দেশে বেকার তরুণের সংখ্যা অনেক। পরিবারের জন্য কিছু করতে না পেরে তাঁরা এক ধরনের আত্মগ্লানিতে ভোগেন। আর তাঁদেরই টার্গেট করে মানব পাচারকারীরা। উন্নত জীবন, ভালো বেতন, অনেক সুযোগ-সুবিধা-এমন নানা প্রলোভন দিয়ে তাঁদের বিদেশে যেতে প্ররোচিত করে। একসময় মানব পাচারকারীদের জালে তাঁরা ফেঁসেও যান। পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা তুলে দেন পাচারকারীদের হাতে। পর্যটন ভিসায় কিংবা ভিসা ছাড়াই তাঁদের বিভিন্ন দেশে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় মাফিয়াদের হাতে। কিংবা আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে আবারও মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এই অবস্থায় মারা গেলে মরুভ‚মি, জঙ্গল বা সাগরে মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয়। এর পরও থামছে না এই ভয়ংকর মানবপাচার। প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, লিবিয়ার বেনগাজির গানফুদা ডিটেনশন সেন্টারে আটক ১৫১ জন বাংলাদেশিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় মঙ্গলবার দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
তাঁদের প্রত্যেকেই অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকের মতে, মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থা থেকে তাঁরা ফিরে এসেছেন। ফিরে আসা তরুণদের প্রায় সবারই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে কয়েকজন ভুক্তভোগীর সেই দুঃসহ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। চাঁদপুরের মোশাররফ হোসেন জানান, দুই বছর আগে তিনি দালালের মাধ্যমে লিবিয়া যান।
প্রথমে তাঁকে দুবাই নিয়ে ৯ দিন রাখা হয়। সেখান থেকে ওমানে নিয়ে রাখা হয় ছয় দিন। এরপর তিন দিন মিসরে রেখে নেওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে নিয়েই তাঁকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর চরম নির্যাতন করা হয়। পা ওপরে বেঁধে ঝুলিয়ে মারধর করা হয়। দেশে ভিডিও কল দিয়ে সেসব দেখানো হয়। তাঁকে সাড়ে সাত লাখ টাকা মুক্তিপণও দিতে হয়েছে। ইতালি পাঠানোর কথা বলে নেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রামের বিল্লাল মাহমুদকে। দালালরা বলেছিল, ভিসা দেবে, বৈধ কাগজপত্র দেবে এবং চাকরি দেবে। তারা বিল্লালকেও লিবিয়ায় নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ১০ লাখ টাকা দিয়ে তাদের কাছ থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। এমন অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই।
মানবপাচারের এমন ভয়ংকর সব কাহিনি নতুন নয়। দালালদের মাধ্যমে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে গিয়ে সাগরে ডুবে প্রাণ দিতে হয়েছে শত শত তরুণকে। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলের গণকবরে ঠাঁই হয়েছে বহু তরুণের। আফ্রিকার মরুভ‚মিতে অনাহারে, তৃষ্ণায় প্রাণ গেছে অনেকের। ভ‚মধ্যসাগরেও প্রাণ গেছে শত শত বাংলাদেশির। তার পরও এই ভয়ংকর মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না কেন? বিশেষজ্ঞরা এ জন্য মানব পাচারবিরোধী অভিযানের দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন। সেই সঙ্গে আছে বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। এই ১৫১ জন কোন কোন দালালের মাধ্যমে বিদেশে গিয়েছিল তাদের সবাইকে খুঁজে বের করতে হবে। তাদের বিচারিক প্রক্রিয়া দ্রæততর করতে হবে। পাচারের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।