আফতাব চৌধুরী
ওই যে সূর্যটা, দেখতে একরঙা মনে হলে কি হবে, আসলে ওর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সপ্ত রঙের বিচিত্র আলিম্পন। বেগুনি, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা কিংবা লাল-কোনও একটা রঙকে আলাদা করে সূর্যের রঙ বললে চলবে না। মিলিয়ে নিতে হবে সাতটি রঙকেই। কবিদের মন অনেকটা ওই সূর্যের মতই। নানা রঙের টানাপোড়নে তৈরী ওটা। কোন একটি রঙ ধরে বলা যাবে না যে এটাই কবির রঙ। এ শতকের সমবয়সী কবি নজরুল ইসলামের সামনে দাঁড়ালেও আমাদের ওই সমস্যায় পড়তে হয়। কতদিক থেকে দেখব তাঁকে-বিদ্রোহী কবি তো বটেই, সে সঙ্গে তিনি আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার। শ্যামা সঙ্গীতেও তিনি অন্যতম গীতিকার। আবার গীতিবৈচিত্রইবা কত রকমের। ইমলামী গান তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে ঝরঝর করে। লিখেছেন প্রেমের গান, লিখেছেন গজল, ঝুমুর আরও কত কি। শুধু তাই নয়, গল্প, উপন্যাস, নাটক-এসব তিনি লিখেছেন অনায়াসে স্বাচ্ছন্দে। অথচ কতদিন লিখেছেন? ভাবলে অবাক লাগে-মাত্র বাইশ বছরে।
নজরুল চর্চায় যারা নিরলস তাঁরা হিসাব দিয়েছেন যে, কবি যখন বাংলা সাহিত্যের আসন জুড়ে বসলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি কি একুশ মাত্র। কবির দৈহিক মৃত্যু হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, আর মানসিক মৃত্যু হয়েছিল ১৯৪২ সালে। অর্থাৎ কবির বয়স যখন ৪২ তখনই ফুলের জলসা শেষ হল, মুখর কবি মৌন হলেন। বাইশ থেকে ৪২-এ কুড়ি বছরেই তাঁর এতকিছু লেখা। তার পরেও নজরুল ৩০-৩৫ বছর বেঁচেছিলেন কিন্তু সে তো শুধু বেঁচেই থাকা নামকাওয়াস্তে। বার্নাড শো, যাকে কবি-শিল্পীদের জীবনে জুভেনাইল ফেজ বলেছিলেন, সে অঙ্কুরেই কবি নজরুলের সমাপ্তি। তবু নজরুল এতকিছু লিখেছিলেন।
কিন্তু যত কিছুই নজরুল লিখুন না কেন তা মূলত দাঁড়িয়ে আছে একটি স্থায়ী ভাবনার উপর। আলঙ্কারিকরা যাকে বলেছেন, নজরুলের ক্ষেত্রে তা হল প্রেম। তাঁর ব্যক্তি সত্তা আর প্রেম, তাঁর মানব প্রেম, তাঁর প্রকৃতি প্রেম, তাঁর সৌন্দর্যপ্রেম, সমাজপ্রেম, দেশপ্রেম সবকিছুই তাঁর ওই প্রেমানুভ‚তি থেকে সঞ্জাত। দেশকালের নানা পরিস্থিতির জন্য এ প্রেম যথার্থভাবে প্রকাশিত হতে পারছে না বলেই তাঁর বিদ্রোহ। তিনি সব বন্ধন থেকে সর্বদা মুক্তি পিয়াসী। কবি জানতেন পৃথিবীতে নানা বৈষম্য, অত্যাচার, স্বার্থপরতা, অন্যায় বিশৃংখলা, শোষণ, পরাধীনতা, দারিদ্র-এসবের জন্য তাঁর প্রেম ব্যাহত হচ্ছে, আর তাই তিনি বিদ্রোহী। প্রেমিক না হলে কি বিদ্রোহী হওয়া যায়? নিজের ব্যাখ্যা নিজে দিতে গিয়ে নজরুল একবার বলেছিলেন ফুল ফুটানোই আমার ধর্ম, তরবারি হয়তো আমার হাতের বোঝা, কিন্তু তাই বলে তাকে ফেলেও দেইনি। আমি গোধূলিবেলায় রাখাল ছেলের সঙ্গে বাঁশী বাজাই, ফজরে মোয়াজ্জিনের সুরে সুর মিলিয়ে আজান দেই, আবার দীপ্ত মধ্যাহ্নে খর তরবারি নিয়ে রণভ‚মে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন আমার খেলার বাঁশী হয়ে উঠে যুদ্ধের বিষাণ, রণসিঙ্গা। সুর আমার সুন্দরের জন্য আর তরবারি যে সুন্দরের অবমাননা করে সে অসুরের জন্য।
বাংলা সহিত্যের আঙ্গিনায় নজরুলের যখন প্রবেশ, ভারত তখনই অসুরেরই মৃগয়াক্ষেত্র। কিছু দিন আগে জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ঘটে গেছে। ইংরেজ-শাহির অত্যাচার ও জুলুম ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্কায় টুটি চেপে ধরতে ব্যস্ত। অন্যদিকে স্বাধীনতা পিয়াসীরা প্রস্তুত হচ্ছেন তাঁদের অসহযোগ আন্দোলনের জন্য, বিপ্লবীরাও তখন মুক্তির অপেক্ষায় অধীর। এ সময় নজরুলের প্রেম অবলম্বন করল তাঁর স্বদেশকে। স্বদেশপ্রেমের বন্যায় ভেসে গেলেন কবি, তাঁর কবিতা, গান আর প্রবন্ধ নিয়ে। প্রথম দিকে তিনি বিশ্বাস করতেন অসহযোগ আন্দোলন বিদেশী মূলোৎপাটন করবে। সে আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে তাঁর লেখনী মুখর হল:
এবার মহানিশার শেষে
আসবে ঊষা অরুণ হেসে, করুণ বেশে
আলো তার ভরবে এবার ঘর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
গান্ধীজিকে বন্দনা করে তিনি লিখেছেন:
এ কোন পাগল পথিক ছুটে এল
বন্দিনী মা-র আঙিনায়
ত্রিশ কোটি ভাই মরণ-হরণ
গান গেয়ে তার সঙ্গে যায়।
বিদেশী পণ্য বর্জনের ডাক দিলেন শওকত আলী, গান্ধীজিসহ সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ, জাতির কানে দিলেন চরকার মন্ত্র। নজরুল সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন নেংটি পরা এক ফকিরের নির্দেশে আসমুদ্র হিমাচল মন্ত্রমুগ্ধ। তিনি অনুভব করলেন যে, এ চরকার শব্দেই একদিন স্বরাজ্যের সিংহদ্বার খুলবে।
