কাজিরবাজার ডেস্ক :
সড়ক-মহাসড়কে এখন আতঙ্কের নাম মোটরসাইকেল। গবেষণায় উঠে এসেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তা বিশ্বে সর্বোচ্চ। দেশে দু’চাকার এ যানটির উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় দাম যেমন কমেছে, সহজে মিলছে নিবন্ধন, তেমনি পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও যেন সহজ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে। লোনে, কিস্তিতে বা সামান্য টাকা হলেই মোটরসাইকেল কিনতে পারছে। কিন্তু তাতে যে মৃত্যুঝুঁকি কত বাড়ছে- সেটা যেন কেউ চিন্তা করছে না। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যানবাহন চালুর প্রথম দিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় দু’চাকার এই যানটি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়- তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়ে তুলেছে।
সড়ক পথে বেপরোয়া গতিতে দাবড়িয়ে বেড়ানো মোটরসাইকেলগুলো এখন ভয়াবহ আতঙ্ক। দেশে অনিরাপদ সড়ক আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পাল্লা দিয়ে মাঠে নামায় এই দু’চাকার যানটি। ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক ও সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্কট তো রয়েছেই। নিরাপদ সড়ক আইন কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। সারাদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষজন হতাহত হন, দেশের সকল দুর্ঘটনা মিলেও এত মানুষজন হতাহত হন না। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শীর্ষ কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মোটরসাইকেল। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, মার্চে সারাদেশে ৫৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭৯ জন। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাতেই মারা গেছেন ২২১ জন। শতকরা হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৩৭ দশমিক ৫২ ভাগই মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর চলাচল শুরুর প্রথম দিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুইজনের মৃত্যুর পর সেতুতে এই বাহনটি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মোটরসাকেল চালকদের সেতু পারাপার করার নানা কৌশল নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই আলোচনা চলছে। কর্মকর্তাদের দাবি, মোটরসাইকেল চালকদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং বেপরোয়া চলাচল এড়াতে তারা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে দুই মোটরসাইকেল চালকের দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সেতুর ওপর পড়ে থাকা, উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যুর ঘটনা সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিও সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরের দিন ২৬ জুন সকাল ৬টা থেকে সকল ধরনের যানবাহনের জন্য খুলে দেয়ার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুই যুবক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হন। আহত অবস্থায় দুই যুবককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। নিহতরা হলেন- মোঃ আলমগীর হোসেন (২২) ও মোঃ ফজলু (২১)। নিহত দুই যুবকের বাড়িই দোহার থানা এলাকায়।
গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২০ সালের তুলনায় মাত্র দু’বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৫১ শতাংশ। নিহতদের বেশিরভাগের বয়স ৩০ বছরের নিচে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয় এমন ১৬টি দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে ২৮ দশমিক ৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাংলাদেশে রীতিমতো গণআন্দোলনের নজির থাকলেও সেই আন্দোলনের কোন সুফল পায়নি দেশের মানুষ। সড়ক-মহাসড়কে এখনও মৃত্যুর মিছিল চলছে। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসেনি, অনুমোদনহীন যানবাহন রাস্তায় নামছে প্রতিদিনই। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে দুর্ঘটনায় মৃেতর সংখ্যা বাড়ছে।
হাড়ভাঙ্গা চিকিৎসায় দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) অর্থাৎ পঙ্গু হাসপাতাল। হাসপাতালটির জরুরী বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ৩৪ জন চিকিৎসা নেন। তাদের ১৬ জনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। কেউ চালক, কেউ আরোহী এবং কেউ পথচারী। সম্প্রতি পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন ২ হাজার ৪৮২ জনের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ৫৮৫ জন। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া প্রায় ৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। সম্প্রতি শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিংয়ে থাকা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষ আসার সংখ্যাও বাড়ছে বলে পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের এআরআই ও নিসচা। নিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ ট্রাক ও ২২ শতাংশ বাস দুর্ঘটনা। বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮টিতে, মারা যান ১ হাজার ৯৭ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভাল মানের একটি হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আর মৃত্যুঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশ। বড় শহরের বাইরে হেলমেট না পরার প্রবণতার বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, হেলমেট না পরার কারণে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে।
বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে। এতে উঠে আসে ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেন। একই সংস্থার করা আরেক জরিপে এসেছে, চালকের ৩০ শতাংশ অতি নিম্নমানের হেলমেট পরেন। মাত্র ২ শতাংশ ক্ষেত্রে আরোহীদের ‘ফুলফেস’ হেলমেট দেয়া হয়। এআরআইয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল চালকদের প্রতিযোগিতা ও ফাঁক গলে আগে যাওয়ার প্রবণতা দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ।
রাইড শেয়ারিং এ্যাপের বাহনগুলোর দুর্ঘটনার সংখ্যা কত তা জানা নেই উবার কর্তৃপক্ষের। তবে তারা বলেছেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য ২ লাখ টাকা ও হাসপাতালে ভর্তি হলে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা বীমাসুবিধা দেয়া হয়। উবার জানিয়েছে, তারা সেরা মানের হেলমেট ব্যবহারে উৎসাহ দেয়। সহজ ডটকম কর্তৃপক্ষ বলেছেন, রাইড শেয়ারিং এ্যাপে ব্যবহার করা চালকদের দুর্ঘটনা ঘটেছে, এমন তথ্য তাদের কাছে নেই।
মোটরসাইকেল বিপণনকারী একটি বহুজাতিক কোম্পানির পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বড় কারণগুলোর একটি হলো ওভারটেকিং। এ ছাড়া ক্লান্তি নিয়ে চালানো এবং তাড়াহুড়া করাও অন্যতম কারণ। বাস, ট্রাক, লেগুনা ও প্রাইভেট কারের বেপরোয়া চালনা ও হঠাৎ লেন পরিবর্তন, অযান্ত্রিক যানবাহনের হুটহাট মোড় ঘোরানো ও লেন পরিবর্তন, রাস্তায় হঠাৎ গর্ত, ম্যানহোলের উঁচু অথবা নিচু ঢাকনা ও গতিরোধকে চিহ্ন না থাকা, পথচারীদের অসতর্কতা এবং হঠাৎ করে কুকুর, গরু-ছাগল রাস্তায় চলে আসাও দুর্ঘটনার বড় কারণ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এই মৃত্যুর হার দিন দিন বাড়ছে। মোটরসাইকেল যারা চালান, তাদের বড় একটি অংশ কিশোর-তরুণ। এরা বেপরোয়া, ট্রাফিক আইন জানে না বা মানে না। অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই। যাদের আছে, তারাও যোগ্য নয়। তারা নিজেরা যেমন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, তেমনি অন্যরা তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই ১৪ থেকে ৪০ বছর বয়সী। যানজটের কারণে মোটরসাইকেল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। গ্রামগঞ্জে এটা চালাতে লাইসেন্স লাগে না, হেলমেট লাগে না। অন্যান্য দেশে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা হয়। আর আমাদের এখানে উৎসাহিত করা হয়। কিস্তিতেও মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। কিন্তু এটা অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চন গণমাধ্যমে বলেছেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মোটরসাইকেল আরোহী যে ছাত্রীটি কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় মারা গেলেন, তার পরিবারও তাকে মোটরসাইকেল (স্কুটি) চালাতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু গণপরিবহনের সঙ্কট ও ট্রাফিক জ্যামের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল চালাতে বাধ্য হচ্ছে। বিআরটিএর উচিত, যারা চালাতে পারে তাদের লাইসেন্স দেয়া। আসলে আমরা যতই বলি, কেউ দায়িত্ব নিচ্ছেন না, মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। ফলে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই। কোন একটা স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটলে তখন আমরা হইচই করি। ২০১৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে একটি জরিপ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ৩৩ ভাগ বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই।
বিআরটিএর রোড সেফটি বিভগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে যে যানবাহন চলাচল করে তার শতকরা ৫০ ভাগের কোন নিবন্ধন ও ফিটনেস নাই। আর সমপরিমাণ চালকের হাতে লাইসেন্স নাই। যে ৫০ ভাগের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, তারা যে সবাই যোগ্য তা নয়। তারা নানা অবৈধ উপায়ে লাইসেন্স জোগাড় করেছে। ফলে দুই দিক দিয়েই সড়ক-মহাসড়ক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। চালকদের অধিকাংশই শারীরিকভাবে গাড়ি চালানোর যোগ্য নয়। আর ফিটনেস পাওয়া যানবাহনের বড় একটি অংশের বাস্তবে ফিটনেস নাই। অনেক গণপরিবহন, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান নক্সার বাইরে গিয়ে বড় করা হয়েছে। অনেক গাড়ি আছে, কাগজপত্র ছাড়া চলাচল করে। অনেক থ্রি-হুইলার আছে, যার কোন কাগজপত্র নাই। আর দেশে লাইসেন্সধারী চালক কত আছে, তার হিসাব থাকলেও লাইসেন্সবিহীন কত আছে, তার হিসাব আমাদের কাছে নাই।
গত রমজান মাস শেষে ঈদের সময়ে চলাচল করা যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল দুই চাকার বাহন মোটরসাইকেল। দূরের যাত্রায় পথে নেমেছিল লাখ লাখ মোটরসাইকেল। গত ঈদের ছুটির চারদিনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কেবল ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালেই মারা গেছেন ৬০ জন। আর চিকিৎসা নিয়েছেন আটশ’ জনেরও বেশি মানুষ, যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ত্রিশের নিচে। সেই সঙ্গে ভর্তি হওয়া রোগীদের একটি বড় সংখ্যাই মোটরবাইক চালক, না হয় আরোহী।
রোজার ঈদে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরবাইকে চড়ে বিভিন্ন জেলায় গেছেন। আর এই সময়ে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের প্রাণ গেছে বলে উঠে এসেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক জরিপে। ঈদ ঘিরে ১৪ দিনে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটি এক প্রতিবেদনে বলেছে, এবার ঈদযাত্রায় সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার, যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
বিষয়টিকে ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে ১৪ দিনে দেশে ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছেন কমপক্ষে দেড় হাজার। এর মধ্যে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই হিসাবে মোট দুর্ঘটনার ৪৫ দশমিক ২২ শতাংশ মোটরসাইকেলের। আর মোট মৃত্যুর ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ঘটেছে এই দুই চাকার বাহনের দুর্ঘটনায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের ঈদযাত্রায় ঢাকা থেকে কমবেশি ৯০ লাখ মানুষ অন্য জেলায় গেছেন। দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৩ কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেন। বাড়ি ফিরতে এবার অন্য বছরের তুলনায় মোটরসাইকেলের ব্যবহারই ছিল বেশি।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের অর্ধেকের বয়সই (৫১.৪২%) ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনার কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং অন্যদেরও বিপদে ফেলছে বলে পর্যবেক্ষণ দিচ্ছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, মোটরসাইকেল উৎপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। ফলে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ছে। এটা সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার মোটরসাইকেলের ব্যবসা করতে গিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার জনসম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির দাবি, সরকারের উচিত- গণপরিবহন উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করে এবং রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা। অপ্রাপ্ত বয়স্করা যাতে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে, সে জন্য কঠোর আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রতিবেদনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ১৬ দশমিক ১৯ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১ দশমিক ৯৫ শতাংশ, অন্য যানবাহনের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে ধাক্কা/চাপায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯ দশমিক ০৪ শতাংশ, অন্যান্য কারণে ঘটেছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের ঈদ-উল-ফিতরের সময়ের চেয়ে এবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছরের ঈদ-উল-ফিতরের সময় ১২১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের চেয়ে ‘৩০ গুণ বেশি’ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মোটরসাইকেল দূরের যাত্রায় কোনভাবেই গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। ঈদযাত্রায় যে সব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেনি, সেগুলো অধিকাংশই গণমাধ্যমে আসেনি জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর কারণে দুর্ঘটনায় আহতের প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনারোধে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দেয়া, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা করা, পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, গণপরিবহন উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে।