হবিগঞ্জে মারাত্মকভাবে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা

35

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
সিলেটের হবিগঞ্জে কোথাও না কোথাও প্রতিদিন ঘটেই চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। এসব সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী ও যাত্রীদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। এছাড়া একটি সড়ক দুর্ঘটনা একটি পরিবারের মাঝে সারা জীবনের কান্না হয়ে থাকে। এতে প্রশাসনিকভাবে জোরালোভাবে কোন পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। চালকের অসচেতনতা, গাড়ী চালাতে নেই নিয়ন্ত্রণ, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ী চালানো ও পথচারীদের অসচেতনার কারনেই ঘটছে এসব সড়ক দুর্ঘটনা। তবে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনটি সড়কে দুর্ঘটনা নির্মূল করতে প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা ও পাড়া-মহল্লায় কাজ করে যাচ্ছে।
২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় এগিয়ে রয়েছে হবিগঞ্জ। গত ১৫ দিনে হবিগঞ্জ জেলায় ৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধসহ ৭ জন নিহত ও পুলিশ, শিশুসহ আহত হয়েছেন অনেক। এর মধ্যে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ৭ জানুয়ারী হবিগঞ্জের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাধবপুর শাহপুর নামক স্থানে পাথর বোঝাই ট্রাকের সাথে মাইক্রোবাস ও পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় একই পরিবারের ৪ জনসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকা ঘেটে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল শনিবার ১৪ জানুয়ারী ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বাসচাপায় শাহিদা বেগম (৫৩) নামে এক নারী নিহত হয়েছেন। সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় দেবপাড়া ইউনিয়নের আইনগাঁও এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। শাহিদা বেগম দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট গ্রামের আব্দুর নুরের স্ত্রী।
১২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় সামনে থাকা একটি মিনি ট্রাককে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে একটি মাইক্রোবাস। এতে মাইক্রোবাসের এক যাত্রী নিহত হয়েছেন। সকালে মাধবপুর উপজেলার শাহজিবাজার এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম আব্দুল মালেক (৩৫)। তিনি শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার সুদিয়াখলা গ্রামের শুকুর আলীর ছেলে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মিনি ট্রাকটি ঢাকা থেকে সিলেটের দিকে যাচ্ছিল। শাহজিবাজার এলাকায় যাত্রীবাহী একটি মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাকটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে মাইক্রোবাসের কয়েকজন আহত হলে তাদের উদ্ধার করে হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ৭টায় আব্দুল মালেক মারা যান। শায়েস্তাগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইনুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি পুলিশ জব্দ করেছে। মরদেহটি হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে রয়েছে।
৮ জানুয়ারী রবিবার সকালে হবিগঞ্জ শায়েস্তাগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের সুদিয়াখলা এলাকায় বাস নিয়ন্ত্রন হারিয়ে খাদে পড়ে নারী পুরুষসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপতালে প্রেরণ করে। স্থানীয়রা জানান, হবিগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাওয়া সিলেটগামী বিরতিহীন এক্সপ্রেস বাসটি সুদিয়াখলা এলাকায় পৌছলে একটি অটোরিক্সাকে ওভারটেক করার সময় বাসটি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা লাগে। এসময় বাসটির সামনের অংশ দুমড়ে মুছড়ে যায়। তাৎক্ষণিক স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। গুরুতর আহত অবস্থায় মোঃ মুছা মিয়া (৪৮), মামুনুর রশিদ (৫০), আব্দুল আহাদ (৫৪), অসীম মিয়া (৪০), ইসতেহার চৌধুরী (৩২), আসাদুজ্জামান মিয়া (৩৪), রিয়া আক্তার (২৩), আব্দুল্লাহ মিয়া (৩৫), মনফুর মিয়া (৫০), প্রদীপ দাস (৪০), রুহুল আমিন (৫), নাসির উদ্দিন (৩৫), উওম কুমার (৪৮), প্রান্ত সূত্রধর (১৮), নির্মল ভট্রাচার্য (১৮), তানজিল আহমেদ (১৮) ও কতুব উদ্দিন (৪৪) কে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ বিষয়ে শায়েস্তাগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মোরশেদ আলম দুর্ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আহতদের হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তারা সবাই শঙ্কামুক্ত রয়েছে।
