নির্বাচনের ১৬ মাস আগে ইসির সিদ্ধান্ত ॥ ইভিএম রাজনীতি তুঙ্গে

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সব রাজনৈতিক দল নিজ নিজ কৌশলে প্রস্তুতি জোরদার করছে। এ নির্বাচনের আর মাত্র ১৬ মাস বাকি। ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন (ইসি) সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ভোট হবে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন)। সরকারী দল আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট দাবি করেছিল। কিন্তু তাদের দাবি উপেক্ষা করে অর্ধেক আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিলেও ইসির স্বাধীন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে দলটি।
আর ইসির এ সিদ্ধান্তে বিএনপিসহ কিছু দল ক্ষুব্ধ হয়েছে। ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। এ পরিস্থিতিতে দেশে ইভিএম এখন একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে গেছে। তাই ইভিএম রাজনীতি এখন তুঙ্গে। তবে নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে আস্থা সঙ্কট দূর করার চেষ্টা করছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ১৭ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপকালে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইভিএমসহ শতাধিক প্রস্তাব উঠে আসে। পরে এ প্রস্তাবগুলো নিয়ে একটি সারসক্ষেপ তৈরি করে ইসি। এরমধ্যে ইভিএমে ভোট করতে হলে বেশ আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী মনে করে। তাই ইসির বৈঠকে সর্বোচ্চ ১৫০টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আর এ সিদ্ধান্তের কথা জানার পর দেশের সকল রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে-বিপক্ষে সোচ্চার হয়।
ইভিএমে ভোটের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই সোচ্চার ছিল বিএনপি। তাদের মতে, ইভিএমে ভোট কারচুপির সুযোগ থাকে। এতে ফলাফল পাল্টে ফেলাও সম্ভব বলে এই দলটি মনে করে। তাই ইভিএমে নিয়ে ইসির সংলাপে যায়নি বিএনপি। অবশ্য পরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে সংলাপ হলেও সেই সংলাপেও যায়নি বিএনপিসহ ৯টি দল। এই দলগুলো সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে।
আর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে অন্য দলগুলো সংলাপে গেলেও এরমধ্যে সরকারের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টিসহ ১৬টি দল ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তবে আওয়ামী লীগসহ ১৪টি দল ইভিএমের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তবে পক্ষে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগসহ বেশকটি দলের ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট করার জোরালো দাবি ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ১৫০ আসনে ভোট নেয়ার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে সে সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। ইসির সংলাপে আমরা ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট চেয়েছিলাম। নির্বাচন কমিশন অর্ধেক আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমরা ২০১৮ সালেও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বলেছিলাম, আধুনিক যে টেকনোলজি এটা ব্যবহার করা সঙ্গত। ওবায়দুল কাদের জানান, ইভিএমে নির্বাচনে কোন ঝামেলা নেই। যারা ইভিএমকে ভয় পায়, তারা চায় না ভোট নিরপেক্ষ হোক, কারচুপি মুক্ত হোক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ভোট হতে হবে সম্পূর্ণ ব্যালটে। ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটের সিদ্ধান্ত কখনোই জনগণ গ্রহণ করবে না, আমরাও গ্রহণ করছি না। আমরা এ সিদ্ধান্তকে পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। ইভিএমে ভোট কারচুপির মেশিন। এতে ফলাফল পাল্টে ফেলা সম্ভব। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইভিএমে ভোট নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের জানান, ইভিএমের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা নেই। তাই আমাদেরও ইভিএমে ভোটে আস্থা নেই। তবে ভোট কারচুপির জন্য ক্ষমতাসীনরা ইভিএমে ভোট চায়। আমরা মনে করছি, ইভিএমে ভোট হলে ব্যাপক কারচুপি হবে। এর ফলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। আমরা ইসির সঙ্গে সংলাপকালেও ইভিএমে আস্থা নেই বলে জানিয়েছিলাম।
১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে জাসদের (জেএসডি) সভাপতি আসম আব্দুর রব বলেন, এ পদ্ধতিতে ভোট হলে ব্যাপক কারচুপি হবে। তবে ইভিএমে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার নীলনক্সা। আমরা ইভিএমে চাই না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স জানান, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপকালে অধিকাংশ দলই ইভিএমে ভোটের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ওইসব দলের মতামত উপেক্ষা করে ইসি ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডাঃ শাহাদাত হোসেন জানান, ইভিএমে ভোট হলে কারচুপির কোন সুযোগ থাকবে না। তাই আমরা ইভিএমে ভোট চাই।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আমরা ইভিএমে ভোট চাই। তবে ইভিএম নিয়ে যে আস্থার সঙ্কট আছে তা নির্বাচন কমিশনকে দূর করতে হবে। এ বিষয়ে দেশের মানুষকে সচেতন করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটের বিষয়ে নেয়া ইসির সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে সাংবাদিকদের জানান, ইভিএমে ভোট হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তারপরও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে ইসি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংবিধান অনুসারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে। তাই ইভিএমে ভোট করতে হলে আগেভাগে প্রস্তুতির দরকার থাকায় ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে এ পদ্ধতিতে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। ২০১০ সালের ১৭ জুন দেশে ইভিএমের মাধ্যমে প্রথম ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন সে সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কাছ থেকে প্রতিটি ১২ হাজার টাকা করে প্রায় এক হাজার ২৫০টি ইভিএম তৈরি করিয়ে নেয়।
ওই কমিশন এই ইভিএমের মাধ্যমে কোন কোন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভালভাবেই ভোট নেয়। এরপর বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ২০১২ সাল থেকে ইভিএমে ভোট গ্রহণ আস্তে আস্তে বাড়ানো হয়। কিন্তু কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ২০১৫ সালের ১৫ জুন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নিতে গেলে একটি ইভিএম বিকল হয়ে পড়ে। এরপর নতুনভাবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে আরও উন্নত প্রযুক্তির ইভিএম তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। হাতে নেয়া হয় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প।
পরে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে এই নতুন ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়। তারপর থেকে জাতীয় সংসদের প্রতিটি উপনির্বাচনে এবং সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও কিছু ইউপি নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়। অতি সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুসারে গাইবান্ধা-৫ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন ও ৬১টি জেলা পরিষদের নির্বাচনও ইভিএমে হবে বলে জানা যায়।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ইভিএম নিয়ে কোন কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস আছে, ইসি সেটা দূর করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন কমিশনে দাওয়াত করে ইভিএম মেশিন পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কোন দল ইভিএমে ভোট কারচুপির কোন প্রমাণ দিতে পারেনি। গত ৫ বছরে ৭৯১টি নির্বাচন হয় ইভিএমে। এর কোনটিতে কেউ নির্বাচন কারচুপির প্রমাণ দিতে পারেনি। তাই নির্বাচন কমিশন বুঝেশুনেই সর্বোচ্চ ১৫০ সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বুধবার সাংবাদিকদের জানান, ইসির বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্যতা সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ভোট হবে। তবে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আরও ইভিএম কিনতে হবে। এখন ইসির কাছে ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম আছে। এ দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭০ থেকে ৭৫টি আসনে ভোট করা যাবে। তাই ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আমাদের আরও ইভিএম লাগবে। কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে আমরা ইভিএম কেনার প্রক্রিয়ায় যাব।
কোন কোন আসনে ইভিএমে ভোট হবে তা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বলা যাবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সংলাপকালে দেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশ আমলে নিয়েই সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে ভোটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার মোঃ আলমগীর আরও জানিয়েছিলেন, ইভিএমে ভোট কারচুপি নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন তা প্রমাণে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেও কেউ সেটা প্রমাণ করতে আসেনি। আর বিএনপি ইভিএম নিয়ে অভিযোগ তুললেও তারা সংলাপে এসে বা অন্য কোনভাবে ইসির কাছে লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ না দেয়ায় তা আমলে নেয়া হয়নি। অন্য দলের মধ্যে যারা ইসিতে এসে ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ দিয়েছে তারাও তা যাচাই করে দেখেছে।
কিন্তু কারচুপির বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেনি। তিনি জানান, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে। তাই ইভিএমে ভোট কম পড়া ও কারচুপির অভিযোগ অপপ্রচার। তবে এ পর্যন্ত যারা অভিযোগ দিয়েছেন সেগুলো আমরা যাচাই করছি। তিনি জানান, ইভিএম ব্যবহার করে বেশকিছু নির্বাচন হয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ৬টি আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছে। সেটা নিয়ে কোনও চ্যালেঞ্জ হয়নি। বর্তমান সংসদেরও অনেকগুলো আসনে উপনির্বাচন ইভিএমে হয়েছে।
কেউ বলেননি ইভিএমের কারণে আমি হেরে গেছি বা চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে মামলা করেছেন, সেটাও না। তিনি জানান, ইভিএমের অনেকগুলো সুবিধাও আছে। ব্যালটে যেমন একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে। ইভিএমে সেই সুযোগ নেই। ব্যালটে ভোট গ্রহণ করে সারারাত ধরে ভোট গণনা করতে হয়। একবার ভুল হলে ১০ বার গণনা করতে হয়। ইভিএমে এসব ঝামেলা নেই।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো এক বিবৃতিতে বলেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন প্রকার সংশয় ও ইভিএম পদ্ধতিতে ত্রুটিমুক্ত করার প্রস্তাবসমূহকে আমলে না নিয়ে নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অর্ধেক আসনে ইভিএম ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক। বস্তুত এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন হুদা কমিশনের সিদ্ধান্তকেই বহাল রাখল। এর জন্য ঘটা করে সংলাপের প্রয়োজন ছিল না। বুধবার এ বিষয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কামরুল আহাসান এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানান।