কাজিরবাজার ডেস্ক :
২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট সারাদেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন (জেএমবি)। ওই দিন বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে দেশের ৬৩ জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ঢাকার ৩৪টি স্থানসহ সাড়ে ৪০০ স্পটে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। দেশব্যাপী ওই সিরিজ বোমা হামলার ১৭ বছর পূর্তি আজ। ওই হামলায় দেশের একটি মাত্র জেলা জঙ্গিদের হাত থেকে মুক্ত থাকে, সেটা হলো মুন্সীগঞ্জ। এই হামলায় নিহত হন দুজন। আর আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। জেএমবির সিরিজ বোমা হামলায় দেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯টি মামলা হয়।
পুলিশ সদরদপ্তর ও র্যাবের তথ্যে দেখা যায়, সারা দেশে দায়ের হওয়া ১৫৯টি মামলার মধ্যে রয়েছে ডিএমপিতে ১৮টি, সিএমপিতে ৮টি, আরএমপিতে ৪টি, কেএমপিতে ৩টি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে ৭টি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭টি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে ৮টি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৬টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে ৩টি। ওই ঘটনায় ঢাকা ও খুলনা রেঞ্জে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়- ২৩টি করে।
এখন পর্যন্ত ১৪২টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বাকি ১৭টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ১৩০০ জন। গ্রেফতার করা হয় ৯৬১ জনকে। এক হাজার ৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট গ্রেফতার করে ৪৫৫ জনকে। আর র্যাব গ্রেফতার করে ৬৭ জনকে। আর পলাতক আছে ৫০ জন আসামি।
পুলিশ জানায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলার মধ্যে ১০২টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এসব মামলায় ৩৩৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। ১৫ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয়া হয়। এর মধ্যে ৬ জনের ফাঁসি ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
এই সিরিজ বোমা হামলা মামলাগুলো থেকে ৩৪৯ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে এসব মামলায় খালাস পেয়েছে ৩৫৮ জন, জামিনে রয়েছে ১৩৩ জন আসামি। এছাড়া ঢাকায় ৫টিসহ মোট ৪১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় আসামি ৩৮৬ জন।
ঝালকাঠি জেলার দুই বিচারককে হত্যার দায়ে ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ছয় জঙ্গি নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। তারা হলেন- শায়খ আবদুর রহমান, তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, চিন্তাবিদ আব্দুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও সালাউদ্দিন।
বিএনপি-জামায়াতের শাসনামল ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে সরকারি এমপি-মন্ত্রীদের মদদে সারাদেশে জঙ্গিরা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে বলে অভিযোগ আছে। তারা ২০০৫ সালের পরবর্তী সময়ে দেশে ধারাবাহিক বোমা হামলা চালিয়ে বিচারক ও আইনজীবীসহ ৩০ জনকে হত্যা করে। ওই ঘটনায় আহত হন ৪ শতাধিক। ওই বছরের ৩ অক্টোবরে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও লক্ষীপুরের আদালতে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এতে তিনজন নিহত ও বিচারকসহ ৫০ জন আহত হন।
এর কয়েক দিন পর সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীর ওপর বোমা হামলার ঘটনায় তিনি ও তার গাড়িচালক আহত হন। ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারক বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায় আত্মঘাতী জঙ্গিরা। এতে নিহত হন ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতের বিচারক জগন্নাথ পাড়ে ও সোহেল আহম্মদ। এই হামলায় আহত হন অনেকে।
দেশে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে ২৯ নভেম্বর গাজীপুর বার সমিতির লাইব্রেরি ও চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে। গাজীপুর বার লাইব্রেরিতে আইনজীবীর পোশাকে প্রবেশ করে আত্মঘাতী এক জঙ্গি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এই হামলায় আইনজীবীসহ ১০ জন নিহত হন। আত্মঘাতী হামলাকারী জঙ্গিও নিহত হয়।
একই দিন চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে জেএমবির আত্মঘাতী জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটালে রাজিব বড়ুয়া নামের এক পুলিশ কনস্টেবল ও একজন পথচারী নিহত হন। পুলিশসহ প্রায় অর্ধশত মানুষ আহত হন।
১ ডিসেম্বর গাজীপুর ডিসি অফিসের গেটে আবারও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেখানে নিহত হন গাজীপুরের কৃষি কর্মকর্তা আবুল কাশেম। এই ঘটনায় কমপক্ষে ৪০ জন আহত হন।
৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নেত্রকোনা শহরের বড় পুকুর পাড় উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অফিসের সামনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় আত্মঘাতী জঙ্গিরা। সেখানে স্থানীয় উদীচীর দুই নেতাসহ আটজন নিহত হন। এই ঘটনায়ও শতাধিক মানুষ আহত হন।
র্যাবের একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত জেএমবি, হিযবুত তাওহীদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আল্লাহর দলসহ এমন ১৬টি জঙ্গি সংগঠনের ২ হাজার ৮২৪ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে জেএমবির সদস্য এক হাজার ৪৩৫ জন। তাদের থেকে আলামাত হিসাবে ৪৫০টি গ্রেনেড ও ককটেল, ১৪৩টি অস্ত্র, ৫ হাজার ৪২৭ রাউন্ড গোলাবারুদ, বিস্ফোরক ২ হাজার ৮১২.৩ কেজি, ৬৪০টি গ্রেনেড বডি, ডেটোনেটার ৯ হাজার ২২৪টি ও সুইসাইডাল বেল্টসহ বিভিন্ন বস্তু উদ্ধার করা হয়।