কাজিরবাজার ডেস্ক
আবারও বাড়ানো হয়েছে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। নতুন দাম ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ বিল মাস মার্চের টাকা এপ্রিল মাসে পরিশোধ করতে হবে। এ নিয়ে গত দুই মাসে তিন দফা খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়াল সরকার এবং প্রতিবারই ৫ শতাংশ করে বাড়িয়েছে।
প্রতিবারই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হলো। এর আগে সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগ পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেই সময় খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ দাম নির্ধারণ করা হয়। এর আগে ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
সর্বশেষ গতকাল আবারও ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ১৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৩৫, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা এবং ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর জন্য ৬ টাকা ৩১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর জন্য ৬ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৯৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা করা হয়েছে।
আবাসিক গ্রাহক ছাড়াও বেড়েছে সব ধরনের বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে কৃষি, ধর্মীয়, দাতব্য, হাসপাতাল, রাস্তার বাতি, পানির পাম্প, ক্ষুদ্র শিল্প, শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। শুধু বিদ্যুতের দাম নয়, এর আগে সরকারের নির্বাহী আদেশে এক দফা বাড়িয়েছে গ্যাসের দামও।
তিন দফায় গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম বাড়ল প্রায় ১৬ শতাংশ, পাইকারি বিদ্যুতের দাম ফিডারভেদে সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এরই মধ্যে ১৭ জানুয়ারি শিল্পকারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সব ধরনের মূল্যবৃদ্ধির দায় এখন মানুষের ওপর বর্তানো হচ্ছে। স্বল্প আয় ও সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চাপ। এ যেন বিদ্যুতের পাগলা ঘোড়া ছুটছেই। মানুষ সেই পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হাঁপিয়ে উঠছে। সর্বশেষ গতকাল বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত ১৪ বছরে ১২ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম।
দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি নিয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একটি বিশেষ আইন করেছে। ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রæত সরবরাহ বিশেষ আইন’- এই আইনের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিদ্যুতের ক্রয় প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করে, এই আইনের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া বিদ্যমান। যার কারণে বেশি ব্যয়ে কেনা কাটা, বেশি ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। যার দায়ভার মানুষের ওপর পড়ছে। তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসা উচিত।
এদিকে বারবার কেনা দাম বৃদ্ধি এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা অনেক আগেই বলেছি যে, ভুল পরিকল্পনা এবং নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ফলে বারবার দাম বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, এই দফাই শেষ নয়। এ দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন থেকে ক্ষমতা নিয়ে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানোকেও অন্যায্য ও অন্যায় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) সেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দাম বাড়ানো হতো, সেখানে নানা রকম অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত হতো। সব ক্ষেত্রে যে প্রতিপালন করা যেত, সেটি বলব না, তবে কিছুটা উন্নতি হচ্ছিল। সমাজের পিছিয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার চেষ্টা থাকত। মূল্যহার নির্ধারণে আর্থিক সক্ষমতা-অক্ষমতা বিবেচনা করা হতো। সেই জায়গাগুলো এখন নষ্ট হয়েছে। বিইআরসিকে এখন ক্লিনিক্যালি ডেড বলা যায়। এখন ধনী-গরিবের সমান হারে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
তবু সরকারের ভর্তুকি কমছে না : হঠাৎ করে কেন এত ঘন ঘন দাম বাড়ানো হচ্ছে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, দাম না বাড়িয়ে সরকারের কোনো উপায় নেই। অর্থ সংকটে এলসি খোলা যাচ্ছে না। আইমএমএফের পরামর্শ রয়েছে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার। তিনি বলেন, বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। গ্যাস খাতেও রয়েছে বিশাল পরিমাণ ভর্তুকি। সরকার বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়েই চলছে। তবে এখন আর ভর্তুকি দিয়ে চালানোর মতো আর্থিক অবস্থা নেই। তিনি বলেন, আপাতত মনে হচ্ছে- সমন্বয় মানে কেবল দাম বাড়ছে। কিন্তু বিষয়টি এমন হবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের দাম কমলে দেশের বাজারেও তখন কমানো হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে। তবে ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে ব্যবসায়ীরা মতামত দিয়েছে দাম বাড়িয়ে হলেও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে। তিনি বলেন, সরকারের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ হলো দাম বাড়ানোর পর সরবরাহ নিশ্চিত করা।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুটি বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, এখনো লোকসানে থাকবে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। সর্বশেষ পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলো লোকসানে ছিল। আরও অন্তত ২ শতাংশ দাম বাড়ানো হলে বিতরণ কোম্পানিগুলো ব্রেক ইভেন পয়েন্টে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা লাভ করতে পারবে।