মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :
আল্লাহর রাহে যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার এক আহবান নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে হাজির হয় পবিত্র ঈদুল আযহা। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কুরবানির রেওয়াজ চলে আসছে। হযরত আদম (আ:)-এর দু’সন্তান হাবিল ও কাবিল কুরবানি করেছিলেন। হাবিল ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে উৎকৃষ্ট জিনিস কুরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়। পক্ষান্তরে কাবিল অনাগ্রহ ও নিকৃষ্ট জিনিস উৎসর্গ করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। কুরবানি মানব সমাজে সবসময়ই কোন না কোনভাবে চালু ছিল। আমাদের প্রতিবেশী হিন্দুসমাজেও বলিদান প্রথা চালু আছে। বর্তমান মুসলিম সমাজে চালুকৃত কুরবানি মূলত হযরত ইবরাহীম (আ:) ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগের স্মরণ হিসেবে চলে আসছে। হযরত ইবরাহীম (আ:) যখন আদরের সন্তানের গলায় ছুরি চালাচ্ছিলেন সে সময় আল্লাহপাক এক জন্তুর বিনিময়ে হযরত ইসমাঈল (আ:)কে ছাড়িয়ে নেন। এ দৃশ্য ছিল অভাবনীয় এবং আল্লাহর কাছে ছিল খুবই প্রীতিপূর্ণ। স্মরণ হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি পশু কুরবানি জারী করে দেন। তাঁর ভাষায়-‘অনাগত মানুষদের জন্য এ বিধান চালু রেখে তার স্মরণ আমি অব্যাহত রাখলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহীমের প্রতি’-আছ ছাফফাত: ১০৮-১০৯। কুরবানি সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্নের জবাবে রসূল (সা:) বলেছিলেন ‘তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ:)-এর সুন্নাত’।
কুরবানি অর্থ ঝধপৎরভরপব বা ত্যাগ স্বীকার। এর আর একটি অর্থ নৈকট্যলাভ। অর্থাৎ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই নৈকট্যলাভ সম্ভব বিধায় একে বলা হয় কুরবানি। মানব সমাজেও এ নৈকট্য মূলত ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। মাতা-পিতার সাথে সন্তানের নৈকট্যের মূলে রয়েছে পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নৈকট্যের মূলেও রয়েছে ত্যাগের মনোবৃত্তি। আমাদের বৈষয়িক জীবনের সাফল্যও ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়েই কেবল সম্ভব। যে শিক্ষার্থী নিজের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে রাত জেগে লেখাপড়া করে সাফল্য তাকেই ধরা দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ, চাকুরি, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে এটিই সত্য। রাজনীতির ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন বহুল প্রচলিত।
এ পৃথিবীতে ত্যাগ স্বীকারের মানদণ্ডে মানুষকে মূল্যায়ন করা হয়। যে সন্তান তার পিতা-মাতার জন্য যত বেশি ত্যাগ স্বীকার করে সে তত বেশি নৈকট্য লাভ করে। তেমনিভাবে কর্মী তার ত্যাগের ভিত্তিতে নেতার এবং অফিস-আদালতে অধীনস্থরা ত্যাগের মানদন্ডে বসের নৈকট্য লাভ করে। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কটাও ত্যাগের মানদণ্ডেই নির্ণিত হয়। আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা ও তাঁর হুকুম পালনেও ত্যাগ অপরিহার্য। এমন কি মুসলমান হওয়ার জন্য প্রাথমিক শর্ত নামাজ ও যাকাতের মত ইবাদতও ত্যাগ ও ধৈর্য ছাড়া সম্ভব নয়। সকল ব্যস্ততা ও আরামদায়ক ঘুম উপেক্ষা করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় ও হিসেব করে যাকাত প্রদান অতি ত্যাগি ও ধৈর্যশীলদের পক্ষেই সম্ভব। এরপর আল্লাহপাকের আরো নৈকট্যলাভের জন্য তাহাজ্জুদের নামাজ এবং দুস্থ মানুষ ও আল্লাহর দ্বীনের প্রয়োজনে অকাতরে নিজের ধন-সম্পদ দান অসীম ধৈর্য ও ত্যাগের মাধ্যমেই সম্ভব।
মানুষ আল্লাহপাকের সার্বক্ষণিক গোলাম ও প্রতিনিধি। গোলাম ও প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ তার মনিব আল্লাহ তা‘য়ালার বিধান নিজেরা যেমন মেনে চলবে সাথে সাথে সমগ্র মানবগোষ্ঠী যাতে মেনে চলতে পারে সে পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করাও তার দায়িত্ব এবং মানুষ যাতে প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে সেজন্য নিয়ম-বিধানও আল্লাহপাক দিয়েছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টি প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ:)-কে দুনিয়ায় প্রেরণের সময়ই এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ‘আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই’-বাকারা ৩৮। সাথে সাথে সতর্কও করে দেন যে ‘শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’-বাকারা ১৬৮। এ পৃথিবীতে আছে একদিকে নবীদের মাধ্যমে পাওয়া আল্লাহর বিধান যা অনুসরণ করে দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতে নেয়ামতে ভরা জান্নাত এবং বিপরীত বিধান হলো শয়তানের যা, অনুসরণ করে পৃথিবীতে অশান্তির সাথে সাথে দুঃখ-কষ্টের চিরস্থায়ী আবাস জাহান্নাম। দু’টি পথই স্পষ্ট-প্রথমটি: আল্লাহর বিধানের অনুসারী ঈমানদারদের পথ আর দ্বিতীয়টি: শয়তানের অনুসারী কাফিরদের পথ।
কুরআনের ভাষায়-‘যারা ঈমানের পথ গ্রহণ করেছে তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে, আর যারা কুফুরির পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। তোমরা শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই কর আর বিশ্বাস কর শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’-আন নিসা ৭৬। ফলে পৃথিবীতে হক ও বাতিলের এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব-সৃষ্টির সূচনা থেকে চলে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে যত নবী-রসূল এসেছেন তাদের প্রায় সবাইকে সমসাময়িক রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে এবং সবাই নানাভাবে নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েছেন। তাঁদেরকে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অথচ তাঁরা সবাই ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী এবং দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কোন শত্রুতা বা ষড়যন্ত্রের কোন অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে ছিল না। আল্লাহ তা‘য়ালা নিজে বা কোন জালেম শাসকের মাধ্যমে নবী-রসূল এবং তাঁদের সাথীদের পরীক্ষা নিয়েছেন। দুনিয়ার সামান্য জীবনের বিনিময়ে আখিরাতে অনন্তকালের জান্নাতি সুখ অবশ্যই ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়েই অর্জন করতে হবে।
আল্লাহপাকের বাণী ‘আল্লাহ মু‘মিনদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে মারে ও মরে। তাদের প্রতি জান্নাত দানের ওয়াদা আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা’-তাওবা ১১১।
বান্দাহর পরীক্ষা গ্রহণ আল্লাহর এক স্থায়ী নিয়ম। তাঁর ভাষায় ‘আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে ভয়-ভীতি, অনশন, জানমালের ক্ষতি ও আমদানি হ্রাসের দ্বারা পরীক্ষা করবো। বিপদ-মুছিবত উপস্থিত হলে যারা ধৈর্য ধারণ করে ও বলে যে আমরা কেবল আল্লাহরই জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব। তাদের জন্য সুসংবাদ’-বাকারা ১৫৫-১৫৬। অসংখ্য নবী-রসূল ও তাঁদের অনুসারীরা জীবন ও সম্পদের কুরবানি দিয়ে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সম্মানিত হয়েছেন ও জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। আর তাঁদের মোকাবিলায় শয়তানের অনুসারী জালেম শাসক নমরুদ, ফেরাউন, শাদ্দাদ, হামান, কারুণ, আবু জেহেল, আবু লাহাব, উৎবা ও তাদের অনুসারীরা ইতিহাসে ধিকৃত হয়েছে এবং জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে।
আমরা যে পশু কুরবানি করি তা মূলত প্রতিকী। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ:)। তিনি এক পুরোহিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে চতুর্দিকে মূর্তিপূজার সয়লাব লক্ষ্য করেন এবং তাঁর পিতা স্বৈরশাসক নমরুদের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। মূর্তির অসারতা প্রমাণের জন্য একদিন তিনি মন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন। যেহেতু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মূর্তিপূজা তাই ইবরাহীম (আ:)-এর এ আচরণকে রাষ্ট্রদ্রোহীতা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। কেউ যাতে এ জাতীয় আচরণ ভবিষ্যতে না করতে পারে সেজন্য এ দণ্ড আগুনে পোড়ায়ে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেখান থেকে রক্ষা পাওয়ার পর তাঁর জাতির মধ্যে যখন কোন সম্ভাবনা খুঁজে পেলেন না তখন দ্বীনের দাওয়াতের লক্ষ্যে দেশ ত্যাগ করে তিনি অজানা পথে রওয়ানা হন। নিজের রুটি-রুজির কোন চিন্তা ছিল না, ছিল না কোন আশ্রয়ের; কেবল আল্লাহরই ওপর ভরসা করে তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁর এ যাত্রা। এরপর আল্লাহরই নির্দেশে বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া দুগ্ধপোষ্য শিশু ও স্ত্রীকে নির্জন স্থানে রেখে আসেন। পরীক্ষার পর পরীক্ষা। ছেলে দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হলে সে সময় আল্লাহপাক নির্দেশ দেন প্রিয় জিনিসকে কুরবানি করতে। তিনি পশু কুরবানি করেন, কিন্তু একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর ছেলে। তাই তাঁর স্বপ্নের কথা স্ত্রী ও সন্তানকে জানান। তাঁরাও ছিলেন ইবরাহীম (আ:)-এর মত মুসলিম। ছেলে বললেন-‘আব্বা! আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন’-আছ ছাফফাত: ১০২।
আল্লাহপাক এক বড় কুরবানির বিনিময়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নেন এবং পরবর্তিকালে স্মরণ হিসেবে ঘোষণা করে দেন। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজের জীবন, ধন-সম্পদ ও রুটি-রুজির চিন্তা পরিহার, মাতৃভূমি, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মায়া সবকিছু ত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন হযরত ইবরাহীম। ত্যাগ ও কুরবানি যত বড়, পুরস্কারও তত বড়। তাঁকে ইমাম ও মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হজে¦র অনুষ্ঠানাবলীর মধ্যে ইবরাহীম (আ:)-এর পরিবারের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যেমন- মাকামে ইবরাহীমে সালাত আদায়, সাফা-মারওয়া সায়ী করা, জমজম কূপের পানি পান ও মিনায় কুরবানি করা এবং কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ্ এখান থেকে প্রেরণা লাভ করবে।
