সাইফুল ইসলাম মৌলভীবাজার থেকে :
৩শ’ টাকা মজুরির দাবিতে চা শ্রমিকদের ধর্মঘট করেছে সাধারণ চা শ্রমিকেরা। টানা আটারো দিনেও ধর্মঘটের কারণে চা শ্রমিকের সংসারে অভাব অনটন দেখা দিয়েছে। আর এই কঠিন সংকটের মধ্যেও চা শ্রমিকদের আশার আলো জাগিয়েছে চা-বাগান মালিকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের ঘোষণায়।
গতকাল শুক্রবার মৌলভীবাজার জেলার সবকটি চা বাগানের কাজ বন্ধ থাকলেও পঞ্চায়েত কমিটির সদস্যরা বাগানের নাটমন্দিরে বিচ্ছিন্নভাবে সভাও সমাবেশ করেছেন। একই অবস্থা মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের চা বাগান গুলোতে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়নি এবং তাঁরা বিচ্ছিন্নভাবে সভা সমাবেশ করেছে। তবে সড়কে বিক্ষোভের মতো কোনো কর্মসূচিতে পালন করতে দেখা যায়নি।
এদিকে আজ শনিবার বিকাল চারটায় গণভবনে চা বাগান মালিকদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে হওয়ার বিষয়টি তাদের কানে পৌঁছলে পঞ্চায়েত কমিটির নেতৃত্বে সাধারণ চা শ্রমিকরা নীরব ধর্মঘট পালন করছেন একাংশের শ্রমিকরা।
সরেজমিনে শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালিঘাট, ফুলছড়া ও ভুরভুরিয়া, ভাড়াউড়া, খাইছড়া এবং জাগছড়াসহ বিভিন্ন চা বাগান ঘুরে শ্রমিকদের দেখা মেলেনি। বেশির ভাগ শ্রমিকই ঘরে রয়েছেন। বিকাল ৩টার দিকে কালিঘাট চা পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি অভান তাঁতির নেতৃত্বে শ্রমিকদের একত্রিত হয়ে সমাবেশ করেছেন। তবে কাজ না থাকায় শ্রমিকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। শ্রমিকরা এলোমেলোভাবে রাস্তায় রাস্তায় চলাফেরা করছেন। চেহারায় রয়েছে চরম দুশ্চিন্তার ছাপ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিক্ষোভ মিছিল মিটিং এ কিছুসংখ্যক উশৃঙ্খল চা শ্রমিক যুবক মাতাল অবস্থায় অংশ নেয়। তখন সে সবার সাথেই উশৃঙ্খল আচরণ করে। বিশেষ করে কিছু গণমাধ্যমকর্মীদের দোষারোপ করে গালিগালাজ ও দুর্ব্যবহার করছে। ফলে সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন বাগান এখন গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চলতি মাসের ৯ আগ থেকে চার দিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি ও পরে ১৩ আগষ্ট থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করে আসছেন চা শ্রমিকরা। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেও সেটা মানছেন না সাধারণ শ্রমিকেরা। আন্দোলন সফল করতে সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ অবরোধ করতে দেখা গেছে তাঁদের। দাবি আদায়ে গত কয়েক দিন ধরে বেশ উত্তাল ছিল চা বাগানগুলো। এরই মধ্যে শুক্রবার রাতে খবর আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার চা বাগানের মালিকদের সঙ্গে সভা করবেন। শনিবার বিকেল চারটায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ সভা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস।
ভাড়াউড়া চা বাগানের শ্রমিক সর্দার ধীরু হাজরা জানান, ‘১০২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২০ টাকা মজুরী করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘এ’ গ্রেডের শ্রমিকরা পায় ১২০ টাকা, ‘বি’ গ্রেডের পায় ১১৮ টাকা আর ‘সি’ গ্রেডের শ্রমিকরা পায় ১১৭ টাকা। এই টাকা দিয়ে কোনভাবেই পুষেনা।’
চা ভাড়াউড়া চা বাগানের দুলাল হাজরা জানান, দাবিকৃত মজুরী না পেয়ে কাজে যোগদানের কোন পথ আর নেই। টানা ১৮ দিন কাজে না যাওয়ায় অনেক শ্রমিকের এখন খাবার ঘরে নেই। কেউ উপোষ আর কেউ পানি ও একবেলা খেয়ে দিন যাপন করছে।
কালিঘাট চা পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি অভান তাঁতি বলেন, ‘আমরা মানসম্মত মজুরি চাই। আমাদের শ্রমিকরা যাহাতে ন্যায্য মজুরি নিয়ে কাজে ফিরতে পারে। তিনি বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার মুখ থেকে একবার হলেও একটা কথা শুনতে চাই। তিনি ১২০ টাকাও ঘোষণা দিলেও তাহলে আমরা কাজে যাবো, এমনকি ২০ টাকাও বললে কাজে যাবো।’
