পাইকারি পর্যায়ে এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ছে

21

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্বজুড়ে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার কারণে তেল বা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদনে লোকসান বাড়ছে প্রতিদিন। এতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। গত রবিবার এক চিঠিতে এত পরিমাণ ভর্তুকি দিতে আপত্তি জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ বিভাগকে বিদ্যুতের দাম বাড়াতেও বলা হয়েছে ওই চিঠিতে। একইসঙ্গে শেষ হতে যাচ্ছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানির পর নির্ধারিত তিন মাস সময়ও।
সব মিলিয়ে এ সপ্তাহেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে স্বস্তি গ্রাহক পর্যায়ে নয় বরং পাইকারি পর্যায়েই বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। যা ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)’র কাছ থেকে যেসব বিতরণ সংস্থা বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের পর্যায়ে সরবরাহ করে তাদেরই গুণতে হবে এ বাড়তি মূল্য।
গত ১৮ মে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে গণশুনানি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিদ্যুতের একক ক্রেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে এ গণশুনানি করা হয়। গ্যাসের তৎকালীন মূল্য ধরে পিডিবি তার প্রস্তাবে প্রতি ইউনিটের দাম ৬৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করে। গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ৯ দশমিক ১৪ টাকা এবং ১২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ৯ দশমিক ২৭ টাকা করার প্রস্তাব করে পিডিবি।
এর আগে বিইআরসি সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দাম ইউনিটপ্রতি ৫ দশমিক ১৭ টাকা নির্ধারণ করে। যেহেতু প্রতি দুই বছরে বিদ্যুতের দামের একটা সমন্বয় বিইআরসি করেই থাকে আর শুনানিরও পরে ৯০ দিন ইতোমধ্যে শেষ হতে যাচ্ছে আগামী ১৩ অক্টোবর। তাই দাম বাড়ানোর ঘোষণা খুব শীঘ্রই আসতে পারে জানিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ। সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে।
ফলে আমাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ও বরাদ্দ কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য বলছে। আর গত ২ বছরে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় হয়নি। তাই দাম বাড়বে। তবে তা ১০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত না বলে আমি মনে করি।
বিপিডিবি বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার আবেদন করে। বিপিডিবির এই প্রস্তাব গ্যাসের আগের দর ইউনিট প্রতি ৪.৪৫ টাকা বিবেচনায়। ওই প্রস্তাবের পর ইউনিট প্রতি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি হয়েছে ৫৭ পয়সা করে। বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি ভর্তুকি ছাড়া ৮.১৬ টাকা করার মতামত দেয়। বিপিডিবির পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়, চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে। বিপিডিবি বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা। ৫টি বিতরণ কোম্পানির কাছে পাইকারি দরে বিক্রির পাশাপাশি নিজে ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহরাঞ্চলে বিতরণ করে যাচ্ছে।
বিদ্যুতের নতুন দামের বিষয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, বিইআরসি আইন অনুযায়ী গণশুনানির পর ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে আদেশ দেয়ার আইনী বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা একটি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে এনেছি। সরকারের কিছু নীতি সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে, বিশেষ করে ভর্তুকি ইস্যু। তবে দাম বৃদ্ধি হলেও সামান্য পরিমাণে হবে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আগামী দিনগুলোতে যে চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবেলার জন্য যে পরিমাণ ধৈর্য দরকার, তা সবার কাছে আশা করছি। বিদ্যুতের দাম বাড়বে কিনা সেটা বিইআরসি বলতে পারবে। তবে সবাই যেন প্রস্তুত থাকে, হয় শকড আসবে, না হয় আসবে না। তবে আমরা চাচ্ছি যতটুকু সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। নসরুল হামিদ বলেন, এখন প্রত্যাশা বাড়ছে, দিনে দিনে আরও বাড়বে। আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুত সরবরাহ করা। সারা বিশ্বে তেল ও এলএনজি গ্যাসের দামের যে উর্ধগতিসহ জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে সেটাকে মাথায় নিয়ে এগোনো আমাদের জন্য একটি চিন্তার বিষয়। আমরা সবকিছু মাথায় রেখেছি। আশা করছি, সামলাতে পারব।
কিন্তু পাইকারিভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকে ইস্যু বানিয়ে বিতরণ কেন্দ্রগুলোও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাধারণত সরবরাহকৃত বিদ্যুতের পরিমাণকে বিবেচনায় নিয়ে বিতরণ কোম্পানির রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। সরবরাহকৃত বিদ্যুতের দামের সঙ্গে বিতরণ কোম্পানির পরিচালন ব্যয় যোগ-বিয়োগ করে খুচরা দাম নির্ধারণ করা হয়। বিদ্যুত উৎপাদন কমিয়ে দেয়ায় বিতরণ কোম্পানিগুলোর রাজস্ব কমে গেছে। পাইকারি দাম বৃদ্ধি পেলে সেই সুযোগে কম উৎপাদনকে সামনে এনে বেশি করে দাম বৃদ্ধি চাইবে, যা কৌশলগতভাবে উপেক্ষা করার সুযোগ থাকবে না বলে উল্লেখ করে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহসভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিশ্বজুড়ে একটা সঙ্কট চলছে তা ঠিক আছে। ব্যয়বহুল বলে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, একই কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ। সম্প্রতি গ্যাসের দাম বেড়েছে।
এরপর জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। সেই ধাক্কা এখনও সামাল দিতে পারছে না জনগণ। এসব দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। পাইকারি দাম বৃদ্ধি হলে সরাসরি ভোক্তাদের ওপর প্রভাব পড়বে না। তবে পাইকারি দাম বাড়লেই খুচরা দাম বৃদ্ধি আবশ্যক হয়ে পড়বে। তাতে বাজার পরিস্থিতি নাজুক পড়ে পড়বে।
ভর্তুকি কমাতে গত আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে দেয় জ্বালানি বিভাগ। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়।
পিডিবি বলছে, সরকার যে ব্যয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করে, বিক্রি করে তার চেয়ে কম দামে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রতি ইউনিট বিদ্যুত বিক্রি করে গড়ে তারা পেয়েছে ৫ টাকা ৯ পয়সার মতো, যেখানে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯ টাকা। বাকি টাকা ভর্তুকি হিসেবে দেয় অর্থ বিভাগ। দেশে এখন বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৭১২ মেগাওয়াট (কারখানার নিজস্ব বিদ্যুতকেন্দ্র বা ক্যাপটিভ ছাড়া)। যদিও এত বেশি বিদ্যুতের চাহিদা নেই।
এখন দেশে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুত উৎপাদিত হয়। বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার এখন ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য পরিকল্পিত লোডশেডিং করছে। এতে মানুষ বিদ্যুত পাচ্ছে না, কিন্তু কেন্দ্র ভাড়া ঠিকই দেয়া হচ্ছে বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে। লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুত উৎপাদন কমায় দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে গত ১৩ জুলাই বিইআরসিতে একটি চিঠি দিয়েছে ক্যাব। চিঠিতে পুনরায় শুনানি না করে আগের দাম বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে তারা।