কাজির বাজর ডেস্ক
বাংলাদেশে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। ২৩ মে ১০ জেলায় ১৬ জন, ২৭ এপ্রিল ৬ জেলায় ৮ জন এবং ২৩ এপ্রিল দেশের পূর্বঞ্চলের ৬ উপজেলায় ৯ জন বজ্রপাতের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন। কয়েক বছর ধরেই এমন প্রাণহানি বাড়তে থাকায় জনমনে উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে ২ দিনে বজ্রপাতে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই বছরই বর্তমান সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন যখনই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয় বৃষ্টি হবে, তখনই বজ্রপাত হবে বলে ধরে নিতে হবে। বিশেষ করে এপ্রিল, মে ও জুনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এমন আবহাওয়া থাকে। তবে মার্চ থেকেই শুরু হয় বজ্রপাতের অনুক‚ল পরিবেশ।
এদিকে বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, বজ্রপাতে মৃত্যুহার বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে বিশ্বে যে সংখ্যক মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। দেশের হাওড়, বাঁওড় ও বিলপ্রবণ জেলায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ২০১১ সালের শুরু থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১২ বছরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৬২ জনের। সাধারণত এপ্রিল ও জুনে বজ্রপাত বেশি হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বেসকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর গড়ে বজ্রপাতে ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই মাঠে থাকা কৃষক, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে, আর ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময়।
অবস্থানগত কারণেই দেশে বজ্রপাত বেশি হয় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স এবং ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান। তার মতে, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে হিমালয় থাকায় গরম-আর্দ্র ও শীতল-শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। এই দুই ধরনের আবহাওয়ার সংঘাত ঘটলেই সাধারণত বজ্রপাত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাড়ছে মূলত সতর্কতা না থাকার কারণেই। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ রোধে মানুষের কোনো হাত নেই। কিন্তু বজ্রপাতনিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা মানুষের পক্ষে সম্ভব। শহরে বেশির ভাগ ভবনে বজ্রনিরোধক দÐ থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যু তেমন হয় না। কিন্তু গ্রামে তা না থাকা ও বড় গাছপালা কমে গিয়ে খোলা মাঠের কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
সামাজিক সংগঠন ‘সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম এওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএএফ) সভাপতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত¡ বিভাগ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এপ্রিল থেকে জুন এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া এবং গ্রামাঞ্চলে গাছ বিশেষ করে মাঠের উঁচু গাছ কেটে ফেলা বা না থাকার কারণে বজ্রপাত বেড়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১ ডিগ্রি উষ্ণতা বাড়লে বজ্রপাতের প্রবণতা বেড়ে যায় ১০ থেকে ১২ বর্গকিলোমিটার। একটা সময় দেশে প্রচুর সংখ্যক বড় বড় গাছ ছিল। যেমন তাল, সুপারি, নারকেল। আর এখন মাঠের পর মাঠে কোনো বড় গাছ দেখা যায় না। আমরা গাছ কেটে ফেলেছি। হাওড় অঞ্চলের বিশাল ভ‚মিতে বজ্রপাতের সময় কৃষকরা আশ্রয় নেয়ার কোনো জায়গা পায় না। আবার জায়গা থাকলেও সেখানে বজ্রনিরোধক থাকে না। ফলে সেখানে মৃত্যু বেশি।
জানা যায়, বজ্রপাত প্রতিরোধ ও মানুষের জীবন বাঁচাতে সারাদেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ কোটি তাল গাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে সারাদেশে ৩৮ লাখ চারা রোপণের পর দেখা যায় তা এক বছরের মধ্যেই অযতœ অবহেলায় মারা যায়। এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান সম্প্রতি বলেছেন, তালগাছ প্রকল্প সরকার বাতিল করেছে। এটা কোনো ফল দেয়নি। আর তালগাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে। এর পরিবর্তে ১ হাজার ৩শ কোটি টাকা ব্যয়ের লাইটিনিং অ্যারেস্টারসহ লাইটিনিং শেল্টার নির্মাণ এবং আর্লি ওয়ার্নিং ফর লাইটিনিং, সাইক্লোন এন্ড ফ্লড- এই দুটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এছাড়া বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় লাইটিনিং অ্যারেস্টার স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বজ্রপাতপ্রবণ জেলাগুলোতে আরো এগুলো বসানো হবে।
ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইয়ারলি এভারেজ লাইটেনিং ডেনসিটি ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বার্ষিক প্রতি বর্গকিলোমিটারে বজ্রপাতের প্রবণতার হার ১৫ দশমিক ৪৫। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি জেলায় কম-বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। তবে শহরের তুলানায় গ্রামাঞ্চলে এবং হাওড় এলাকায় বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে দেশের ১০ জেলায় বজ্রপাতের ঘটনা এবং মৃত্যু বেশি হয়। জেলাগুলো হলো- সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রাম।
বজ্রপাত নিয়ে মানুষের মনে ভীতি ও নেতিবাচক ধারণা থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর উপকারিতাও আছে। সব বজ্রপাতে মানুষ মারা যায় না। আর সার্বিক পরিবেশের জন্য বজ্রপাত উপকারী। বজ্রপাত হলে মাটিতে নাইট্রোজেনের সংযুক্তি হয়। যা ভ‚মির উর্বরতা বাড়ায়। এছাড়া বজ্রপাত হলে মাছ ডিম পাড়ে। এমন কিছু ইতিবাচক বিষয়ও বজ্রপাতের কারণে হয়ে থাকে। আমাদের শুধু এর কারণে প্রাণক্ষয়ের বিষয়টি রোধ করা জানতে হবে। এ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। মেঘ ডাকলেই সাবধান হওয়া উচিত।