তিন কারণে দলীয় প্রতীক রাখছে না আওয়ামী লীগ

7

আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে দলীয়ভাবে আর মনোনয়ন দেবে না আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ কাউকে আর নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেবে না দলটি। ফলে যার যার মতো করে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারবেন নেতারা। যে কোনো প্রার্থীর পক্ষে ভোট করতে পারবেন দলীয় নেতাকর্মীরা। কারণ আওয়ামী লীগ চায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার এই নির্বাচনগুলো সার্বজনীন হোক। এতে তৃণমূলে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে। এড়ানো যাবে দ্ব›দ্ব-সংঘাত। নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক, বাড়বে ভোটার উপস্থিতি। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ইমেজও বাড়বে। ভোট নিয়ে বিদেশিরা আর কোনো ছবক দিতে পারবে না। স্থানীয় সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন। ইতোপূর্বে এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও মেয়র পদে নির্বাচনে দলীয় প্রতীকেই অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এর আগে গত সোমবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থায় দলীয় প্রতীক না রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেয়ার পক্ষে মত দেন। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর ফলে তৃণমূলে দলের মধ্যে মারাত্মক বিভেদ তৈরি হয়েছে। আসন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে একজনকে দলীয় মনোনয়ন দিলে অন্যরা স্বতন্ত্র ভোট করবে। এতে বিভেদ আরো বাড়বে। দলের শৃঙ্খলা থাকবে না। তাই নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেয়াই ভালো হবে। এরপর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপাতত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না। এতে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। ভোট উৎসবমুখর হবে। ভোটার উপস্থিতি নিয়েই তো কিছু দেশ আমাদের সবক দেয়। নির্বাচন উন্মুক্ত হলে ভোটার বাড়বে। তখন তাদের আর কথা বলার সযোগ থাকবে না।
এদিকে দলীয় প্রতীক না থাকায় তৃণমূলে দলের নেতাদের মধ্যে নতুন করে দ্ব›দ্ব-সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা আর থাকছে না। অংশগ্রহণমূলক আর উৎসবমুখর ভোটে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এ বিষযে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার হবে না। দলীয়ভাবে এ নির্বাচনে কাউকে মনোনয়নও দেয়া হবে না। এ নির্বাচনটি সার্বজনীন করার জন্যই আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে যার যার মতো করে স্বতন্ত্রভাবে দলের নেতারা নির্বাচন করতে পারবেন। যে কোনো প্রার্থীর পক্ষে দলের নেতারা ভোট করতে পারবেন। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। তিনি বলেন, এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় হবে কিনা, সেটা আইন বিশেষজ্ঞরা দেখবেন। তবে আমি মনে করি এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় প্রার্থী চ‚ড়ান্ত করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে নানা কোন্দল তৈরি হয়। ফলে কেন্দ্রে নাম পাঠানোর তালিকা নিয়েও নানা সমস্যা তৈরি হয়। স্থানীয় এমপিদেরও পড়তে হয় বিব্রতকর অবস্থায়। অনেকের নাম কেন্দ্রে না আসায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ দলীয় এমপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফলে কয়েকটি গ্রæপে বিভক্ত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। যা দলের জন্য বড় ক্ষতির কারণ। এবার তৃণমূলে দলীয় মনোনয়ন না থাকায় এমপিদের আর বিতর্কের মধ্যে পড়তে হবে না।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে- আপাতত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তটা দলের জন্য বিশেষ করে দলীয় সংসদ সদস্যদের জন্য খুবই ভালো হয়েছে। কারণ ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে এমপিদের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়, তাদের বিতর্কের মধ্যে পড়তে হয়। দলীয় প্রতীক না দেয়ার সিদ্ধান্তে এমপিদের আর বিতর্কের মধ্যে পড়তে হবে না। তিনি বলেন, নৌকা আওয়ামী লীগের কর্মীদর আবেগের প্রতীক। তৃণমূল পর্যায়ে একজনকে নৌকা প্রতীক দেয়া হলে অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়ে যায়। তাদের অনেকেই দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। নৌকার প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই নৌকার বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দেয়। এই যে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হচ্ছে, সেটা এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ঠেকানো যাবে।
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আপাতত দলীয় প্রতীক দেয়া হচ্ছে না- এটা আওয়ামী লীগের সারাদেশের নেতাকর্মীদের সেন্টিমেন্ট বিবেচনা করে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত। ব্রিটেন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়। এসব বিবেচনা করে আমাদের দেশেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন আমরা দেখছি আমাদের দলের মধ্যে অনেক সংকট তৈরি হচ্ছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চাচ্ছিলেন না স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকুক। সবদিক বিবেচনা করে আপাতত আমরা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দলীয় প্রতীক না থাকায় সাংগঠনিকভাবে দল কতটুকু উপকৃত হবে- জবাবে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, যখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছিল না তখন দেখা গেছে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে দল-মত খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হতো না। ব্যক্তি ইমেজ আর জনপ্রিয়তাকে প্রাধান্য দেয়া হতো। নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকায় অনেক সময় দেখা গেছে বিভিন্ন হিসা-নিকাশের কারণে অনেক ক্ষেত্রে অজনপ্রিয়, অযোগ্যরা নেতৃত্বে চলে এসেছে। এসব বিষয় আমাদের দলীয় ফোরামে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর সবার মতামতের ভিত্তিতেই দলীয়প্রধান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপাতত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকা প্রতীক থাকবে না। আমরা মনে করি, এতে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ লাভবান হবে।