণে ব্যাংক এলসি দিচ্ছে না। এতে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
ডলারের দর ও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে রোজায় খেজুর মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, খেজুরে কখনোই এত বেশি শুল্ক ছিল না। গত অর্থবছর থেকে খেজুরকে বিলাসী পণ্য হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে ১২০ টাকার খেজুরে শুল্ক দিতে হচ্ছে ২০৮ টাকা। তা ছাড়া গত বছর ডলারের রেট ছিল ১০০ টাকার কিছু বেশি। এখন ডলারের দর ১২০ টাকার বেশি।
তিনি বলেন, কাস্টমসে ১ হাজার ডলারের খেজুরের আমদানি মূল্য আড়াই হাজার ধরে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। এতে অনেক বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এর সুরাহা করতে হবে। তাঁর অভিযোগ, বন্দর থেকে আগে দু’দিনের মধ্যে খেজুর খালাস করা যেত। এখন ৮ থেকে ১০ দিন লাগে। তাতে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঁচ শতাধিক খেজুর বোঝাই কনটেইনার আটকে আছে। দ্রæত খালাস না করলে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘœ হতে পারে। বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম বলেন, রোজায় চিনির চাহিদা বাড়বে। তাতে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক না থাকলে চিনির বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। খুচরা, পাইকারি ও মিলগেটে চিনির দর নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বশির উদ্দিন বলেন, খারাপ ব্যবসায়ীদের দায়দায়িত্ব মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতি নেবে না। তবে অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ীর কারণে ভালো ব্যবসায়ীদের দোষ দেওয়া যাবে না।
শুল্ক কমালেও প্রভাব নেই বাজারে : অসৎ ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র কমতে দিচ্ছে না পণ্যমূল্য। এমনকি সরকার আমদানি পণ্যের শুল্ক কমালেও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরে আমদানি শুল্ক কমানোর দুই সপ্তাহ পার হলেও কোনোটির দামই কমেনি। কয়েকটি খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, খুচরায় আমদানি করা খোলা চিনির কেজি ১৪০ থেকে ১৪৫ এবং প্যাকেট চিনির কেজি ১৪৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দুই-তিন মাস ধরে এ দরেই বিক্রি হচ্ছে চিনি। বর্তমানে বিশ্ববাজারেও ভোজ্যতেলের দর কমেছে। সরকারও শুল্কহার কমিয়েছে। ফলে গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কমিয়েছে। নতুন দর ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। অথচ দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার আগে আমদানিকারক ও বাজারজাতকারীরা কৌশলে বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেন। তাতে সরবরাহ কমে যায়। ফলে আমদানিকারকরা দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুচরা বাজারে ভোজ্যতেলের দর বেড়ে যায়। বাজারে আগের মতোই প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৩ ও খোলা সয়াবিন ১৫৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কোনো দেশ রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ কিংবা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে তৎক্ষণাৎ দেশের বাজারে দাম বাড়িয়ে দেন তারা। পরে সেসব দেশ শুল্ক কমালে কিংবা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলেও বাজারে তার প্রভাব পড়তে দেখা যায় না। গত সোমবার বাংলাদেশসহ ছয়টি দেশে ভারত জিটুজি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ রপ্তানির অনুমতি দিলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে।