কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেরিতে টেন্ডার ও চলমান বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই দেওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা অনেকটাই কাটতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রেসগুলোতে বই ছাপা শুরু হয়েছে। এর ফলে জানুয়ারির এক তারিখে উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ ভাগ করে দেওয়া ও অধিকাংশ প্রেস আধুনিক হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে বই ছাপার কাজ সম্পন্ন হবে। এছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমানকেও প্রেসগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
জাতীয় কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, এবার পিছিয়ে আমরা শুরু করেছি। এটা সত্য। গত বছর এই সময় অনেক বই ছাপা হয়ে বিভিন্ন জেলায় চলে গেছে। সেখানে আমরা মাত্র শুরু করেছি। এবার ৬০ দিনের মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। যে কারণে এককভাবে কাউকেই বেশি বইয়ের অর্ডার দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ৮ম ও ৯ম শ্রেণির বই ছাপা নিয়ে এখনো আশাবাদী আমরা। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপার জন্য প্রস্তুত। এর জন্য ৫০ দিনের সময় দিয়েছি ঠিকাদারদের। এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়। তবে সব বই একদিনেই শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় না। মাসব্যাপী চলে এ কার্যক্রম। এবারও তার কোন ব্যত্যয় ঘটবে না বলে দাবি করেন তিনি।
দেশে ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দিয়ে আসছে সরকার। আগামী বছরের জন্য প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিকে প্রায় ১০ কোটি ও মাধ্যমিকে বই ছাপা হবে প্রায় ২৫ কোটি। এবার প্রাথমিক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার চার ভাগে করা হয়েছে। সেকেন্ডারিতে একটি হলো ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি, অন্যটি বাকি শ্রেণির বই। প্রাথমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এক ভাগ। অন্যটি তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই। প্রায় সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চার জায়গা থেকেই কম-বেশি কাজ পেয়েছে। তবে এবার এনসিটিবি স্বচ্ছতা ও ক্যাপাসিটি বিবেচনায় কাজ দিয়েছে। এবার বইয়ের মান ও কাজ প্রদানেও স্বচ্ছতা হয়েছে। টেন্ডার ডিস্ট্রিবিউশন গত যে কোন সময়ের তুলনায় স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়েছে বলে জানান বই প্রস্তুতকারী ঠিকাদাররা।
জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমের ৬ষ্ঠ শ্রেণির বই সম্পূর্ণ তৈরি। সপ্তম শ্রেণির বইয়ের জন্য শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনি কিছু অবজারভেশন দিয়েছেন। অবজারভেশনের প্রুফের কাজ চলছে। সপ্তম শ্রেণির বই বুক ফরমেটে তৈরি আছে। কিন্তু সংশোধনীগুলো পিডিএফ ফর্মে। অন্য ফরমেটে যথাযথ করে টাইপ করা গেলেও আবার বুক ফরমেটে ফিরিয়ে আনতে হয়। এনসিটিবি কর্মকর্তারা এই জন্য বুক ফরমেটেই কাজ করছেন। কাজ শেষে নতুন শিক্ষাক্রমের বই রবিবার থেকে ছাপা শুরু হয়েছে। বইয়ের উজ্জ্বলতা বাড়াতে প্রয়োজন হয় পাল্প। কিন্তু এবার পর্যাপ্ত পাল্পও দেশে নেই।
পাল্প না থাকার কারণে বইয়ের উজ্জ্বলতা কিছু কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি স্তরে ৮০ জিএসএম (গ্রাম-স্কয়ার-মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা থাকতে হয়। মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান বইয়ে ৭০ জিএসএম ও অন্য শ্রেণির জন্য ৬০ জিএসএম কাগজ ব্যবহারের নির্দেশনা আছে। বইয়ের যে মলাট তার কাগজের মান হবে ২৩০ জিএসএম। এবার মাধ্যমিক স্তরে ২৮০টি লটে অষ্টম, নবম শ্রেণি, দাখিল এবং কারিগরি স্তরে ১২ কোটি ৫১ লাখের বেশি বই ছাপা হবে। এসব লটের জন্য ৬০-৭০ দিন বই ছাপার কাজের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এনসিটিবির ধারণা অনুযায়ী ওই ২৮০টি লটের বই ছাপাতে ও দেশব্যাপী সরবরাহ করতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে ৪০ দিন, ৫০ দিন পরে এক একটি ওয়ার্ক ওর্ডার হতো। এবার সবগুলো ওয়ার্ক ওর্ডার একসঙ্গে শুরু হয়েছে। যেকারণে কাগজের চাহিদা বেড়েছে। আর বিদ্যুৎ সংকটের কারণে প্রেস চালাতে শুরু হয়েছে নতুন বিড়ম্বনা। তারা বলেন, লোডশেডিংয়ের মধ্যে প্রেস চালাতে গেলে প্রতিদিন ২০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকার ডিজেল লাগতে পারে। এই ডিজেল কিনে কাজ করলে প্রিন্টিং ব্যয় কমানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে ওয়ার্কিং আওয়ারে বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রমিকদের অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে বাড়তি কাজ করাতে হচ্ছে। ফলে প্রডাকশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কাগজ নিয়েও সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাগজের মিলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু আমরা একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বিদেশ থেকে আমাদের শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ দিলে অনেক ভাল হতো। বার বার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বই ছাপাতে বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ গেলেই কালি লেপ্টে যায়। নতুন করে মেশিন চালু করার পর কালির সমস্যা থাকে। এর ফলে কাগজ নষ্ট হচ্ছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, আমরা বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তিনি মাতুয়াইল এলাকার প্রেসগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। এছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বিদ্যুৎ সচিবকে প্রেস এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুরোধ করেছেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা কম থাকায় আশা করা যাচ্ছে নির্বিঘ্নে বই ছাপার কাজ করা যাবে।
আশার কথা হচ্ছে এ বছর শিট মেশিনে বই ছাপার কাজ দেয়নি এনসিটিবি। বই ছাপার কাজ ওয়েব মেশিনে করা হচ্ছে। রোল কাগজ কেটে শিট মেশিনে কাজ করতে ২-৩ হাজার টাকা খরচ বাড়ে। শিট মেশিনের তুলনায় ওয়েব মেশিনে ঘণ্টায় তিন-চারগুণ বেশি প্রোডাকশন হয়। আগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৯৬ দিন সময় দেওয়া হলেও এবার ক্ষেত্র বিশেষে ৬০-৭০ দিন সময় পেয়েছেন ঠিকাদাররা। এই সময়েও সব বই ছাপা শেষ করা সম্ভব। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, আগে যে প্রেসটির একটিও ওয়েব মেশিন ছিল না এখন দেখা যাচ্ছে সেটার তিনটি ওয়েব মেশিন আছে। শিট মেশিনের তুলনায় ওয়েব মেশিনে অনেক দ্রুত প্রিন্টিং হয়। এখন শিট মেশিনের সংখ্যা কমেছে, ওয়েব মেশিনের সংখ্যা বেড়েছে। এর কারণে আশা করা যায় ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ হবে। এছাড়াও প্রেসের ছাপানোর সক্ষমতা অনুসারেই ঠিকাদারি কাজ দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে নির্ধারিত সময়ে বই ছাপা নিয়ে আমরাও আশঙ্কায় ছিলাম। তবে সেটি এখন আর নেই। এরই মধ্যে বইয়ের ডেলিভারি শুরু হয়ে গেছে।