কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশাল ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে শেষ বিদায় জানিয়েছে ব্রিটেনসহ গোটা বিশ্ব। ১৯৫২ সালে রাজা জর্জের শেষকৃত্যের পর এবারই বড় ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় এলিজাবেথকে বিদায় জানানো হয়। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার এ্যাবেতে রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যের পর রানীর কফিন উইন্ডসর ক্যাসেলে নেয়া হয়। এরপর উইন্ডসরের সেন্ট জর্জেজ চ্যাপেলে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ সমাহিত হন রানী। রানীর সমাধিতে মার্বেল পাথরে লেখা থাকবে- ‘দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯২৬-২০২২’।
এই রাজকীয় চ্যাপেলে রানীর স্বামী প্রিন্স ফিলিপসহ ব্রিটিশ রাজপরিবারের অন্য সদস্যদের সমাধি রয়েছে। রানীর কফিন সেন্ট জর্জেজ চ্যাপেলে পৌঁছার পর কিছু ধর্মীয় রীতি পালন করা হয়। এরপর ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবির অনুমতি নিয়ে উইন্ডসরের ডিন ডেভিড কনার ধর্মসভা পরিচালনা করেন। এতে রাজপরিবারের সদ্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ওয়েস্টমিনস্টার থেকে রানীর কফিন উইন্ডসরে নেয়ার সময় রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমায়। অনেকে নীরবে চোখের পানি মুছতে থাকেন। কেউ আবার রানীর কফিন এক নজর দেখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। সোমবার স্থানীয় সময় বেলা পৌনে ১১টায় ওয়েস্টমিনস্টার এ্যাবেতে এই আনুষ্ঠানিক শেষকৃত্য শুরু হয়।
এতে বিশে^র নানা প্রান্তের প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতা অংশ নেন। দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্মরণে ওয়েস্টমিনস্টার এ্যাবের বাইরে ঘণ্টাধ্বনি হয়। রানীর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। তাই প্রতি বছরের জন্য প্রতি মিনিটে একবার করে এই ঘণ্টা বাজানো হয়। রানীর শোক মিছিলে মোট সাতটি গ্রুপ ছিল। মিছিলের পেছনের একটি গাড়িতে ছিলেন কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা এবং প্রিন্সেস অব ওয়েলস ক্যাথরিন। তাদের সামনে ছিলেন রাজা চার্লস এবং রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা। তারা কফিনের পেছনে পেছনে হাঁটেন।
দ্বিতীয় গাড়িতে ছিলেন ডাচেস অব সাসেক্স মেগান মেরকেল এবং কাউন্টেস অব ওয়েসেক্স সোফি।
শোক মিছিলের একেবারে সামনে ছিল রাজকীয় পুলিশের দল। কফিনের দুপাশে ছিলেন বহনকারীদের দল এবং দেহরক্ষীরা।
রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে শেষ শ্রদ্ধা হিসেবে ব্রিটেনে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় পুরো ব্রিটেন যেন এক মিনিট থমকে যায়। এর আগে তার পুত্র রাজা তৃতীয় চার্লস বাকিংহাম প্যালেসে বিশ্ব নেতাদের স্বাগত জানান। স্থানীয় সময় রবিবার রাত আটটায় এ নীরবতা পালন করা হয়। এ সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে কালো পোশাকে নীরবতা পালনের এ আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেন।
এরপর বিশ্ব নেতারা ওয়েস্টমিনস্টার হলে রাখা রানীর কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানান। তাদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও ছিলেন।
শোক বইতে স্বাক্ষর শেষে বাইডেন রানীকে ভদ্র ও শ্রদ্ধেয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, যুক্তরাজ্যসহ আমাদের সকলের হৃদয়ে আপনি রয়েছেন। আপনারা ভাগ্যবান তাকে ৭০ বছর ধরে পেয়েছেন। আমরা আজ সকলে এখানে। তার জন্যই বিশ্ব আরও ভাল অবস্থানে আছে।
সেন্ট জর্জেজ চ্যাপেলে রানীর আত্মার শান্তি কামনা করে কমনওয়েলথ মহাপরিচালক ব্যারোনেস স্কটল্যান্ড প্রথমে বাইবেলের একটি অংশ পাঠ করেন। তারপর বিশেষভাবে রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য জুডিথ ওয়্যারের লেখা একটি গান বাজানো হয়। ব্রিটিশ প্র্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস দ্বিতীয়জন হিসেবে বাইবেলের একটি অংশ পাঠ করে রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
গির্জার অন্য নেতারাও একে একে প্রার্থনা করেন। ১৯৫৩ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানের যে গানটি গাওয়া হয়েছিল, তার শেষযাত্রাও সেই গানটি গাওয়া হয়। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে গির্জায় প্রার্থনার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
গত ৮ সেপ্টেম্বর বালমোরাল প্রাসাদে রানী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি রাজমুকুট মাথায় পরেন। সোমবারের শেষকৃত্য ব্রিটেনের শ’ শ’ সিনেমা হলের পর্দা, পার্কের জায়ান্ট স্ক্রিন ও টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, বিশে^র প্রায় চারশ’ কোটি মানুষ রানীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান টেলিভিশনে সরাসরি দেখেছে। দর্শনার্থীরা রবিবার থেকেই ইতোধ্যেই ওয়েস্টমিনস্টার এ্যাবেতে সোমবারের রাজকীয় বিদায়ের মুহূর্ত এক ঝলক দেখার জন্য আগে থেকেই অবস্থান নেন। যা লন্ডনকে প্রায় স্থবির করে দেয়।
ব্রিটেনের দীর্ঘতম রাজত্বকারী রানীর ঐতিহাসিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান ঘিরে চারপাশে সর্বকালের বৃহত্তম পুলিশী অভিযান পরিচালনা করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জাপান এবং অন্য অনেক দেশের নেতারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিলেও রাশিয়া, আফগানিস্তান, মিয়ানমার, সিরিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
জাপান সম্রাট নারুহিতো এবং সম্রাজ্ঞী মাসাকো এতে যোগ দেন। ২০১৯ সালে সিংহাসন গ্রহণের পর এটি তাদের প্রথম বিদেশ সফর। এটি জাপানী ঐতিহ্য থেকে ব্যতিক্রম, খুব কমই সম্রাটকে শেষকৃত্যে যোগ দিতে দেখা যায়। ইউরোপের রাজকীয় পরিবারগুলোর মধ্যে কয়েক শতাব্দীর রক্তধারার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই মহাদেশের কয়েকজন রাজাকে এই শেষকৃত্যে দেখা যায়। ডাচ রাজা উইলেম-আলেকজান্ডার, রানী ম্যাক্সিমা এবং ক্রাউন প্রিন্সেস বিট্রিক্স, বেলজিয়ান রাজা ফিলিপ্পি কিং, নরওয়ের রাজা পঞ্চম হ্যারাল্ড এবং মোনাকোর প্রিন্স দ্বিতীয় এ্যালবার্ট সবাই এতে অংশ নেন।
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের তৃতীয় চাচাত বোন ডেনমার্কের রানী মার্গারেট এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার ৫০তম জয়ন্তী উপলক্ষে সিরিজ অনুষ্ঠান বাতিল করেন। তিনিও এসেছেন এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। স্পেনের রাজা ফিলিপ ষষ্ঠ এবং তার বাবা, প্রাক্তন রাজা জুয়ান কার্লোসও সেখানে ছিলেন। কার্লোস ২০১৪ সালে পদত্যাগ করার পর এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে রয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এ্যান্থনি এ্যালবানিজ এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন, অন্যান্য কমনওয়েলথ নেতাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে রানীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।