৭ জানুয়ারী শনিবার ভোর ৪টার দিকে হবিগঞ্জের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাধবপুর শাহপুর নামক স্থানে পাথর বোঝাই ট্রাকের সাথে মাইক্রোবাস ও পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় একই পরিবারের ৪ জনসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হন আরও অন্তত ৩ জন। জানা যায়, ঘন কুয়াশার মধ্যে ঢাকা থেকে বিদেশ ফেরত যাত্রী নিয়ে একটি মাইক্রোবাস মৌলভীবাজার কুলাউড়া যাবার পথে ভোর ৪টার সময় শাহপুর নামক স্থানে এসে পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পাথর বোঝাই ট্রাকের সাথে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। একই সময় দ্রুতগতির একটি পিকআপ ভ্যান মাইক্রোবাসের পেছনে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ৩ জন নিহত হয় ও আহত হয় আরও ৬ জন। পরে তাদের সিলেট নিয়ে গেলে সেখানে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে শায়েস্তাগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের উদ্ধার করে সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজে পাঠালে সেখানে আরও দুজন মারা যায় বলে জানান নিহতের স্বজনরা। নিহতদের মধ্যে চারজন একই পরিবারের। তারা হলেন- মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার মাদানগর গ্রামের আতিকুর রহমান শিহাব (১২), মালয়েশিয়া প্রবাসী আব্দুস সালাম (৩৫), সাফিয়া বেগম (২৫), এক শিশু হাবিবা ও মাইক্রোবাস চালক কুলাউড়ার কমলাছিলা গ্রামের ছাদির আলী। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শায়েস্তাগঞ্জ হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মইনুল ইসলাম ভূইয়া।
৪ জানুয়ারী মঙ্গলবার হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কেড়ে নিল এক শিশুর পা। আহত শিশু সুমাইয়া জান্নাত (৫) উপজেলার ৯ নম্বর রানীগাঁও ইউপির (১ নম্বর ওয়ার্ড) গাভীগাও গ্রামের রিকশাচালক আইয়ুব আলীর মেয়ে। সে গাভীগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণীর ছাত্রী। জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরে বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে অটোরিকশা চালিত একটি সিএনজি শিশু শিক্ষার্থী সুমাইয়া জান্নাতের পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় সুমাইয়া জান্নাতকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। পরে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল রেফার করা হয়। শিশুটির বাবা আইয়ুব আলী বলেন, তার মেয়ে সুমাইয়া জান্নাতের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন।
২ জানুয়ারী সোমবার ঢাকা সিলেট মহাসড়কের হবিগঞ্জের মাধবপুরে পুলিশের ভ্যানে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় ৪ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে উপজেলার বেজুড়া ব্রীজের কাছে এ দূর্ঘটনা ঘটে। আহত পুলিশ সদস্য আবুল হোসেন, টিটু বর্ণম, সুজন দাশ ও মাসুম আহমেদকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। মাধবপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার নির্মলেন্দু চক্রবর্তীসহ তার দেহ রক্ষি টিটু বর্মন (২৩), কনস্টেবল সুজন দাস (২৫), মাসুম আহম্মদ (২৬) ও আবুল হোসেন (৪৩) আহত হয়েছেন। জানা যায়, চুনারুঘাট-মাধবপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার নির্মলেন্দু চক্রবর্তী সরকারি কাজে হবিগঞ্জ যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে বেজুড়া ব্রীজ এলাকায় পৌছলে ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাস পুলিশের পিকআপ ভ্যানটিকে ধাক্কা দেয়। এতে পুলিশের পিকআপটি উল্টে যায়। আহত হন ৪ পুলিশ সদস্য। পরে স্থানীয়রা এসে তাদেরকে উদ্ধার করে।
মাধবপুর থানার (ওসি) মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, সহকারী পুলিশ সুপার নির্মলেন্দু চক্রবর্তী গাড়িতে থাকলেও তিনি তেমন আহত হননি। অপর আহত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তারা শঙ্কামুক্ত। তবে সবাই অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন।
এদিকে, বিদায়ী বছরে (২০২২ সালে) সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। ফেলে আসা বছরটিতে সিলেট বিভাগে মোট ২৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৩৭ জন এবং ৪৩৫ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ১৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪৬ জন নিহত ও ২৪৮ জন আহত হয়েছেন।