কাজির বাজর ডেস্ক
সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এলাকায় স্বল্পমেয়াদি বন্যা অব্যাহত রয়েছে। তবে গত বছরের মতো তীব্র বন্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই। এদিকে, গঙ্গা অববাহিকায় পদ্মা, যমুনা ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে পারে। উজানে পানি বাড়লেই তিস্তা ব্যারেজের কপাট খুলে দিতে হয়। চলতি সপ্তাহে আগাম বন্যায় ৪৪টি কপাট খুলে দেওয়া হয়। এতে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে রংপুর ও কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি কমে এলেও বন্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চলতি মাসে মাঝারি মানের বন্যা হলে মাঠে থাকা আমন ধানের বীজতলা, আউশ ধান, সবজি, গম ও ভুট্টার ক্ষতি হবে। শনিবার আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত রয়েছে। ফলে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপক‚লীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এজন্য দেশের চার সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক ডক্টর নজরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন বিশ্বব্যাপী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। জলবায়ুুর প্রভাবে গত দুই দশকে পুরো বিশ্বে বন্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা ২৫ শতাংশ বেড়েছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের গবেষক ও বন্যা বিশ্লেষণভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্লাউড টু স্ট্রিটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বেথ টেলম্যান এ তথ্য জানিয়েছেন। এতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, জার্মানি, বেলজিয়ামসহ ইউরোপে ভয়াবহ বন্যা আসে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাধারণত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে দেখা হলেও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। সেখানে দেখা যায়, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বন্যার পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ভবিষ্যতে আফ্রিকাতেই বন্যায় প্রতিবছর ২৭ লাখ মানুষ গৃহহীন হতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যাটা সাড়ে আট কোটি ছাড়াবে।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত প্রবন্ধে গবেষকরা জানান, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৬ লাখ ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ। বাংলাদেশ প্রকৃতিগতভাবেই ভাটির দেশ। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বন্যার পানির উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ভারত, নেপাল ও চীন। বন্যার সময় এসব দেশ থেকে ধেয়ে আসা পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। উজানের দেশগুলো থেকে বয়ে আসা পানি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে প্রায় প্রতিবছরই বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়।
জলবায়ু গবেষক ডক্টর সামিউল আলম বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে অতিবৃষ্টির কারণেই বেশি বন্যা হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয় ১৯৯৮ সালে, যাতে দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গেলে সাধারণত বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের মানুষ বন্যার সঙ্গে বসবাস করে। গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতটি বড় বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা প্রলয়ংকরী হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা একসঙ্গে সক্রিয় হওয়ায় বড় বন্যা হয়। ১৯৮৭ সালে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি আর ১৯৮৮ সালে ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়। ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালের বন্যায়। জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও উজানের দেশের অতিবৃষ্টি বন্যার প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। বাংলাদেশে ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৫, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭, ২০১৯, ২০২০ সালের বন্যায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের বন্যায় বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পলি পড়ার পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়ছে। ফলে নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে আসছে। এ কারণে উজানের ঢল এলেই তা বন্যায় পরিণত হচ্ছে। প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় আট লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়, যা বার্ষিক মোট প্রবাহের ৯৫ শতাংশ। তুলনায় একই সময় দেশের অভ্যন্তরে এক লাখ ৮৭ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদীপ্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টিজনিত কারণে।
এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, বর্ষায় ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশে বন্যা হয়। মহাভারত, রামায়ণসহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অর্থমন্ত্রী কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে রাজ্যের নানা স্থানে বৃষ্টিপাত ও বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।
জলবায়ুবিষয়ক বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের ৩০ লাখ হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে তীব্র বন্যার কবলে পড়বে দেশের নিম্নাঞ্চল। স›দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপক‚লের পানি পরিমাপ করে গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উপক‚লে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় চীন ও বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদে পড়ছে বলে নাসা সতর্ক করেছে। বাংলাদেশে উপরিভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের গড় উচ্চতা প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বাড়বে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
বিশ্বের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ‘ক্লাইমেট সেন্ট্রাল’। এই প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বন্যার আঘাতের শিকার হবে বাংলাদেশের চার কোটি ২০ লাখ মানুষ। আগে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের ওপর যতটুকু পড়বে বলে ভাবা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে এই প্রভাব হবে আরও অনেক ভয়ানক। বাংলাদেশে এই প্রভাবের শিকার মানুষের সংখ্যা হবে প্রায় পাঁচ কোটি ৭০ লাখ।
ব্রিটিশ বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার’-এ এই সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব মানুষ এর শিকার হবে, এর দুই-ততৃীয়াংশেরও বেশি মানুষ বসবাস করে এশিয়ার কিছু দেশে। বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড জনবহুল দেশ। এরই মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল কিরিবাতি ও তুভালু দ্বীপ পানির গর্ভে চলে গেছে। এই দ্বীপ দুটির বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে সাগর পেরিয়ে অন্য দেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিতে হয়েছেন।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিকট ভবিষ্যতে আরও এমন অনেক অঞ্চল সাগরে হারিয়ে যাবে। ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক’ নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এই মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু উপক‚লীয় শহর বড় ধরনের জলোচ্ছ¡াসের সময় পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এসব শহরের মধ্যে প্রথম দিকে রয়েছে, ঢাকা, ব্যাংকক, হংকং, সাংহাই, তাইজহু, সুরাবিয়া, মুম্বাই, হো চি মিন সিটি এবং ওসাকা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতে আরও বেশি এবং মারাত্মক বন্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে প্রকাশিত হয়েছে জাতিসংঘের এক সমীক্ষায়। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২২’ শিরোনামে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যার পাশাপাশি দূষণ ও নিম্নমানের ভ‚গর্ভস্থ পানির উৎসের কারণে বাংলাদেশ খরার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।