কাজির বাজার ডেস্ক
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এজন্য এবারের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এরই মধ্যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বার্ষিক পরীক্ষা শুরুর সব ধরনের প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। শিক্ষার্থীরাও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে। অথচ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কঠোর কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গোটা নভেম্বর মাস সারা দেশের রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের এ হুমকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় সেটা বলা দুরূহ। এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে ৩ কোটি পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। পরীক্ষা কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার পথ কতটা নিরাপদ থাকবে তা নিয়ে তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শিক্ষার্থীরা বড় দুই জোটের রাজনীতির ‘গ্যাঁড়াকলে’ পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
দেশের শিক্ষাবিদরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, গত কয়েক মাসে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল-অবরোধের মতো কোনো কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচির নামকরণও ছিল ‘শান্তিপূর্ণ’। অথচ দু’দলের এসব কর্মসূচির মাঝেই জ্বালাও-পোড়াও-ভাংচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করতে হয়েছে। এমনকি রাবার বুলেট ও কাঁদুনে গ্যাসও ছুড়তে হয়েছে। এতে শুধু আন্দোলনকারীরাই নয়, সাধারণ পথচারীরাও আহত হন। তাই পরীক্ষা চলাকালে যে কোনো কর্মসূচি নিয়ে পরীক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিরোধী জোটের আন্দোলন যাই হোক এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ীই সব পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। এজন্য সরকার ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছে। আন্দোলন কর্মসূচিতে যাতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া-আসার পথের নিরাপত্তা বিঘিœত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থী মহাসীনুল আলমের মা জামিলা খাতুন উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, তার বাসা মাতুয়াইলে। স্বাভাবিক সময়ই এই দীর্ঘ দূরত্বের পথ গণপরিবহণে যেতে হিমসিম খেতে হয়। এ অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন কর্মসূচির কারণে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে এবং তখন রাস্তায় গণপরিবহণ সংকট দেখা দিলে সময়মত পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছানো দুষ্কর হবে। এ সময় পথের নিরাপত্তা কেমন থাকবে- তা নিয়ে তার যত দুশ্চিন্তা।
শিক্ষার্থী জেবুন-নেসার বাবা শহিদুল আলম বলেন, গোটা নভেম্বর মাস সারাদেশের রাজপথ ভয়াবহভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সাধারণ মানুষও এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে তারা তাদের সন্তানদের কীভাবে পরীক্ষা দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাবেন তা নিয়ে তাদের উদ্বেগের শেষ নেই। এদিকে শিক্ষার্থীরাও এ ব্যাপারে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগসহ বিভিন্ন মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে আকুতি জানিয়েছে। মিরপুরের মণিপুর স্কুলের এক শিক্ষার্থী তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছে- ‘আমরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে চাই। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন কর্মসূচির ঘুঁটি হতে চাই না। আমরা আপনাদেরই সন্তান। আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরীক্ষা চলাকালীন সময় আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া বন্ধ করুন।’
শিক্ষার্থী জাহানারা ভুইয়ার শঙ্কা, আন্দোলন কর্মসূচির কারণে কোনো পরীক্ষায় অনুপস্থিতি কিংবা পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে বিলম্বের কারণে শিক্ষাজীবনই থমকে যেতে পারে এই দুশ্চিন্তায় অনেকের পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও ব্যাঘাত ঘটছে। এই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, বার্ষিক পরীক্ষার মধ্যে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া যায় কিনা, সেটা রাজনীতিবিদদের ভাবা উচিত।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২৭ অক্টোবরের পর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে অবস্থান কর্মসূচি কিংবা ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যার শুরুটা হতে পারে সচিবালয় দিয়ে। এরপর সংসদ ভবন, নির্বাচন কমিশন, বঙ্গভবন ও গণভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসতে পারে। তবে ঘেরাওয়ের বদলে নাম হতে পারে ‘শান্তিপূর্ণ অভিযাত্রা’। এসব কর্মসূচিতে কাজ না হলে নভেম্বরে ঢাকা অবরোধে যাবে বিএনপি। এরপর রাজপথ দখলে নিয়ে অলআউট কর্মসূচিতে যাওয়ার চিন্তা করছেন দলটির নেতারা।
দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নভেম্বরে প্রথমভাগে তফশিল ঘোষণার আগেই সরকারকে দাবি মেনে নিতে বাধ্য করতে চান তারা। সরকারের মনোভাব ও পরিস্থিতি বুঝে আন্দোলন কর্মসূচি সর্বোচ্চ কঠোর হতে পারে।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাজপথে হার্ডলাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির বিপরীতে কর্মসূচি, আন্দোলনের বিপরীতে প্রতিরোধ- আপাতত এই নীতিতে এগোবে দলটি। আওয়ামী লীগ নেতাদের ধারণা, নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় যে কোনো সময় রাজপথের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে পারে বিরোধী দল ও জোটগুলো। তাই সতর্ক অবস্থানে থেকে রাজপথের কর্মসূচিতে গতি বাড়ানোর সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২ কোটি ২২ লাখ ২৭ হাজার ৮১৬ জন; মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে ১ কোটি ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৪৩ জন এবং মাদ্রাসায় প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে।