স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেট অঞ্চলে ভয়াল বন্যা মোকাবিলার মধ্যে তীব্র তাপদাহ, হঠাৎ করে ভারী বর্ষণ ও জলাবদ্ধতার জন্য বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সিলেটে সাম্প্রতিক তীব্র তাপদাহ, অতিবৃষ্টির কারণে নগরীতে সাময়িক জলাবদ্ধতা ও দুর্ভোগ এবং সিসিকের উন্নয়ন বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
মঙ্গলবার (১৯ জুলাই ২০২২) দুপুরে নগর ভবনের সভা কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক ও অতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সিসিকের করনীয় তুলে ধরা হয়।
সিসিক মেয়র লিখিত বক্তব্যে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে এই সমস্যা। সিলেটে অতিবৃষ্টি, তীব্র তাপদাহ, শীতকালে গরম অনুভূত হওয়া কিংবা তীব্র কুয়াশা তথা আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বিশেষজ্ঞদের জন্য উদ্বেগের । ভয়াল বন্যার পর একটানা তাপদাহ নতুন করে সংকটে ফেলে সকলকে। এরমধ্যে গত শনিবার দিনে অস্বাভাবিক তাপদাহের পর রাতে অল্প সময়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির কারণে আকস্মিক জল-দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে।
তিনি বলেন, সেই দুর্ভোগের শিকার আমি নিজেও। যদিও আমার বাসা নগরীর মধ্যভাগের উঁচু এলাকায়। গত শনিবার রাত ১১টা ২ মিনিট থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত প্রায় ৫৮ মিনিটে ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ওইদিন সকাল ৬ টা পর্যন্ত মোট ৬ ঘন্টা ৫৮ মিনিটে ১৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। যা সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে সবচেয়ে কম সময়ে বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। এটিকে ‘অতি প্রাকৃতিক’ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আমরা তাৎক্ষনিক সচেষ্ট হই। আবহাওয়া অফিসের আগাম সতর্ক বার্তায় এই অতি প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের সাথে মতবিনিময় করেছি। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছি। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চলতি বছরের এমন ঘটনা আরো ঘটতে পারে বিবেচনায় আমরা সিসিকের জরুরী সভা আয়োজন করেছি।
এমন দুর্যোগ হলে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করেছি এরই মধ্যে। দিন কিংবা রাত-অতি বৃষ্টি শুরু হলে আমাদের ৮ টি স্ট্রাইকিং টিম পরিচ্ছন্নতার কাজে প্রস্তুত রয়েছে। মেয়র, কাউন্সিলর, কর্মকর্তা কর্মচারীরা মাঠে থাকবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অতি বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় সিসিকের কিছু ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে বলেন, আমরা বন্যার পর নগরের ছড়া-খাল, ড্রেনের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করছিলাম। এরই মধ্যে কোরবানীর ঈদ চলে আসে। ঈদের সময় পশুর হাট ও কোরবানীর পশুর বর্জ্য অপসারণের দিকে আমরা গুরুত্ব দিয়েছিলাম। যার সফলতা আপনারে দেখেছেন। তিনি বলেন, ঈদের পর পর শুরু হয় তীব্র তাপদাহ। জনজীবন নতুন করে বিপর্যস্ত হয়। ফলে ড্রেনের অবর্জনা শতভাগ পরিচ্ছন্ন আমরা করতে পারিনি।
মেয়র বলেন, এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ছড়া-ড্রেনে বিভিন্ন ধরনের অপচনশীল বর্জ্য যেমন, বালিশ, তোষক, ককশিট, প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি নির্বিচারে ফেলে রেখেছেন যার ফলে অল্প সময়ে বেশি পরিমান বৃষ্টি হওয়ায় সাময়িক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিসিক তাৎক্ষণিক পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিসিক মেয়র আরও বলেন, জলবদ্ধতা নিরসনে সম্মানিত নাগরিকদের যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। সব ধরণের সময় আবর্জনা ফেলতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে। এ জন্য তিনি নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।
সিসিকের উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে সিসিক মেয়র বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিলেটের উন্নয়নে করোনা পূর্ববর্তী সময়ে ১২শ ২৮ কোটি টাকা শর্ত সাপেক্ষে বরাদ্দ অনুমোদন দিয়েছিলেন। কিন্তু এই পরিমাণ অর্থ পেতে বিধি অনুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে নিজস্ব আয় থেকে ২০ শতাংশ অর্থাৎ ২৪৫ কোটি যুক্ত করতে হবে। আর ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ৯৮২ কোটি টাকা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেবে। বরাদ্দের পুরো টাকা চারটি অর্থ বছরে ছাড় দেয়া হবে।
মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, এই বরাদ্দের প্রথম ধাপে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ১২৯ কোটি টাকা পায় সিসিক। পরের অর্থ বছর ২০২১-২০২২ এ ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। এখন পর্যন্ত ৯৮২ কোটি টাকার মধ্যে সিসিক পেয়েছে ৩২৯ কোটি টাকা। ফলে সিসিকের ১২শ কোটি টাকা জলে গেছে’, ‘হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কোন কাজে আসেনি’ এমন তথ্য অপপ্রচার বলেই মনে করে সিসিক কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে সম্মানিত নাগরিক ও গণমাধ্যম যেন বিভ্রান্ত না হয় সে আহবান জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে সিসিক মেয়র বলেন, সরকারি অর্থ কারো পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হয়ে খরচ করা অসম্ভব। নজরদারির জন্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ দ্বারা উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন যথাযথ নিয়ম রয়েছে। সিসিকের মাস্টার প্লান প্রনয়ণের সময় সরকারের যথা নিয়মে সিলেটের প্রকৃতি বিবেচনায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করা হয়। ইন্সিটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং- আইডব্লিউএম ফিজিবিলিটি স্ট্যাডিটি করে। সেই মাস্টার প্লান ও ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি অনুযায়ী সিসিকের ছড়া, ড্রেনের উন্নয়ন কাজ পরিচালিত হচ্ছে। ড্রেনের প্রসার বা বর্ধিতকরণ কতো হতে পারে সেটা, জলাবদ্ধতা নিরসনে মহানগর এলাকার নিম্নাঞ্চল এবং নদী তীরবর্তী এলাকায় স্লুইস গেট নির্মাণ এবং পাম্প হাউস স্থাপনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ীই সিসিক পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে।
তিনি বলেন, মাস্টার প্লানে নগরের রাস্তাগুলোকে ৮০ ফুট চওড়া করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা নাগরিকদের সুবিধা বিবেচনায় ৮০ ফুট রাস্তা করতে পারিনি। কারণ বেশির ভাগ এলাকায়ই ৮০ ফুট রাস্তা করার বাস্তবতা এখন আর নেই। এ কারণে রাস্তা বর্ধিত করতে হয়েছে পারিপার্শিকতা বিবেচনায়। সে অনুযায়ী ড্রেনও নির্মাণ করা হয়েছে।
‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন’ বিষয়টির সাথে আমরা ইদানীং খুবই সাংঘর্ষিক অবস্থানে আছি। যেমন নানা মাধ্যমে, কোন কোন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতিক বা অতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সিসিকের ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন’-এর ফলে হচ্ছে বলছেন। সিসিক সরকারের অন্যসকল দপ্তর, সংস্থার মতোই উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে সরকারের সকল বিধি নিয়ম মেনেই করছে। একটি প্রকল্প প্রণয়নের সময় থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ, সংশ্লিষ্টদের মতামত, গবেষণা-পর্যালোচনা করেই কাজটি করা হয়। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয় হয়। কেউ যদি সরকারের নিয়ম নীতি মেনে যথা উপায়ে করা উন্নয়ন কাজকে ‘অপরিকল্পিত’ বলে আখ্যায়িত করেন, সেটা কতোটা যুক্তিসংগত হবে? দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে আমার টানা ৩ বার সেরা হয়েছি। আমাদের কাজেকর্মে ভুল থাকলে নিশ্চয় সরকারীভাবে আমরা শ্রেষ্ঠ হতাম না।
সংবাদ সম্মেলনে সিসিক মেয়র যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহবান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস নিয়ে বক্তব্য রাখেন, সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী।
এ সময় সিসিকের বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, কর্মকর্তা, সিলেট প্রেসক্লাব, সিলেট জেলা প্রেসক্লাব,ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন-ইমজা, সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব, সিলেট বিভাগীয় ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশেনের নেতৃবৃন্দসহ সিলেটে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন।