কাজির বাজার ডেস্ক
২০০০ সালে শনাক্ত হওয়া ডেঙ্গু দেশে জেঁকে বসে ২০১৯ সালে। ওই বছরই সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর রূপে আবিভর্‚ত হয় ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সে বছর হাসপাতালে যেতে হয় ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জনকে। আর ওই বছর জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি হন ১৬ হাজার ২৫৩ জন, মৃত্যু হয়েছিল ৪০ জনের।
অথচ চলতি বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২০১৯-এর জুলাইয়ের চেয়ে আড়াই গুণেরও বেশি রোগী। সংখ্যার হিসাবে যা ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাইয়ের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে আগস্ট মাস। অতিরিক্ত রোগী, হাসপাতালে শয্যা সংকট, জনবল সংকট, রোগের ধরনে পরিবর্তন, মশা নিধন কার্যক্রমের অসারতা- সব মিলে পরিস্থিতি রীতিমতো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, দেশে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৫২ হাজার ৬৩৬ জন। কিন্তু সে মাসে মৃত্যু হয়েছিল ৯০ জনের। গত বছরে অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় যে বছরে, সে বছরের নভেম্বরে ১১৩ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া দেশে আর কোনো একক মাসে মৃত্যুসংখ্যা ৩ অঙ্কে পৌঁছায়নি। বছরে ১০০ জনের বেশি রোগীর মৃত্যু হয় ২০২১, ২০১৯ ও ২০২২ সালে। ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়; ২৮১ জনের। এ ছাড়া ২০২১ ও ২০১৯-এ মৃত্যু হয় যথাক্রমে ১০৫ জন ও ১৭৯ জনের। আর এ বছর মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যেই ২৫১ ছাড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সোমবার জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (৩০ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ৩১ জুলাই সকাল ৮টা) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৬৯৪ জন। তাদের নিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মোট রোগীর সংখ্যা ৫১ হাজার ৮৩২ জন। আর এই সময়ে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী আগস্ট মাসে ডেঙ্গু আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে। ৫১ হাজার রোগী কেবল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর বাইরে অসংখ্য রোগী বাসা, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বার ও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক তালিকার বাইরে। তাই অধিদপ্তরের এই তালিকার কয়েক গুণ বেশি রোগী রয়েছে দেশে।
জুলাইয়ের সতর্কবার্তা আগেই ছিলজুলাই মাসে রোগী বাড়বে- এ সতর্কবার্তা আগেই করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলতি বছরে জুন মাসেও আগের সব রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এদিকে, রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ৫৭টি ওয়ার্ড মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে বলে জানিয়েছিল অধিদপ্তর। কারণ, বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এডিস মশার এডাপ্টেশন- এই দুটি মিলিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আগে কখনোই ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হওয়ার আগে এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়েনি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যাপক হারে না বাড়ালে এ বছর ডেঙ্গু স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে দেখা দেবে। আর এ বছর বর্ষা এসেছে দেরিতে, যাবেও দেরিতে। সে সময় ডেঙ্গু আরও ভয়ংকর হয়ে আসবে।’
জুলাইয়ে জ্যামিতিক হারে বাড়ে রোগী
গত ৫ জুলাইয়ে চলতি বছরের সরকারি হিসাবে রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়ায়। ১১ জুলাইয়ে রোগীর সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৮৯৭ জন। ১২ জুলাইয়ে ১৬ হাজার ১৪৩ জন, ১৫ জুলাইয়ে সেটা হয় ১৯ হাজার ৪৫৪ জন, ২০ জুলাইয়ে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৫৪৭ জন। এরপর গত ২২ জুলাইয়ে চলতি বছরের প্রথম ২ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়; সেদিন ২ হাজার ২৪২ জন রোগী নিয়ে মোট রোগীর সংখ্যা হয় ৩০ হাজার ৬৮৫ জন। এরপর থেকে আর রোগীর সংখ্যা ২ হাজারের নিচে নামেনি। ৩০ জুলাইয়ে ৪৯ হাজার ১৩৮ জন আর ৩১ জুলাইয়ে রোগীর সংখ্যা ৫১ হাজার ছাড়িয়ে হয়ে যায় ৫১ হাজার ৮৩২ জন।
দোষারোপের রাজনীতিতে উলুখাগড়ার প্রাণ যায় : জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে গত ৫ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে জানিয়ে মশা নিধনে দায়িত্বরতদের আরও কার্যকর ভ‚মিকা পালনের আহŸান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মশা নিধনে যারা দায়িত্বরত আছেন, তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। আপনারা আপনাদের কার্যক্রম আরও বাড়ান।’
গত ১৬ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান, এ বছর ডেঙ্গু রোগী যে অনেক বাড়বে, সেটা আগেই ধারণা করেছিলেন তারা। সে জন্য সিটি করপোরেশনগুলোকে চিঠিও দেয়া হয়েছিল।
অথচ গত ৩০ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আয়োজিত ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদারবিষয়ক মতবিনিময় সভায় মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এক সপ্তাহে মাত্র ৭৫৫ জন ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ডেঙ্গু কার্যক্রম যে সফল হয়েছে, এটি তারই নিদর্শন।’
ভয়ংকর আগস্ট : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘দেশে ২৩ বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ আমরা কমাতে পারিনি। বরং দিনকে দিন সেটা আরও বাড়ছে। সামনের আগস্টে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে, ভয়ংকর হয়ে উঠবে। তিনি বলেন, ‘আগের সব হিসাব আমরা অতিক্রম করব। সেটা রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যু- দুটোতেই, যদি না এডিসকে আমরা নিধন বা নির্মূলে সফল না হই। কিন্তু সিটি করপোরেশনের যা যা করার কথা ছিল, তারা সেটি করছে বলে আমরা দেখছি না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এডিস নিধনে সিটি করপোরেশন যত পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো পর্যাপ্ত ছিল না, পর্যাপ্ত যদি হতো তাহলে তো এত বছরে ডেঙ্গু থাকার কথাই না।’
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আগস্ট মাস ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়ংকর হবে। এখন সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে ব্যাপকভাবে কাজ করা উচিত, যেটা করোনার সময়ে করা হয়েছিল। নয়তো নিস্তার নেই আমাদের কারও।’