কাজিরবাজার ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিতে চায় সরকার। তবে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। তার মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার সেই শর্ত পূরণ করলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে সরকার একদিকে আর্থিকভাবে হবে ফলে বাজেটে ভর্তুকি কমবে, অন্যদিকে আইএমএফের শর্ত পূরণও হবে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর শনিবার (৬ আগষ্ট) এ বিষয়ে কয়েকজন অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে। এ সময় তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার তেল বিক্রি করার পয়সা দিয়েই তো তেল কেনে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া সরকারের কিছু করার ছিল না।
তবে সরকার এটা আগে করলে ভালো হতো। সরকার আর কত সাবসিডি (ভর্তুকি) দেবে। তবে এটা কঠিন সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অনেক কষ্ট হবে। কারণ এক ধাক্কায় দাম অনেক বেড়েছে। অনেক আগে দাম বাড়ালে এক ধাক্কায় এতো কষ্ট হতো না। এভাবে মূল্যবৃদ্ধি সরকারের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত ও জনগণের জন্য কষ্টকার।
ড. মনসুর ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আইএমএফের আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো হবে। সরকারও লাভবান হলো, আইএমএফের শর্তও পূরণ হলো। দেরিতে হলেও সরকার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হবে।
আইএমএফ জাতিসংঘের স্বায়ত্তশাসিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান কাজ বিভিন্ন দেশের মুদ্রামানের হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা। ১৯৪৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কার্যক্রম শুরু হওয়া এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন ২৯টি দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ১৮৯টি রাষ্ট্র এই সংস্থার কার্যক্রমের আওতাভুক্ত হয়। আইএমএফ তাদের কার্যক্রমের আওতাভুক্ত দেশগুলোকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেয় এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে অর্থায়ন করে থাকে। এসব সহযোগিতা দিতে নানা শর্ত জুড়ে দেয় সংস্থাটি।
ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত যেসব শর্ত দেয় আইএমএফ
আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিতে চায় সরকার। যদিও শর্তের বিষয়ে সরকার ও আইএমএফ পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। তবে যেকোনো ঋণের ক্ষেত্রেই সংস্থাটি কিছু নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে থাকে। একই শর্ত বাংলাদেশ সরকারকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরোপ করেছে বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের।
২০১২ সালে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সময় বেশ কিছু শর্ত দেয় সংস্থাটি। এর মধ্যে অন্যতম রাজস্ব আদায়ে সংস্কার ও উন্নয়ন। মওকুফের সুবিধা বাতিলের শর্তও দিয়েছিল সংস্থাটি। অন্যান্য শর্তের মধ্যে ছিল সরকারের ভর্তুকি কমানো, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার বৃদ্ধি, বিনিময় হার আরও নমনীয় করা, খেলাপি ঋণ আদায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ক্ষমতা বাড়ানো, বাণিজ্য বাধা দূর করা, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি প্রভৃতি।
বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারসাম্যের ক্ষেত্রে কিছুটা চাপে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য ও রাসায়নিক সার আমদানির দায় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে কয়েক মাস ধরে রিজার্ভের মজুত কমছে। বর্তমানে রিজার্ভের মজুত ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
এ অবস্থায় সংস্থাটির কাছে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে সরকার। কিন্তু এ ঋণের জন্য বাংলাদেশে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের দেওয়া ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার শর্ত দিতে পারে আইএমএফ। রাজস্ব এবং আর্থিক খাতের সংস্কারের শর্তও দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন আরও কিছু শর্ত থাকতে পারে। এদিকে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ভাবেই আখ্যায়িত করছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আইএমএফের শর্ত কাজ করেছে বলে মনে করছেন না অনেকেই।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফের সঙ্গে ঋণের আলোচনা শুরু হয়নি, শুধু চিঠি চালাচালি চলছে। সরকার বলছে আমরা ঋণ নিতে আগ্রহী, আইএমএফ বলছে আমরা ঋণ দিতে আগ্রহী।
আইএমএফ টিম আগামী মাসে আসবে বলে আমরা জানি। জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কমানোর শর্ত আইএমএফ দিয়ে থাকে। জ্বালানি তেলের দাম যুক্তিকরণ এবং এটা একটা ফর্মুলার ভিত্তিতে করা আইএমএফের শর্তের মধ্যে থাকে। এটা আইএমএফ চায়। এটা তাদের কর্মসূচির একটা অংশও। সরকার যদি দরকষাকষির জন্য এটা রেখে দিতো তাহলে এখনই তা বাস্তবায়ন করার কথা নয়। আইএমএফের শর্তের জন্য সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে- এটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয় না।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ইতিবাচক দিক তুলে ধরে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে তিনটি ইতিবাচক দিক দেখছি। প্রথমত, বাজেটে ভর্তুকির বোঝা ৪২ হাজার কোটি টাকা। এটা বেড়েই চলেছে। মূল্যবৃদ্ধি না করলে ভর্তুকি কমানোর পথ নেই। ডিজেল সবাই ব্যবহার করে। ধনী-গরিব সবার ডিজেল লাগে। ডিজেলে আমরা যে ভর্তুকি দিচ্ছি এটা সবাই পায়। যে বেশি ব্যবহার করবে সে-ই বেশি পাবে। ঢালাওভাবে কেন আমরা ভর্তুকি দেবো? এটা বাজেটে বোঝা বাড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বাজেট ও সামাজিক সুরক্ষা বাজেটে ভর্তুকি কমানো মঙ্গল হবে না। কাজেই বাজেটের ভর্তুকিটা সহনীয় রাখতে এটা (জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি) করা হয়েছে। এটার বাস্তব কারণ আছে। দ্বিতীয় ইতিবাচক দিক হলো ভারতের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামের পার্থক্য ছিল ৩০ টাকার বেশি।
এটা চলতে থাকলে ভারতে আমাদের জ্বালানি চলে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। তার মানে আমাদের জ্বালানির পাচাররোধে এটা করতে হয়েছে। আমরা ডিজেলে যে ভর্তুকি দিচ্ছি এটা যদি ভারতে চলে যায় তাহলে ভর্তুকি পাচ্ছে ভারতীয়রা। তৃতীয় কারণ হচ্ছে ডিজেল কিন্তু পরিবেশবান্ধব নয়। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবাই যদি ডিজেল ব্যবহারে সাশ্রয়ী হয় তাহলে আমাদের জন্য ভালো। এটা পরিবেশের জন্যও মঙ্গল।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক দিক তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক এই মুখ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, কেরোসিনের দাম বেড়েছে। কেরোসিনের ব্যবহার বেশি হয় গ্রামে। গ্রামে মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গণপরিবহনের ভাড়া এমনিতেই বাড়বে। এরই মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে।
পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির ফলে নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। আবার সরকার যদি পরিবহন মালিকদের শর্ত না মানে তাহলে ধর্মঘট হবে। পরে দেখা যাবে যে সরকার এটা মানতে বাধ্য হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাসভাড়া, ট্রাকভাড়া ও লঞ্চসহ নানা পরিবহনে ভাড়া বাড়বে। এছাড়া কৃষিখাতে প্রচুর ডিজেল ব্যবহার হয়। এবার বৃষ্টি কম হয়েছে, ফলে আমন চাষে সেচকাজে ডিজেলের ব্যবহার বাড়বে। ফলে কৃষি ও শিল্পের খরচ বাড়বে। সব পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতি যেখানে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে সামনে এটা ৮ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ হবে।