কুরবানির গুরুত্ব বর্ণনা করতে যেয়ে রসূল (সা:) বলেন, ‘ঈদের দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই’, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করবে না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে’, ‘কুরবানিদাতাকে তার পশুর শরীরের পশমের সমপরিমাণ সওয়াব দেয়া হবে এবং রক্ত যমিনে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়’। কুরবানি নিজ হাতে দেয়াটাই উত্তম। একান্ত সম্ভব না হলে কুরবানিদাতা যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। মূলত কুরবানি হলো রক্ত প্রবাহিত করা ও রক্ত দর্শন করা। কুরবানির পশু জবেহ করার সময় কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই দিয়ে থাকে-‘নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান এবং আমার জীবন ও মৃত্যু কেবল আল্লাহরই জন্য’-আল আনয়াম ১৬২। অর্থাৎ আমি আমার নই, আমার পরিবার ও জাতিরও নই। আমি একান্তভাবে আল্লাহর। আমার বেঁচে থাকাটা হবে আল্লাহর জন্য এবং আমার মৃত্যুও হবে আল্লাহরই জন্য। আমি এ পৃথিবীতে আমার, আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও দেশবাসীর জন্য যা কিছু করি তা আল্লাহরই নির্দেশক্রমে।
আল্লাহর পথে ত্যাগ ও কুরবানির নজির শুধু ইবরাহীম (আ:) নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সকল নবী-রসূল ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জীবনে ঘটেছিল। হযরত মুসা (আ:), ইসা (আ:), জাকারিয়া (আ:), ইউসুফ (আ:), আইয়ুব (আ:), নূহ (আ:), ইউনুস (আ:) এবং আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা:) ও তাঁর সাথীদেরসহ অতীতকালের সকল ঈমানদারদের জীবনেই ঘটেছিল। কুরআন মজিদে ঈমানদারদের নিপীড়ন-নির্যাতনের কথা বেশি উল্লেখ রয়েছে এবং লক্ষণীয় হলো, যিনি যতবেশি আল্লাহর প্রিয়ভাজন ও নৈকট্যপ্রাপ্ত তিনি ততবেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। এদিক দিয়ে আম্বিয়ায়ে কেরাম প্রথম কাতারে-আল্লাহর পক্ষ থেকে কখনো আবার জালেমদের পক্ষ থেকেও পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। বিপরীতভাবে জালেমদের করুণ পরিণতির কথা কমই উল্লেখ রয়েছে; যেমন- নমরুদ, ফেরাউন, শাদ্দাদ, কেনান, আবু লাহাবসহ কয়েকজন। অবশ্য অতীতকালে জাতিগতভাবে ধ্বংসের কথা কুরআন মজিদে বেশ উল্লেখ রয়েছে। শেষ নবী ও তাঁর সাথীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনও ছিল অবর্ণনীয়। মক্কায় দীর্ঘ ১৩ বছর একতরফাভাবে শুধুই নির্যাতিত হয়েছেন। আবার আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাও কম নয়। একে একে পুত্রসন্তানদের ইন্তিকাল ছিল নবীর (সা:) জন্য চরম দুঃখ ও বেদনার। সে সময়ে বংশের লোকদের কাছ থেকে শান্তনার পরিবর্তে তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল বিদ্রুপ ও উল্লাস।
আল্লাহপাক তাঁকে শান্তনা দিয়েছিলেন এবং কাওছার দানের সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন। কাওছার অর্থ সীমাহীন প্রাচুর্যতা- নাম, যশ, খ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, কর্তৃত্ব সবকিছু। সহায়-সম্বলহীন ও চরমভাবে উপেক্ষিত-নির্যাতিত মানুষটিই অল্প দিনের ব্যবধানে মদীনায় একটি সফল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাসের সবচেয়ে সম্মান, মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন এবং যশ-খ্যাতি বলতে যা বুঝায় সবই তাঁর, পক্ষান্তরে তাঁর শত্রুরাই হলো জড়কাটা ও শিকড়কাটা। কাওছার লাভ ও টিকিয়ে রাখার জন্য আল্লাহ শর্ত জুড়িয়ে দিয়েছেন ‘তোমার রবের উদ্দেশ্যে নামায পড় ও কুরবানি কর’-কাওছার। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য একনিষ্ঠভাবে নামাজ আদায় এবং সবধরনের জুলুম-নির্যাতনের মোকাবিলায় পরম ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকার। রসূল (সা:)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার সয়লাব বয়ে চলেছিল এবং যেখানেই তাঁর পক্ষ থেকে দাওয়াত দান সেখানেই বাধা। কুরআনের প্রতি ছিল তাদের ভয়ানক বিদ্বেষ। ফলে রসূল (সা:)-এর কুরআন পাঠে তাদের ঘোর আপত্তি। কুরআনের ভাষায়-‘এই কাফিররা বলে তোমরা কখনই কুরআন শুনবে না, আর যখনই কুরআন শোনানো হয় তখনই শোরগাল করবে, হয়তো তোমরা জয়ী হবে। আমি অবশ্যই এ কাফিরদের কঠিন আযাবের স্বাদ আস্বাদন করাবো এবং নিশ্চয়ই সে কাজের প্রতিফল দেব, যে আচরণ তারা করে এসেছে। এ জাহান্নামই হচ্ছে আল্লাহ তা’য়ালার শত্রুদের পাওনা, সেখানে তাদের জন্য চিরস্থায়ী আযাবের ঘর থাকবে’-হা-মী-ম আস সাজদা ২৬-২৮। আবু জেহেল-আবু লাহাবদের শতমুখে প্রচারণা আর তার মোকাবিলায় রসূল (সা:)-এর পক্ষ থেকে একক প্রচার কাফিররা বরদাশত করতে পারেনি। তাই তিনি গোপনে দাওয়াত দিতে থাকেন এবং টের পেলেই ইসলামের শত্রুরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হযরত বিলাল (রা:)-এর গভীর রাতে নামাজ আদায় তার মনিব সহ্য করতে পারেনি-তপ্ত বালুর ওপর শোয়ায়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ চিত্র আজও দৃশ্যমান। কুরআনের আওয়াজ স্তব্ধ। বাসাবাড়ীতে পর্দানশীন মহিলারা একত্র হয়ে দ্বীনের আলোচনা করলে বলা হয় নাশকতার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে-ইসলামী বই-পুস্তক পেলে মুখস্থ কথা জিহাদী বই-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামপন্থী ছেলে-মেয়ে পেলে ইসলামের শত্রুরা হামলে পড়ে-এসব ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। আগুনের গর্তে ঈমানদারদের নিক্ষেপ করে কাফিরদের যে উল্লাস আজ ঠিক কুরআনের প্রচারক বরেণ্য আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের শাস্তিদানের মাধ্যমে একই উল্লাস লক্ষণীয়। জলন্ত আগুনের গর্তে নিক্ষিপ্ত ব্যক্তিবর্গের অপরাধ আল্লাহর ভাষায়-‘তাদের অপরাধ এই যে তারা পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল’-বুরুজ ৮। পরকাল অবিশ্বাসের কারণেই মূলত তাদের এজাতীয় আচরণ। জাহান্নামই তাদের পরিণতি। কুরআনের ভাষায়-‘যারা ঈমানদার নর ও নারীকে কষ্ট দেয় অতঃপর তাওবা করে না, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’-বুরুজ ৯। পক্ষান্তরে ঈমানদারদের পরিণতি কুরআনের ভাষায়-‘যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহমান; এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য’-বুরুজ ১১।
এটাই মুমিনদের বড় সান্ত্বনা। সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনে মুমিনদেরকেও হতাশায় পেয়ে বসে এবং তারা ভাবে আল্লাহ কি জালেমদের শাস্তি দিতে পারেন না? হ্যাঁ, পারেন। তিনি তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারেন, চেহারাকে শুকরের চেহারায়ও পরিণত করে দিতে পারেন। তিনি চাইলে ইসলামের বিরুদ্ধে সকল তৎপরতা নিমেষেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাহলে তো আর পরীক্ষা হবে না বা পাপ-পুণ্যের বদলা দেয়ারও প্রয়োজন হবে না। জালেম চরম সীমালঙ্ঘন করলে অনেক সময় আল্লাহপাক পাকড়াও করে থাকেন। তবে বুঝতে হবে দুনিয়া আমল করার জায়গা প্রতিদান পাওয়ার স্থান হলো আখিরাত। আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত অনেকে শুধুই নির্যাতিত হয়েছেন এবং পরম ধৈর্য অবলম্বন করে গেছেন প্রতিপক্ষের প্রতি কোন ক্ষোভ বা অমঙ্গল কামনা ছাড়াই। সূরা ইয়াসিনে এমন একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি লোকালয়ে হেদায়াতের জন্য আল্লাহপাক তিনজন রসূল প্রেরণ করেন এবং তাঁদের দীর্ঘ চেষ্টা-প্রচেষ্টার পর একজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর সে তার জাতির কাছে ছুটে এসে বলেন, ‘তোমরা আনুগত্য কর সেই রসূলদের যারা তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চান না এবং নিজেরা হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত’-ইয়াসিন ২১।
এ কল্যাণকামী লোকটিকে শেষ পর্যন্ত তার জাতির লোকেরা হত্যা করে এবং এর বদলে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয় দাখিল হও জান্নাতে। লোকটি তখন বলে ওঠলো-‘আফসোস, আমার জাতির লোকদের জন্য; তারা যদি জানতে পারতো কিসের বদৌলতে আমার রব আমাকে ক্ষমা করলেন ও সম্মানিত লোকদের মধ্যে গণ্য করলেন’-ইয়াসিন ২৭। অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন প্রতিশোধ আকাঙ্খা নয়, কোন অমঙ্গল কামনাও নয় বরং তাদের গোমরাহী স্মরণে দুঃখ-ভারাক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার নয়: এটা সম্ভব অত্যন্ত শরীফ ও আল্লাহর মকবুল বান্দার পক্ষেই।
আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেছেন-‘ভালো ও মন্দ কখনই এক নয়; তুমি মন্দকে দূর কর সেই ভালো দ্বারা যা অতীব উত্তম তাহলে দেখবে তোমার জানের দুশমনরা প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে। আর এ গুণ কেবল তারাই লাভ করে যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং এ লোক শুধু তারাই হয় যারা সৌভাগ্যের অধিকারী’-হা-মী-ম আস সাজদা ৩৪-৩৫।
আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাসীদের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় সৎ গুণাবলীর অস্তিত্ব। মাদ্রাসা শিক্ষিত ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীরা ইসলামী আদর্শের অনুসারী কেবল তারাই দাবী করতে পারে তারা নেশামুক্ত; পিতা-মাতা, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই তাদের থেকে নিরাপদ। অথচ মিডিয়া প্রতিনিয়ত ভয়ঙ্করভাবে তাদেরকে উপস্থাপন করছে। তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। তারপরও সত্যের নিজেরই একটি শক্তি রয়েছে। অবশ্য এ কৌশল নতুন নয়-এ কৌশল নমরুদ, ফেরাউন, আবু জেহেল, আবু লাহাবদের। পৃথিবীর সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী মহানবী (সা:)-কে জালেমরা কম কষ্ট দেয়নি। তাদের মিথ্যা প্রচারণায় এক বুড়ি নবীর প্রতি এত ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে নবী ও তাঁর পরিবারকে কষ্ট দেয়া সে তার কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ক্রমাগত মিথ্যা বলার প্রেক্ষিতে জাতির একটি অংশ বর্তমানে আলেম-ওলামা ও ইসলামী শক্তির প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় ইসলামী শক্তিকে আল্লাহর অভিপ্রায় অনুসারে পরম ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে। সাধারণ মানুষের এ বিভ্রান্তি একান্ত ক্ষণস্থায়ী। ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে এ বিভ্রান্তি দূর হতে পারে। যেমন রসূল (সা:) একদিন তাঁর পথে কাঁটা না পাওয়ায় খোঁজ করে দেখেন যে বুড়ি অসুস্থ। সেবা-যত্ন করে বুড়িকে সুস্থ করে তোলার পর বুড়ি জানতে পারে এ ব্যক্তিই হলেন তার চরম শত্রু মুহাম্মদ। বুড়ি সেদিন তাজ্জব বনে গিয়েছিল এবং আবু লাহাবদের মিথ্যা প্রচারণার মুখোশও তখন খুলে গিয়েছিল। মিথ্যা প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার পরিণতিতে যারা আখিরাতে শাস্তির সম্মুখীন হবে তারা সেদিন বলবে-(কুরআনের ভাষায়) ‘হে আমাদের মালিক, যে সব জ্বিন ও মানুষ আমাদের দুনিয়ায় গোমরাহ করেছিল, আজ তুমি তাদের এক নযর দেখিয়ে দাও, আমরা তাদের পায়ের নীচে রাখবো যাতে করে তারা আরো বেশি লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়’-হা-মী-ম আস সাজদা ২৯।
বিশ্বব্যাপি ইসলামপন্থীরা এখন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড সুদীর্ঘকাল নিষিদ্ধ ছিল, তাদের অনেক নেতা-কর্মী শাহাদৎ বরণ ও জেল-জুলুমের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তারপরও মিশরে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কোন প্রতিশোধ না নেয়া এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করে সেনাশাসন জারি এবং কয়েক সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে শহীদ, বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীকে কারারুদ্ধ ও সম্পদ জব্দ করার পরও নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ঘোষণা সত্যিই আল্লাহপাকের রহমতই বলতে হয়। ইহুদী ও মুশরিকরা চায় ইসলামপন্থীরা তাদের ফাঁদে পড়ে সন্ত্রাস করুক ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ুক। আল্লাহপাক নবীর মাধ্যমে মুমিনদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন-‘যদি কখনো শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে তুমি আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আশ্রয় চাও, অবশ্যই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’-হা-মী-ম আস সাজদা ৩৬।
সকল বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্টে মুমিনদের উচিৎ কেবল আল্লাহরই ওপর ভরসা করা। আল্লাহর ভাষায়-‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তাছাড়া আমাদের কাছে আর কিছুই পৌঁছবে না। তিনি আমাদের অভিভাবক। আল্লাহর ওপরই মু‘মিনদের ভরসা করা উচিত’-আৎ্-তাওবা।
ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভই কুরবানির উদ্দেশ্য। বছরে একবার পশু কুরবানি করাটাই যথেষ্ট নয় বরং পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে কুরবানিদাতা যে ঘোষণা দিয়ে থাকেন সেটাই মুখ্য। আল্লাহ তা‘য়ালা বান্দাহর তাকওয়া দেখতে চান। তাঁর ভাষায়-‘আল্লাহ তা‘য়ালার কাছে কুরবানির গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না। বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াটুকুই পৌঁছায়’-আল হাজ্জ ৩৭।
ইবরাহীম (আ:) আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের জীবন, স্ত্রী-সন্তান, বাড়ী-ঘর, মাতৃভূমি, পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে আয়েশী জীবনের হাতছানি সবকিছুই ত্যাগ করলেন। আমরা কি পারিনা তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে তাঁর সকল ফরজসমূহ প্রতিপালন ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে। সুদ, ঘুষ, ভেজাল প্রদান, ধোকা-প্রতারণা, জুয়া, ওজনে কম-বেশি করা, কর্তব্য-কর্মে ফাঁকি দেয়া, খেয়ানত করা, আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান, গীবৎ সবই হারাম। এ সব অপরাধের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তি আল্লাহ থেকে অনেক দূরে। তাওবা করে সংশোধিত না হলে জাহান্নামই তাদের ঠিকানা। নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ, কুরবানি সবই মূলত মানুষকে তাকওয়াসম্পন্ন করার লক্ষ্যে। মানুষের মধ্যে যথার্থ তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি বা কর্মজীবনে তার বহিঃপ্রকাশ না ঘটলে এ সব ইবাদত-অনুষ্ঠান মূল্যহীন ও পন্ডশ্রম বৈ আর কিছুই নয়। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানদের দেশে আমাদের আমল-আখলাক, আচার-আচরণ, লেন-দেন, ব্যবসা-বণিজ্য কোথাও ইসলামের ছাপ লক্ষণীয় নয়। আমাদের অফিসগুলোয় ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না; অথচ আমরা জানি ঘুষ দানকারী ও গ্রহণকারী উভয় দোযখী। ঘুষের লেন-দেনকারী ব্যক্তি যদি মনে করে তার নামাজ, যাকাত, হজ¦, কুরবানি তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে তাহলে তো বলতেই এ লোকটি রসূল (সা:)-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে নিয়েছে। জান্নাতের প্রত্যাশি হলে দুনিয়ার স্বার্থটুকু তাকে কুরবানি করতেই হবে। অফিস-আদালতে খেয়ানত খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের বাইরে অফিসের সামান্য কোন জিনিস ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। রসূল (সা:) বলেন, ‘কাউকে কোন দায়িত্ব প্রদান করা হলে এক টুকরো সূতা বা তার চেয়েও কোন ক্ষুদ্র জিনিস যদি সে খেয়ানত করে তাহলে খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে’। অফিস-আদালতে কর্তব্য-কর্মে ফাঁকি দেয়া, মানুষকে হয়রানি করা সবই কবিরা গুনাহ-জাহান্নামের যাওয়ার কারণ। রসূল (সা:)-এর বাণী, ‘কাউকে কোন দায়িত্ব প্রদান করা হলে সে তার নিজের কাজ যত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে অর্পিত দায়িত্ব যদি সেভাবে না করে তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে উল্টা করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’। আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দান, সাক্ষ্যদানে কাউকে প্ররোচিত করা, জেনে-বুঝে সে মিথ্যার পক্ষ অবলম্বন পরকালে বিশ্বাসী কোন মুসলমানের কাজ নয়; এ কাজ নিরেট একজন মুশরিকের এবং জাহান্নামই তার ঠিকানা। সমাজ ও সমাজের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন সকল কাজই কবিরা গুনাহ এবং তাওবা করে নিজেকে সংশোধন করে না নিলে জাহান্নামই হবে তার আবাসস্থল। আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত ইবাদত-অনুষ্ঠানাদি পালনে ত্রুটি করলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা পাওয়া সম্ভব কিন্তু আল্লাহর বান্দাদের সাথে সম্পর্কিত হলে বান্দাহ ক্ষমা না করা পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রসূল (সা:) একদিন সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমাদের মাঝে সবচেয়ে দরিদ্র কে?-সাহাবীরা (রা:) জবাবে বললেন যে, যার টাকা পয়সা নেই। রসূল (সা:) বললেন-না, সবচেয়ে দরিদ্র সে, যে নামাজ-রোজা, হজ¦, যাকাতের মত ইবাদত বন্দেগী পালনের সাথে সাথে মানুষের হক নষ্ট করে, গালি দেয়, জুলুম করে। কিয়ামতের দিন মজলুমকে তার বদলা হিসেবে জালেমের নেক আমলসমূহের সাওয়াব দিয়ে দেয়া হবে এবং যখন পূরণ হবে না মজলুমের গুনাহ জালেমকে দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’। তাই কুরবানি বিশেষ একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিটি ক্ষণ প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর আদেশ পালনে ধৈর্য অবলম্বন এবং আল্লাহর নিষেধ থেকে বিরত থাকার লক্ষ্যে সকল প্রকার বৈষয়িক স্বার্থ উপেক্ষা করার জন্য সর্বক্ষণ নিজেকে প্রস্তুত রাখা। সর্বোপরি আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর বিধান কায়েমে সকল ঝুঁকি ও বিপদাপদে অবিচল থাকার মাধ্যমেই কেবল ইব্রাহীম (আ:)-এর সার্থক অনুসারী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে সে চেতনায় সমৃদ্ধ করুন। আমীন।