ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ

7

 

প্রতিবছর ঈদের খুশিকে বাড়িয়ে তুলতে শহরের মানুষরা গ্রামের বাড়ি যান। আত্মীয়-পরিজনের সান্নিধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। রমজান মাসেই বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ান তারা। আর তাতেই নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। ঈদের আনন্দই যেন মাটি হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় বয়ে আনে কান্না। তাই সবার প্রত্যাশা থাকে, এবারের ঈদ যাত্রা যেন নিরাপদ ও আনন্দময় হয়।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। তাই ঈদের সময় বিভিন্ন চক্র, ছিনতাইকারী, মলম পার্টি ও গামছা পার্টির আবির্ভাব হয়। তাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে বিপদে ফেলা। বিশেষ করে মলম পার্টি ও ছিনতাইকারী। ঈদের সময় এলেই তাদের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। খাবারের মধ্যে নেশাজাতীয় বা চেতনানাশক দ্রব্য মিশিয়ে মানুষকে অজ্ঞান করে অর্থ, ফোন, প্রয়োজনীয় মালামাল হাতিয়ে নেয়। অনেক সময় রাস্তার পাশে ছিনতাইকারীরা ওতপেতে থাকে। এর সবচেয়ে বেশি শিকার হন নারীরা।
এর বাইরেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে বাস বা ট্রেনের ছাদে যাতায়াত করেন। কখনো কখনো অতিরিক্ত গতি ও ফিটনেসের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। তাই যাত্রাপথে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত মার্চ মাসে সারাদেশে ৪৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৪ জন নিহত ও ১ হাজার ৯৭ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৮৮ জন নারী ও ৭৩ শিশু। ওই মাসে ৬টি নৌদুর্ঘটনায় ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪ জন। দুর্ঘটনার মধ্যে ৮৫টি (১৭.৪৮ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৪২টি (৪৯.৭৯ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১০৪টি (২১.৩৯ শতাংশ) পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দেওয়ার কারণে ঘটে। এ ছাড়া ৩৯টি (৮.০২ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৬টি (৩.২৯ শতাংশ) অন্য কারণে ঘটেছে।
এ ছাড়া অনেক চক্র আছে যারা জাল টিকিট বিক্রি করে, ভালো সিটের কথা বলে অনেক টাকা নেয় কিন্তু শেষে উঠিয়ে দেয় লক্কড়ঝক্কড় পরিবহনে। তাই এসব প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতে হবে। যাত্রাপথে অপরিচিত কারও দেওয়া খাবার বা পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। ট্রেন এবং বাসের অগ্রিম টিকিট বিক্রি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী বাসের ভাড়া নেওয়া হবে। ভাড়ার তালিকার বাইরে বাড়তি ভাড়া নেওয়া যাবে না। সব বাসমালিককে সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তার পরও বিভিন্নভাবে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের। অতীত অভিজ্ঞতা সেটিই বলে। এসব বিষয়েও সাবধান থাকতে হবে। পাশাপাশি সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ, ঈদ সামনে রেখে গাড়ির টিকিটের মূল্য যেন দ্বিগুণ করা না হয়। এ বিষয়ের ওপর বিবেচনা করে আগের ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
ঈদের আনন্দ আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক কর্মজীবী মানুষ ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহর থেকে পরিবার-পরিজনসহ গ্রামের বাড়িতে যান। কিন্তু নিরাপদে বাড়ি ফেরার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। যদিও পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণবঙ্গের মানুষের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। তার পরও এ সময় বিভিন্ন ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও নৌযান রঙ করে নতুনের মতো করে তোলা হয়। ফলে ক্রমেই বাড়ছে দুর্ঘটনা। যেহেতু যানবাহনে এখন বাড়ি ফেরার জন্য উপচেপড়া ভিড় থাকে। তাই ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ট্রেন ও বাড়তি বগি সংযোজন করার পরও অনেককে ট্রেনের ছাদে চড়ে বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। এ ছাড়া অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হলেই বেড়ে যায় কালোবাজারিদের তৎপরতা। ফলে সাধারণ যাত্রীদের গুনতে হয় তিন-চারগুণ বেশি ভাড়া। তার ওপর সহ্য করতে হয় যানজটের তীব্র যন্ত্রণা।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী সড়কপথে বাড়িতে যান এবং ফিরেও আসেন সড়কপথে। তাই যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সড়কপথে যেন ফিটনেসবিহীন বাস কেউ নামাতে না পারেন, সেদিকে নজর রাখতে হবে। এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, এমন কেউ যাতে বাস বা অন্য কোনো যানবাহন চালাতে না পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। কেউ যাতে রেষারেষি করে কিংবা প্রতিযোগিতা করে যানবাহন না চালায়, এ ব্যাপারে চালকদের সতর্ক করে দেওয়া জরুরি। যে যে স্থান থেকে যানবাহন ছাড়ে, সেখানে সাবধানতা গ্রহণ বিষয়ে বারবার মাইকিং করা দরকার। রাস্তা যেখানে খারাপ; সেখানে ধীরে যানবাহন চালাতে হবে। কেউ যাতে সড়কের পাশে হাটবাজার বসাতে না পারে। সেদিকেও স্থানীয় প্রশাসনকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
কেউ যাতে ট্রেনের ছাদে উঠতে না পারে বা ঝুলে যেতে না পারে, সেদিকে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। নদীপথে ঈদের এ সময় ফিটনেসবিহীন লঞ্চ যেন নামতে না পারে। যাত্রীরাও যদি একটু সতর্ক থাকেন, তা হলে ঈদযাত্রা হতে পারে নিরাপদ ও আনন্দময়। মনে রাখতে হবে, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি। একটু অসচেতনতার ফলে আমরা শুধু পৃথিবী ছেড়েই চলে যাই না বরং পথে বসতে হয় পরিবারকেও। হারিয়ে যায় পরিবারের হাসিমাখা মুখ। বাবা-মায়ের বুকফাঁটা আর্তনাদ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তাই সবকিছু ভেবেই সচেতনতার সঙ্গে বাড়ি ফেরা উচিত। সে ক্ষেত্রে সময় বাঁচাতে লাফ দিয়ে পরিবহনে ওঠা, অতিরিক্ত যাত্রীবাহী লঞ্চে যাত্রা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এক বছর অপেক্ষার পর আসা ঈদযাত্রা আমাদের জন্য নিরাপদ হোক। আনন্দময় হয়ে উঠুক। ঈদযাত্রায় সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সচেতনতার সঙ্গে মোকাবিল করে আনন্দ-উৎসব উপভোগ করার সামর্থ্য অর্জিত হোক। শুভ হোক আনন্দ যাত্রা। ঈদ বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ।