মৌলভীবাজারে ৩৮টি প্রকল্পের ৮৮ লাখ টাকা হরিলুট

26

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অতিদরিদ্রদের কর্মস্থান কর্মসূচী (ইজিপিপি) প্রকল্পে ২০২১-২২ অর্থ বছরের দ্বিতীয় পর্যায়ের ৪০ দিনের কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
৩৮টি প্রকল্পের মধ্য ৫/৭টি প্রকল্পে নামমাত্র মাটি ফেলে বাকী প্রকল্পের কাজ কাগজে কলমে শতভাগ বাস্তবায়ন দেখিয়ে ৮৮ লাখ টাকা নানা কায়দায় লুটপাট করেছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা-ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিরা।
বাস্তবে প্রকল্পের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান ও প্রকল্প সভাপতি এবং পিআইও যোগসাজসে নিজেরাই রকেট একাউন্ট করে শ্রমিকদের টাকা উত্তোলন করে লোপাট করেছেন বলে অনুসন্ধানে উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৩৮টি প্রকল্পের অধিকাংশ ঘুরে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মস্থান কর্মসূচির আওতায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও জুড়ি উপজেলায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থপনা অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। তার অংশ হিসাবে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিদপ্তরের উদ্যোগে দ্বিতীয় পর্যায়ে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে আওতায় মির্জাপুর ইউনিয়নে ৪টি প্রকল্প ব্যয় ৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা, ভূনবীর ইউনিয়নে ৪টি প্রকল্প ব্যয় ৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্প ১২ লাখ ২১০০০ হাজার টাকা, সিন্দুরখান ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্প ব্যয় ৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা, কালাপুর ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্প ব্যয় ১৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, আশিদ্রোন ইউনিয়নে ৫টি ১১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, রাজঘাট ইউনিয়নে ৪টি প্রকল্পে ব্যয় ৯ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, কালিঘাট ইউনিয়ে ৪টি প্রকল্পে ব্যয় ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা ও সাতগাঁও ইউনিয়নে ২টি প্রকল্পে ৪ লাখ ৪২ হাজার টাকাসহ মোট ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৮টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কাগজ কলমে বাস্তবায়িত মাটির কাজের ৩৮টি প্রকল্পের বরাদ্দের অনুপাতে ২৫/ ৩০ জন করে মোট ১০৯৭ জন শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারে শর্তমতে প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতি এলাকার দিনমজুর, বেকার, কর্মহীন নারী পুরুষরা শ্রমিক হিসাবে তালিকাভুক্ত হবেন এবং তারা ৪০ দিন টানা কাজ করবেন। জনপ্রতি পাবেন ৪০০ টাকা করে। এতে একজন শ্রমিক মোট পাবেন ১৬ হাজার টাকা। প্রকল্পের শ্রমিকদের টাকা রকেট বা বিকাশ একাউন্ট খুলে তার মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। কিন্তু শ্রীমঙ্গল উপজেলায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ৪০ দিনের মধ্য ২০ দিনের কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা ব্যাপক লুটপাটের করেছেন সংশ্লিষ্টরা এমন অভিযোগ রয়েছে।
প্রকল্প সভাপতি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও উপ সহকারী প্রকৌশলীর যোগসাজসে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে ৩৮টি প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়েছেন।
সরেজমিনে ২/৩টি প্রকল্পের অস্তিত পাওয়া গেলেও সেখানে নামমাত্র মাটি ফেলে কাজ সমাপ্ত দেখানো হয়েছে।
প্রকল্প সভাপতিরা কাগজ কলমে ২০/২৫ জন করে শ্রমিক দেখালেও বাস্তবে তালিকার শ্রমিকরা কাজ না করিয়ে নিজস্ব মানুষ দিয়ে মাটির কাজ করিয়েছেন এমন তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু শ্রমিক নিয়োগে অনিয়ম নয় বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অস্তিত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজ না করেই সংশ্লিষ্টরা ৩০টি প্রকল্পের পুরো অর্থই শ্রমিকদের রকেট একাউন্টের সিম হাতে নিয়ে সুকৌশলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
একই অর্থ বছরে ২৭টি প্রকল্পের কাজ সরেজমিনে পরিদর্শন করে কাজের গুণগত মান কিছুটা পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের উত্তোলিত ২০ দিনের টাকা ভেতরে ১৪ দিনই বৃষ্টি ছিলো।
বরাদ্ধের দ্বিতীয় পর্য়ায়ে ৪০ দিনের ২০ দিনের টাকা সরকারের কোষাগারে চলে গেলেও শেষ ২০ দিনের বরাদ্দের টাকা মাটির কাজ না করেই বৃষ্টিপাতের সুযোগ নিয়ে জুন মাসে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামের যোগসাজশে ইউপি চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প সভাপতিরা প্রায় ৮৮ লাখ টাকা লুটে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও সরজমিনে ঘুরে জানা গেছে, অতি উৎসাহী হয়ে চেয়ারম্যান ও পরিষদের সদস্যরা তাদের অনুসারীদের দিয়ে ইউনিয়ন ব্যাপী শ্রমিকদের তালিকা করান। পরে তা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাখিল করা হয়। এতে গোটা উপজেলায় ১০৯৭ জন শ্রমিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গড় হিসাবে প্রতিটি ইউনিয়নে প্রকল্পের বিপরীতে ২০/৩০ জন শ্রমিক কাগজপত্রে নিয়োগ দেখানো হয়। কাগজ কলমে বাস্তবায়িত প্রকল্পের তালিকার বাহির থেকে ১০/১২ শ্রমিক দিয়ে ৫/৬টি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করানো হয়। ইউনিয়নের গ্রহণকৃত প্রকল্পের শ্রমিকের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা প্রকল্পের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে অভিযোগও রয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পের বাস্তবে কোন শ্রমিক কাজ করেননি, কিন্তু ব্যাংক হিসাবে শ্রমিকের নাম ব্যবহার হচ্ছে ঠিকই। শ্রমিকের নামে রকেট একাউন্ট থাকলেও টাকা তুলেছেন প্রকল্প সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যানরা।
সরেজমিনে তালিকার ২৬নং আশিদ্রোন ইউনিয়নের রামনগর মন্তাজ মিয়া বাড়ির সামনা হতে মালেক মিয়ার জায়গার পাশ পর্যন্ত পুন:নির্মাণ প্রকল্পটির কোন অস্তিত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে রাস্তায় কোন মাটির কাজ হয়নি বলে স্থানীয়রা জানান। রাস্তায় এক টুকরি মাটি পড়েনি। এ প্রকল্প ব্যয় ধরা আছে ৪ লাখ টাকা। শ্রমিকের সংখ্যা ২৫জন। পুরো টাকা পকেটে ভরেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাস্তবায়িত তালিকার ৩৬নং জাগছড়া চা বাগানের ৫নং বস্তির রাস্তা নোয়াগাও সীমানা পর্যন্ত রাস্তা পুন:নির্মাণ প্রকল্পের কোন অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা কাজ কোথায় হয়েছে তা বলতে পারেন না। তাছাড়াও ১২নং প্রকল্প শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের রুপসপুর মোস্তফা মিয়ার বাড়ির সামনা হতে এবাদ মিয়ার বাড়ির সামনা পর্যন্ত রাস্তা নির্মান, ১০নং, প্রকল্প রুপসপুর সবুজবাগ জোড়া পুল হতে সামসুল উদ্দিন এর বাসা পর্যন্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ, ৩নং প্রকল্প মির্জাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পচাউন গ্রামের শফিক মিয়ার জমি হতে হাইল হাওর রাস্তা পুন:নির্মাণ, ৩৮নং প্রকল্প সাতগাঁও ইউনিয়নের সাতগাঁও ইছামতি চা বাগান খেলার মাঠরও পাশ্ববর্তী রাস্তা পুন:নির্মাণ, ৩৪নং প্রকল্প কালিঘাট ইউনিয়নের বুরবুড়িয়া চা বাগানের শশ্মানঘাটে মাটি ভরাট ও রাস্তা পুননির্মাণ, ২২নং প্রকল্প কালাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম বরুনা আবু বক্কর এর বাড়ি হতে মকবুল মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুন:নির্মাণ, ২৩নং প্রকল্প নারায়নছড়া মনাই মিয়ার বাড়ি হইতে পশ্চিম জৈনকা নদী পর্যন্ত খাল পুন:খনন কাজের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এভাবেই কাগজপত্রে ৩৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে সরকারের প্রায় ৮৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যে কয়েকটি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ হয়েছে আর তাদের ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন প্রকল্প সভাপতিরাও। সরেজমিনে রাজঘাট ইউনিয়নের ফুসকুঁিড় চা বাগান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট কাজটিও অনিয়ম করা হয়েছে। ৫/৭ জন শ্রমিক দিয়ে মাটির কাজ করিয়েছেন প্রকল্প সভাপতি। মাটি কাটার মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখের রাস্তার বাম দিকে কিছু মাটি ভরাট করা হলেও অভিযোগ উঠেছে যে পরিমাণ মাটি দেয়ার কথা সেখানে তা দেয়া হয়নি। আলাপ হয় স্থানীয় চা শ্রমিক অমিত বুনার্জীও সাথে। তিনি বলেন, মাটির কাজ মেশিন দিয়ে করা হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক ২/৩ দিন কাজ করেছেন তবে মাটি আরো দেয়া উচিত ছিল। এখানে দেড় লাখ হতে দুই লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
কালিঘাট ইউনিয়নের তালিকা ভুক্ত ৩৩নং কালিঘাট সাধুবাবুর বাড়ির সামনা হতে শিববাড়ি কালিমন্দির রাস্তায় মাটি কাটা প্রকল্পের ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। সাধুবাবুর বাড়ি সামনা বলা হলের কাজ ধরা হয়েছে একটি ফুডকালভার্ট থেকে। তাও বৃষ্টির দিনে কাজ করানো হয়। রাস্তার মধ্যেখানে মাটি দেয়া হয়। এখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
স্থানীয়দের সাথে আলাপ কালে জানা যায়, স্থানীয় মেম্বার রনজিতের মাধ্যমে তার ভাই কাজ করিয়েছেন। মাত্র ৫দিন কাজ হয়েছে। তালিকাভুক্ত কোন শ্রমিক ছিল না। তাদের পছন্দের কিছু নারী ও পুরুষ চা শ্রমিক দিয়ে মজুরী ২৫০ টাকা হতে ২০০ টাকা প্রদান করেছেন। রাস্তায় কাজ করা শ্রমিক শিপন রাজভর বলেন, তারা কোন তালিকাভুক্ত শ্রমিক নন। একটি খাতায় হাজিরা দিয়ে টাকা নিতো। পাঁচদিন কাজ করেছেন। প্রতিদিন ২৫০ টাকা দেয়া হয়েছে। একই কথা জানান আরেক নারী চা শ্রমিক বর্ষা তাঁতি। কোন রকেট বা বিকাশ ছিল না। হাতে টাকা দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রকল্প সভাপতি জানান, পিআইও ও চেয়ারম্যানরা যেভাবে বলছে, সেভাবেই কাজ করেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসকে ম্যানেজ করেই টাকা উত্তোলণ করা হয়েছে। তবে ৫০ ভাগ কাজ হয়নি বলে তাঁরা স্বীকার করেন।
কাজের অনিয়ম নিয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল সাতগাঁও ইউনিয়নের চেযারম্যান দেবাশীষ দেব রাখু বলেন, একটা কাজে আমি খুবই ব্যস্ত। শহরে দেখা করে কথা বলতেছি।’
জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো.তরিকুল ইসলাম বলেন, একসাথে এতটি কাজ একজনের পক্ষে দেখা সম্ভব না। তারপরও বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছি, দেখলাম তারা কাজ করছে,আবার কোনো কোনো এলাকায় চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা কাজের ছবিও দিয়েছেন। ছবিতে দেখলাম কাজ হয়েছে। তিনি আরও বলেন,কেউ যদি কাজ না করিয়ে বিল উত্তোলণ করতে পারবে না। ’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলো না । খোঁজ নিয়ে বিষয়টি জানাবো।
মৌলভীবাজার জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছাদু মিয়া বলেন, প্রকল্পের লিস্টেট শ্রমিকরা কাজ করবে। এই বাহিরে কাজ করার কোন নিয়ম নাই। ওই শ্রমিকরা তাদের রকেট একাউন্টে সরাসরি টাকা আসে। তবে ব্যস্তবে লিস্টেট শ্রমিক ছাড়া অন্য শ্রমিককে দিয়ে কাজ করানোর অভিযোগ, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ার সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নাই। কাজ আমি দেখতে পারি। তবে টাকা-পয়সার সাথে আমার কোন হাত নাই। সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনও এবং পিআইও বিল করে ঢাকা পাঠায়। সেখান থেকে শ্রমিকের রকেট একাউন্টে টাকা ঢুকে। এক কথায় এসব ব্যাপারে আমার কোন সম্পর্ক নাই। কাজে অনিয়মের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা।’