চরকার উদ্দেশ্যে কবি লিখলেন:
তোর ঘোরার শব্দে ভাই সবাই শুনতে পাই
ওই খুলল স^রাজ সিংহদ্বার আর বিলম্ব নাই।
ব্যক্তিগত জীবনে নজরুলের মনে তখনই নারীপ্রেমের আনাগোনা। কিন্তু সে প্রেমও রূপান্তরিত হল স্বদেশ প্রেমে। স^াধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী উদ্বেলিত জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নজরুল লিখলেন:
আজ রক্তনিশির ভোরে একি এ শুনি ওরে
মুক্তি কোলাহল বন্দীশৃঙ্খলে,
ঐ কাহারা কারাবাসে মুক্তি হাসি হাসে?
টুটেছে ভয়-বাধা স্বাধীন হিয়াতলে?
ললাটে জয়টিকা, প্রস-ন ইহার গলে চলেরে বীর চলে
সে নহে নহে কারা যেখানে ভৈরব রুদ্রশিখা জ্বলে।
সে অভয় মন্ত্র নজরুল ছড়িয়ে দিলেন দিকে দিগন্তরে:
অভয়-চিত্ত ভাবনা মুক্ত যুবারা শুন।
মোদের পিছনে চিৎকার করে পশু শকুন।
ভ্রকোটি হানিছে পুরাতন পচা গলিত শব।
রক্ষণশীল বুড়োরা করিছে তাহারি স্তব।
শিবারা চেঁচাক শিব অটল।
নির্ভীক বীর পথিক দল, জোর কদম চল রে চল।
ততদিনে নজরুলও পড়েছেন জনতার সরণিতে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর। দেশবন্ধুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল স্বদেশী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে। গ্রেপ্তার হলেন আরও অনেকে। নজরুল লিখলেন ভাঙ্গার গান:
কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।
দেশবন্ধু, মৌলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী ও সুভাষচন্দ্রের বৈপÐবিক চেতনা এবং মুজাফর আহমেদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য নজরুলকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। এ পটভ‚মিতে সে অবিস্মরণীয় কবিতা:
বল বীর বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমার, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।
বিপ্লববাদের প্রতিও ততদিনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন নজরুল। প্রকাশ করলেন নিজের পত্রিকা ধূমকেতু। স¤পাদকীয় স্তম্ভে তিনি লিখলেন, পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। আর বিদ্রোহ করতে হলে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে-আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।
ওই ধুমকেতুতে বেরোল:
রক্তাম্বর পর মা এবার জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন, দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন বাজে তরবারি ঝনঝন
সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেল মাগো, জ্বলে সেথা জ্বলে কাল চিতা।
তোমার খসা রক্ত হউক ¯্রষ্টার বুকে লাল ফিতা।
নজরুলকে আর উপেক্ষা করতে পারল না ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী। তারা নজরুলের গোটা সাতেক কবিতার বই বাজেয়াপ্ত করলেন। পৃথিবীর আর কোন লেখকের এতগুলো বই এক সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হল। আদালতে জবানবন্দিতে নজরুল বলেন-আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রেরিত। কবি বলেন-আমার বাণী সত্যের প্রকাশ। সে বাণী বিদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোতে ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরাপরাধ, নিস্কলুষ, অমÐান, অনির্বাণ, সত্যস্বরূপ।
লর্ড কার্জন এদেশে দ্বিজাতিতত্তে¡র বীজ বুনেছিলেন, ক্ষেত্র তৈরী করেছিলেন, ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াইয়ের।
রবীন্দ্রনাথ ইতিহাস ঘেঁটে এদেশে শখ, হুণ দল পাঠান, মোগল, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানের এক দেহে লীন হয়ে যাওয়া দেখেছিলেন। নজরুল সে ঐতিহাসিক পথ ধরেই অনায়াসে সাবলীলতায় লিখতে পেরেছিলেন:
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রীষ্টান।
নজরুল লিখেছিলেন—-আমি শুধু ভারতের জলবায়ু মাটি, পর্বত অরণ্যকেই ভালবাসিনি। আমার ভারতবর্ষ ভারতের মূক, দরিদ্র, নিরন্ন, পর-পদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ। আমার ভারতবর্ষ ইন্ডিয়া নয়, হিন্দুস্থান নয়, গাছপালায় ভারতবর্ষ নয়-আমার ভারতবর্ষ মানুষের, যুগে যুগে পীড়িত মানবত্মার ক্রন্দন তীর্থ। ওরে এ ভারতবর্ষ তোমাদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানদের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়। এ আমার মানুষের, মহামানুষের মহাভারত।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।