তিনি আরও বলেন,‘তবে আমরা আশাবাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা বাগান মালিকদের কাছ থেকে মানসম্মত একটা মজুরি এনে দেবেন। আমরা আর কোন নেতা বা প্রশাসনের কর্মকর্তা কারো ওপরে বিশ্বাস রাখতে পারি না। সবাই সাধারণ চা শ্রমিকদের নিয়ে পুতুল খেলা খেলে। আমরা এখন প্রধানমন্ত্রীকেই আমরা বিশ্বাস করি।’
দেওরাছড়া চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সুবোদ কুর্মি বলেন, “গতকাল শুক্রবার রাতে জেলার সবকটি বাগানের নিজ নিজ নাচঘরে পঞ্চায়েত কমিটি বৈঠকে বসেছে। ওই বৈঠকে মজুরি ও পরবর্তী শ্রমিক আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, ‘সাধারণ চা শ্রমিকদের সাথে ব্যাপক আলাপ আলোচনা হয়েও কোন সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ তাঁরা যদি আমার আহবানে সাড়া দিয়ে কাজে নেমে যেতো তাহলে হয়তো কিছু করা যেতো। এখন প্রধানমন্ত্রী কি সিদ্ধান্ত দেবেন তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
শ্রীমঙ্গল শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদীয় কমিটির নেতৃবৃন্দরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আজ শনিবার বিকাল চারটায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আশাকরি ওইদিনেই সমস্যা সমাধান হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছি, তাঁরা আশ^স্ত হয়ে কাজে যোগদানের জন্য জেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিরা কাজে ফেরানোর চেষ্টা করেছেন এবং বেশ কয়েকটি চা বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগদান করেছিল। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের উস্কানীতে তাঁরা আর কাজে যোগ দেয়নি।’
লোয়াইউনি-হলিছড়া চা বাগানের মহা ব্যবস্থাপক মাবুদ আলী বলেন, ‘একজন চা শ্রমিক ও তাদের পরিবার যে ধরণের সুযোগ সুবিধা পায় আমরা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হলেও তা পাই না। একজন চা শ্রমিক দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পায়। পাশাপাশি সারা জীবনের জন্য বাসস্থান, বিদ্যুৎ, পানি, চিকিৎসা বিনামূল্যে পেয়ে থাকে। প্রতি সপ্তাহে নিজে ২ টাকা মূল্যে ৩ কেজি ৭শ’ গ্রাম গম (রেশন), চা শ্রমিকের স্ত্রী/স্বামীর জন্য ২ কেজি ৪৫০ গ্রাম গম, প্রথম বাচ্চার জন্য ২ কেজি ৪৫০ গ্রাম গম এবং দ্বিতীয় বাচ্চার জন্য ১ কেজি ২২০ গ্রাম গম পেয়ে থাকে। এছাড়া একজন চা শ্রমিক তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে বা স্বেচ্ছায় অবসরে গেলে সপ্তাহে ১শ’ টাকা এবং ২৫০ গ্রাম গম পেয়ে থাকে। শ্রমিকরা চা বাগানের জ্বালানি কাঠ, গরু ও ছাগল পালন, জমি চাষ করে ভোগ দখলের সুবিধাও পায়।’
এ ব্যাপারে মহসিন টি হোল্ডিং লিমিটেড’র শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগান’র সত্বাধিকারী, শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মো. মহসিন মিয়া মধু বলেন, ‘চা শ্রমিক ভাইদের বাগান থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় সোয়া তিন কেজি গম এবং দুই বাচ্চা থাকলে সপ্তাহে সাড়ে পাঁচ কেজি গম দিচ্ছি। মেডিসিন তাদেরকে ফ্রি দেয়া হচ্ছে। বাড়ি দেয়া হচ্ছে। তারা গরু পালন করেন, সবজি চাষ করেন। একজন শ্রমিক যতোদিন বেঁচে থাকবেন অবসরে যাবার পরও অবসর ভাতা এবং রেশন দেওয়া হয়। এ সুযোগ-সুবিধা অন্য কোন শিল্পে দেয়া হয় না। এইসব বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যদি এড করা হয় তবে দৈনিক মজুরি প্রায় ৪শ’ টাকার ওপরে পড়ে। একজন চা শ্রমিক ২২ কেজি পাতা তুললে হাজিরা পায়। আমার বাগানে তারা ৮ ঘন্টা নিয়মিত কাজ করলে এভারেজ ৫০ কেজি কাঁচা পাতা তুলতে পারে। ২২ কেজির ওপরে যখন সে পাতা তুলে তখন প্রতি কেজির জন্য আলাদা টাকা তারা পেয়ে থাকেন। এসব হিসেব করলে অন্যান্য ইন্ডাষ্ট্রির তুলনায় চা বাগানে যেরকম ভর্তুকি দেওয়া হয়, অবসর ভাতা দেওয়া হয়, কাজ ছাড়া প্রতি রবিবারে মজুরি দেওয়া হয়, অসুস্থ হলে মজুরি দেওয়া হয়। একজন চা শ্রমিক ৮ ঘন্টা কাজ করা সম্ভব হলেও সর্বোচ্চ তারা ৪ ঘন্টা কাজ করেন। এছাড়া ব্যাংক ইন্টারেস্ট, গ্যাস বিল, ভ্যাট, ইলেকট্রিক বিল, অন্যান্য জিনিসের দাম বৃদ্ধিতো আছেই। গত কয়েক বছরে আমরা শ্রমিক ভাইদের মজুরি বৃদ্ধি করেছি, সেই তুলনায় চায়ের দাম কিন্তু বৃদ্ধি পায়নি।