দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

39

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

দরিদ্র ও দারিদ্র্য বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম আলোচিত বিষয়। এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের বস্তুগত ধারণার সাথে ইসলামী ধারণার কোন মিল নেই। ইসলাম ইহকাল এবং পরকালের কল্যাণে ধন-সম্পদ অর্জন ও ব্যয় করতে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শনে পারলৌকিক বিষয়াদি তেমন প্রাসঙ্গিক বলে ধরা হয় না। যুগে যুগে মুসলমানদের মধ্যে এমনও দেখা গেছে এবং এখনো হয়তো বা তেমন মুসলমান খুঁজে পাওয়া যাবে যারা পারলৌকিক কল্যাণ কামনায় বা কেবল আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য ইহলোকে বিত্তশালী হওয়া প্রয়োজন মনে করেন না। এরা প্রচুর বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হওয়ও জৌলুস-হীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত। আল্লাহ্ তাআলার ইবাদতে বিঘ্ন ঘটতে পারে বিবেচনা করে ইহলৌকিক ভোগ-বিলাস তাঁরা এড়িয়ে চলেন। যেটুকু বৈষয়িক সম্পদ হাতে না রাখলে আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদতে মনের একাগ্রতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সে সামান্যটুকু হাতে রেখেই তাঁরা তুষ্ট। বৈষয়িকভাবে তাঁরা নিতান্তই দরিদ্র জীবন যাপন করলেও আত্মার পরিপুষ্টি ও সমৃদ্ধিতে তাঁরা অনেক মহান এবং উন্নত। এই উন্নত ও মহান আত্মা তাঁরা মহান আল্লাহ্র প্রতি নিবেদন করেন। কিন্তু তাই বলে ইসলাম দারিদ্র্যকে আদর্শায়িত করে না, যেমন হালাল পথে অর্জিত ধনও প্রয়োজনাতিরিক্ত নিজ অধিকারে রাখাকে প্রশ্রয় দেয় না। শরীয়তের বিধান অনুসারে উত্তরাধিকার বিধি ও যাকাত প্রদানের মাধ্যমে হালাল সম্পদের সুসমবণ্টনে ইসলাম বিশ্বাসী। ইসলাম দারিদ্র্যকে ভালবাসে, তবে দারিদ্র্যকে কামনা করেনা। এ নিবন্ধে দরিদ্র ও দারিদ্র্যকে প্রথমত পশ্চিমা বৈষয়িক দৃষ্টিকোন এবং দ্বিতীয়ত ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে এটাই দেখাতে চেষ্টা করা হয়েছে যে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দরিদ্র ও দারিদ্র্যের প্রতি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিই উত্তম।
আমরা সচরাচর দরিদ্র ও দারিদ্র্য শব্দ দুটি পশ্চিমা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে থাকি। এই বিবেচনায় বস্তুগত দারিদ্র্যই প্রাধান্য পেয়ে থাকে যা মূলত বস্তুগত সম্পদের মালিকানা ও ভোগ বিলাসের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইসলাম দরিদ্র ও দারিদ্র্যকে কেবল সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে দরিদ্রকে বৈষয়িক বা বস্তুগত দরিদ্র এবং আধ্যাত্মিক দারিদ্র্য। দরিদ্র যা ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সাথে সম্পৃক্ত তা পশ্চিমা অর্থনৈতিক আলোচনায় তেমন একটা প্রাধান্য পায় না। এমন কি বস্তুগত দরিদ্র নিরসনের উপায় অবলম্বনের ক্ষেত্রেও যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক বিধিবিধান মেনে চলতে হয়, তার উপরও পশ্চিমা অর্থনীতি তেমন গুরুত্ব আরোপ করে না। আল্লাহ বলেন: “তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না”। ইসলাম এ ক্ষেত্রে মানবজাতিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়, কারণ ইহকালই শেষ কথা নয়। ইহকালের কর্মকাণ্ডের জন্য প্রত্যেককে পরকালে জবাবদিহি করতে হবে। তাই ইহকাল ও পরকালে কল্যাণকর এমন আর্থিক জীবন যাপনের প্রতি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে আল্লাহ বলেন: “মানুষের মধ্যে যাহারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদিগকে ইহকালেই দাও বস্তুত পরকালে তাহাদের জন্য কোন অংশ নাই। আর তাহাদের মধ্যে যাহারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখিরাতে কল্যাণ দাও এবং আমাদিগকে অগ্নির শান্তি হইতে রক্ষা কর-তাহারা যা অর্জন করিয়াছে তাহার প্রাপ্য অংশ তাহাদেরই। বস্তুতঃ আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর।” অধিকন্তু আল্লাহ আরো বলেন: “পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত আর কিছুই নয় এবং যাহারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাহাদের জন্য আখিরাতের আবাসই শ্রেয়; তোমরা কি অনুধাবন কর না?” কেননা “জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিবে”। “এবং তোমাদের মৃত্যু হইলে অথবা তোমরা নিহত হইলে আল্লাহরই নিকট তোমাদিগকে একত্র করা হইবে।” আল্লাহ বলেন: “শুধু আমাকে ভয় কর”। সুতরাং এ আল্লাহভীতিই পার্থিব জীবনে ও পারলৌকিক জীবনে কল্যাণ ও সাফল্য অর্জনের প্রধান নিয়ামক। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদেরকে দরিদ্র ও দারিদ্র্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে হবে, পশ্চিমা নীতি-আদর্শহীন বস্তুগত অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।
দারিদ্র্য বিমোচন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বুঝানো হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে দারিদ্র্য লাঘব এবং টেকসই (ঝঁংঃধরহধনষব) উন্নয়ন হয় সে জন্য তাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সাথে সাথে মাথাপিছু আয় এবং সঞ্চয়ও বৃদ্ধি পেতে হবে। যার ফলে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সৃষ্টি এবং বিভিন্ন সামাজিক খাত-শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ইত্যাদি উন্নয়নের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নীত হয়। ধর্মসমূহেও দারিদ্র্য বিমোচন এবং নিঃস্বদের কল্যাণের জন্য উদাত্ত আহান রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বিভিন্ন মানবীয় দর্শনের তুলনায় সেসবের অবদান ছিল অনবদ্য। আল-কুরআনুল কারীমে বিভিন্ন নবীর দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী হিসেবে ‘যাকাত’ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব আ. সম্পর্কে কুরআন ঘোষণা করেছে, আমি তাঁদেরকে ইমাম বানিয়েছি। তাঁরা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করতেন। আমি তাঁদের প্রতি ওহী নাযিল করলাম সৎকর্ম করার, সালাত প্রতিষ্ঠা করার এবং যাকাত দান করার জন্য। তাঁরা আমার ইবাদতে ব্যাপৃত ছিল।
তাওরাত ও ইনজীলের নতুন এবং পুরাতন নিয়মে দেখা যায়, বহুস্থানেই দুর্বল ও দরিদ্র লোকদের প্রতি সহৃদয়তা ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিধবা, ইয়াতীম, দুর্বল ও অক্ষম লোকদের অধিকার আদায়ের জন্য। আদি পুস্তকে বলা হয়েছে, ‘যে দরিদ্রকে দান করে, সে পরমুখাপেক্ষী হয় না। আর যে তার চক্ষুদ্বয় আড়াল করে, তার উপর অশেষ অভিসম্পাত।’ মথিতে বলা হয়েছে, যখন তুমি দান কর তখন তোমার দক্ষিণ হস্ত কি করছে তা বাম হস্তকে জানতে দিও না। এরূপে তোমার দান যেন গোপনে হয়, তাতে তোমার পিতা, যিনি গোপনে দেখেন, তিনি তোমাকে ফল দেবেন।’
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘সুনয়ন ব্যক্তি আমীর্বাদযুক্ত হবে, কারণ সে দীনহীন লোককে আপন খাদেগ্যর অংশ দেয়।’ উপর্যুক্ত আলোচনায় দরিদ্র ও নিঃস্বদের প্রসঙ্গে প্রাচীন ধর্মগুলোর অবদানের কথাই পরিষ্ফুট। এটাই ছিল আল-কুরআনের পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহের শিক্ষা।
দারিদ্র্য একটি সামাজিক অভিশাপ এবং সাধারণ মানুষের জন্য দারিদ্র্য পাপের প্রথম পর্যায়। অনুন্নত দেশসমূহে দেখা যায়, জাতীয় চরিত্রের অবনতি, মিথ্যার বেসাতি, ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতা-এসবের অন্যতম কারণ দারিদ্র্য।’ আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, শয়তান তোমাদেরকে অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাবিজ্ঞ।
অন্যদিকে চরম দারিদ্র্যের ন্যায় চরম প্রাচুর্যও মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। আল-কুরআনুল কারীমে ‘তাকাছুর’ বা প্রাচুর্যের লালসার পরিণতি সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা এবং অসংখ্য আয়াত নাযিল হয়েছে। এ কারণেই অধিকাংশ নবী-রাসুল এবং মহৎ ব্যক্তিবর্গ স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যের পথ বেছে নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এখনও মুসলিম সমাজে ধনীর চেয়ে দরিদ্ররাই বেশি ধার্মিক। তবে দারিদ্র্য যে সাধারণ মানুষের ঈমানের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ, এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অভাব-দারিদ্র্য মানুষকে কুফরের দিকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যত জ্ঞানীই হোক না কেন, তার যদি প্রয়োজনীয় সম্পদ ও জীবনোপকরণ না থাকে, তবে সে দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিজের অলক্ষ্যেই নীতিভ্রষ্ট হয়ে উঠে। দারিদ্র্যপীড়ায় জর্জরিত জীবন থেকে রক্ষাকল্পে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে, ‘অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা আল্লাহর এই পৃথিবীতে তাঁর প্রদত্ত রিযকের অন্বেষণে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’
অসীম দয়ালু ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ এই পৃথিবীকে বিপুল নিয়ামতরাজি দ্বারা পূর্ণ করেছেন। আল-কুরআনুল কারীমের পাতায় পাতায় তার ধারা বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে। আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব হলো-মানুষ কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে প্রাকৃতিক সম্পদরাজি ব্যবহারের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল, সুখী ও সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। মানুষের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বের মধ্যেই রয়েছে দারিদ্র্য বিমোচনের ইশারা। প্রতিটি মানুষের জন্যই প্রাকৃতিক সম্পদরাজির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। আল্লাহর নবীগণও এ দায়িত্বে অংশগ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন যে, দুর্দশা ছাড়া ভিক্ষা করা নিষিদ্ধ। এটা ঘৃণার কাজ, পরনির্ভরশীলতা মানবতার শ্রেষ্ঠত্বের পরিপন্থী রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সর্বদা লোকদের নিকট ভিক্ষা করে বেড়ায়, কিয়ামতের দিন সে এমনভাবে হাযির হবে যে, তার মুখমন্ডলে সামান্য গোশতও থাকবে না।’
দারিদ্র্যের কারণে মানুষ অসংখ্য অপকর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ স্বীয় স্রষ্টার কুফরী করতেও দ্বিধাবোধ করে না। হাদীসে এ কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) একই সাথে কুফরী ও দারিদ্র্য থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।
ড. ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, ইসলাম ধনাঢ্যতাকে আল্লাহর নিয়ামত বলে মনে করে, যার কৃতজ্ঞতা আদায় করা উচিত। আর দারিদ্র্যকে মনে করে একটি সংঘাত, যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা অত্যাবশ্যক। সুতরাং ইসলামে দারিদ্র্য কোন কল্যাণের বিষয় নয়।
কোন সমস্যার সমাধান বা কোন বিষয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে ইসলাম শুরুতেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে দেয়। অন্যদিকে দেখা যায়, আল্লাহর দাসত্ব পরিহার করে বিভিন্ন যুগে মানুষেরা কোন কোন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে অজস্র সমস্যার উৎপত্তি ঘটিয়েছে। আবার কোন বিষয়ে উন্নতি করতে গিয়ে অজস্র উন্নতির পথকে রুদ্ধ করেছে। কিন্তু ইসলাম মানুষের সার্বিক বা সুষম উন্নতির পথ দেখায়। তাই ইসলাম হলো দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান নির্ধারণের জীবনাদর্শ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ দরিদ্র মুসলিম দেশসমূহে পাশ্চাত্য কৌশলে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে এবং দারিদ্র্য বিমোচন করতে গিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ আগ্রাসন দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। তারাও বস্তুবাদীদের মত বলছেন যে, দারিদ্র্য, অপরাধ, সন্ত্রাস নিবিড়ভাবে জড়িত। আরো বলা হচ্ছে, দারিদ্র্য বিমোচনে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। মূলত জিহাদ দারিদ্র্য বা সমৃদ্ধির বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সুতরাং ইসলামের সার্বিক বক্তব্যের আলোকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচারণা সময়ের দাবি।
ইসলামের দারিদ্র্য দূরীকরণ কৌশল-পদ্ধতি মানবরচিত মতবাদগুলোর তুলনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে সুদের মুলোৎপাটন। কেননা সুদ অর্থনীতিকে ধ্বংস করে এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করে। মওজুদদারীও নিষিদ্ধ, কেননা এতে ধনী-গরীব সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম কৌশল হলো সম্পদের সুষম আবর্তন নিশ্চিতকরণ। কেননা এতে ব্যত্যয় ঘটলে সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং সংকট সৃষ্টি হয়। ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কর্মে উৎসাহ প্রদান করে এবং কর্মক্ষেত্র তৈরি করে, যা দারিদ্র্য বিমোচনের যথার্থ হাতিয়ার।
ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান। মানুষ হিসেবে মালিক-শ্রমিক কোন পার্থক্য ইসলাম স্বীকার করে না। শ্রমিক সমাজের উপযুক্ত মর্যাদা দানে ইসলাম কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছে। ইসলাম একে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। সমাজে সকল মানুষ উপার্জনে সক্ষম নাও হতে পারে। শারীরিক অসুস্থতা অথবা বয়সের কারণে কেউ কেউ উপার্জনক্ষম নয়। এসমস্ত লোকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে সমাজ থেকে দরিদ্রতা অনেকাংশেই লাঘব হবে।
ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোন ভূমিকে অনাবাদী রাখার শিক্ষা নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) পতিত ভূমি আবাদকরণকেও দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। প্রতিবেশীর অধিকার আদায় ও নিশ্চিতকরণে কুরআন ও হাদীসে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই ইসলাম দারিদ্র্য বিমোচনে প্রতিবেশীর হক আদায় করার প্রতি প্রবল গুরুত্বারোপ করেছে। অসহায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবেশীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া বিত্তবানদের অন্যতম কর্তব্য বলেও ইসলাম নির্দেশনা প্রদান করেছে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমনিভাবে তাঁর পুরো জীবনকে মানবজাতির কল্যাণ সাধনে সংগ্রামে ব্যাপৃত রেখেছিলেন, তেমনিভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যও তিনি সংগ্রাম করেছেন। এ বিষয়ে ইসলামের কৌশল ও নির্দেশনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও কার্যকরী। কিছু বিষয়ে রয়েছে আল-কুরআনুল কারীমের সরাসরি শিক্ষা-দর্শন ও নির্দেশনা। আর কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও কর্মপদ্ধতি এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বাণী ও কর্মের মাধ্যমে। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য যে দ্বীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে অনন্ত প্রশান্তি ও অফুরন্ত রহমতের ফল্গুধারা। মানবজীবনের যত সমস্যা রয়েছে সবচে’ জটিল সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা।
বিশ্ববিপ্লবের অগ্রনায়ক রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রবর্তিত শাশ্বত সুন্দর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি শুধু অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থাকে সুসংহত করেননি। মানুষের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার উপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। কিভাবে অর্থ উপার্জন করতে হবে, কিভাবে ব্যয় করতে হবে, কোন পথে অর্থনৈতিক মুক্তি তার সঠিক নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁর প্রবর্তিত অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রবর্তিত অর্থব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল সমাজ থেকে যুলুম, নির্যাতন ও শোষণের পথকে মুলোৎপাটনকরণ এবং সে সাথে সুষম-ভারসাম্যপূর্র্ণ ও কার্যকর অর্থ-ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন। এ বিষয়ে তিনি সফলও হয়েছিলেন। মাত্র কয়েক বছরের পরিসমাপ্তিতে নেমে এসেছিল এক অনাবিল সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। খুঁজে পাওয়া যায়নি যাকাত গ্রহণ করার মত কোন অস্বচ্ছল লোককে।
অতএব বলা যায়, ইসলাম তথা রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রবর্তিত অর্থব্যবস্থা এবং এর দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলের সফল বাস্তবায়নে ইসলামের সোনালি যুগে দারিদ্র্য দূরীকরণের যে বাস্তব চিত্র ও ফলাফল পরিলক্ষিত হয়েছিল আজও সে ফলাফল বয়ে আনবে নিঃসন্দেহে। দারিদ্র্যক্লিষ্ট এ সমাজ ও মানবজাতিকে দারিদ্র্যের নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত করে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে ইসলামের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলগুলোর বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। প্রয়োজন শুধু কার্যকর ও সম্পূর্ণভাবে তা গ্রহণ এবং সৎ মানসিকতার। সুতরাং ইসলামের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলগুলোর বাস্তবায়ন আজ সময়ের দাবি।