কাজিরবাজার ডেস্ক :
১৯৭১ সালের এদিন মুক্তির সংগ্রামে উত্তাল ছিল বাংলার মাটি। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। আর অপ্রতিরোধ্য বাঙালির বিজয়ের পথে পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে।
বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল লড়াইয়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে থাকে। আর অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনেক মুক্তাঞ্চলের সৃষ্টি হয়। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড়ে রিংয়ের আকারে প্রথম ও দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইন তৈরি করেছিল। মুজিব ব্যাটারির যোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে পঞ্চগড় আক্রমণ করায় তারা পঞ্চগড় ছেড়ে চলে যায়।
এদিনে চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান তাদের দখলে আনতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর চারদিক থেকে আক্রমণ করে ২৭ হানাদারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এখান থেকে বেশকিছু গোলাবারুদও উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী। এদিকে আখাউড়া, পঞ্চগড়, ভুরুঙ্গামারী, কমলাপুর, বনতারা, শমশেরনগর ও পার্বত্য চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে হনাদার বাহিনী পিছু হটে যায়। এতে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন লে. মাসুদ, সুবেদার খালেক, লে. মতিন, মেজর সদরুদ্দিন ও ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার।
এদিকে বোমা বিস্ফোরণে ঢাকার রামপুরা বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের পাঁচটি বিদ্যুৎ সাব স্টেশন ও দু’টি পেট্রোল পাম্প বিধ্বস্ত হয়। আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলেও হানাদার বাহিনী তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠে মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এ আক্রমণে মুক্তিবাহিনী পুনরায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তিন দিক থেকে শত্রুকে আক্রমণ করলে হানাদার বাহিনী আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যায়।
অন্যদিকে ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের কর্মিসভায় বলেন, সময় বদলেছে, তিন-চার হাজার মাইল দূর থেকে বর্ণের প্রাধান্য দিয়ে তাদের (পাকিস্তান) ইচ্ছামতো হুকুমনামা জানাবেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। ভারত আর ন্যাটিভ রাজ্য নয়। আজ আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য দেশের সর্বোচ্চ প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করব, ওই সব বৃহৎ দেশগুলোর ইচ্ছানুযায়ী নয়। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বরের স্মৃতি থেকে রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক সারাবাংলাকে বলেন, ‘২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম একজন লেফটেন্যান্ট এবং দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির অধিনায়ক। আমাদের পুরো ব্যাটেলিয়ান পহেলা ডিসেম্বর প্রত্যুষে আখাউড়া শহরের উত্তরাংশে অবস্থান নিয়েছিল দক্ষিণ দিকে মুখ করে। আমাদের লক্ষ্য ছিল আখাউড়াকে মুক্ত করা। আমরা একলা ছিলাম না এ যুদ্ধে। পূর্ব দিকে ছিল তিন নম্বর সেক্টরের সৈনিকরা, দক্ষিণ দিকে ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈনিকরা।’
তিনি বলেন, ‘আখাউড়াকে তিন দিক থেকে চাপ দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা যুদ্ধ করছিলাম। আমরা ইঞ্চি ইঞ্চি করে আগাচ্ছিলাম, আমরা কদমে কদমে আগাচ্ছিলাম। পরীখা খনন করে কিছুদূর আগাই, আবার পরীখা খনন করছিলাম। দিনে রাতে ২০/২৫ বার শত্রুপক্ষের শেলিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছিলাম। আবার আমাদের পক্ষে মিত্র বাহিনীও ওলন্দাজ আর্টিলারী শেলিং করে যাচ্ছিল।’
স্মৃতি ঝাঁপি থেকে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘দিন রাত অনিয়মিতভাবে পূর্ব নির্ধারিত সময় ছাড়াই আখাউড়াতে পাকিস্তানি যে হানাদার বাহিনী ছিল, তাদের মধ্যে এবং আমাদের মধ্যে প্রচণ্ড গোলা বিনিময় হচ্ছিল, যাকে সামরিক পরিভাষায় বলা হয় ‘এক্সেঞ্জ অব স্মল আর্মস ফায়ার’। এর মধ্যে আমরা সারাদিন অতিবাহিত করেছি ২ তারিখ। চার তারিখ রাত ছিল আমাদের চূড়ান্ত সংগ্রামের। পাঁচ তারিখ ভোরে তারা আত্মসমর্পণ করেছিল। তিন দিকের চাপে, যুদ্ধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল পেট্রুম খান, তিনি আত্ম সমর্পণ করেছিলেন। কিছু সংখ্যক সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিলেন, কিছু সংখ্যক সৈন্য মারা গিয়েছিল আমাদের গোলা-গুলিতে, কিছু সৈন্য পলায়ন করেছিল আখাউড়া থেকে রেললাইন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে। কিছু সৈন্য তিতাস নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মারা গিয়েছিল।’
‘আমি ওই দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আমরা সঙ্গী-সাথীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। স্থানীয় জনগণ আমাদের যে সহায়তা করতেন, তাদের কথা মনে করছি,’Í বলেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক।