বিশ্ব মানবতার শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ (সা.)

95

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী :
শিক্ষা জাতির মেরুদÐ। মেরুদÐহীন মানুষ যেমন দাঁড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি শিক্ষাবিহীন কোনো জাতি পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। মানুষের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত যেসব গুণাবলি ও প্রতিভা সুপ্ত রয়েছে, তার বিকাশ ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে। পবিত্র কোরআনের প্রথম কথাই হলো ‘পড়ো’। মানব জাতির উদ্দেশ্যে এটিই হলো আল্লাহর প্রথম নির্দেশ।
শিক্ষা বিস্তারে রাসূল (সা.)-এর আদর্শ নীতি
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মাত্র ২৩ বছরে মানব জাতির এক অপূর্ব জাগরণ এনে দিয়েছেন। যারা একদিন তাঁর প্রাণের শত্রæ ছিল, তারাই তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করে পরম বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। যেখানে সর্বত্র রক্তক্ষয়ী সংঘাত, খুন-খারাবির আগুন দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিল, সেখানে তাঁর শিক্ষার কারণেই শান্তি ও মীমাংসার ফুল ফুটেছিল। যে সমাজে প্রস্তরনির্মিত মূর্তিগুলোকে সিজদা করা হচ্ছিল, সেখানেই তাওহিদের পতাকা উড্ডীন করা হয়েছিল। প্রিয়নবী (সা.) যে পন্থায় মানুষকে সত্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন, তন্মধ্যে একটি হলো মানুষের প্রতি দয়ামায়া, তাদের কল্যাণ কামনা এবং তাঁর বিনম্র স্বভাব। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে রাসূল (সা.)-এর বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘আল্লাহপাকের অনুগ্রহে (হে রাসূল!) আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয়েছেন, আর যদি আপনি রূঢ় মেজাজ ও কঠিন হৃদয় বিশিষ্ট হতেন, তাহলে এসব লোক আপনার চার পাশ থেকে দূরে সরে যেত।’ (৩ : ১৫৯)
দ্বিতীয়ত, প্রিয়নবী মানুষকে যে কাজের শিক্ষা প্রদান করতেন, তিনি নিজেও সে কাজ করতেন। অর্থাৎ তাঁর উপদেশ বা ওয়াজ-নসিহত শুধু মানুষের জন্য ছিল না বরং নিজে এর ওপর সর্বপ্রথম আমল করতেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক
শিক্ষক এবং শিক্ষা শব্দ দুটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষকের মাধ্যমেই শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটে থাকে। মানব জাতির শিক্ষক মূলত মহান রাব্বুল আলামিন। প্রথমেই তিনি তাদের তাঁর প্রতি আনুগত্য করার শিক্ষাদান করেন। সব মানুষের আত্মাকে একসঙ্গে সৃষ্টি করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই? সব আত্মা সমস্বরে বলে উঠল- হ্যাঁ; আপনিই আমাদের প্রভু’। (৭: ১৭২) মহান আল্লাহ কলমের সাহায্যে মানুষের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু একমাত্র মহান আল্লাহর অতিশয় প্রিয় নবী (সা.)-কে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-এর মারফত মৌখিকভাবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে প্রস্তুত করেন। আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি স্কুল বা মক্তবে পাঠ গ্রহণ করেননি। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে মানুষের জ্ঞান হচ্ছে- ‘উবৎরাবফ শহড়ষিবফমব’ বা সংগৃহীত জ্ঞান। কিন্তু আমাদের নবীজীর জ্ঞান ছিল ‘জবাবধষবফ শহড়ষিবফমব’ বা নাজিলকৃত জ্ঞান। স্বয়ং আল্লাহই ছিলেন তাঁর শিক্ষক। এ কথার যথার্থতা প্রমাণে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন- ‘শপথ নক্ষত্রের, যখন তা অস্তমিত হয়, তোমাদের সঙ্গী (মুহাম্মদ সা.) বিভ্রান্ত নয় এবং বিপথগামী নয় এবং তিনি নিজ ইচ্ছায় কোনো কথা বলেন না, ওহি যা তাঁর কাছে প্রত্যাদেশ হয়। তাঁকে শিক্ষা দেয় এক মহা শক্তিশালী সত্তা’ (৫৩:১-৫)। তাঁর শিক্ষা ছিল নিখুঁত। তাঁর ব্যবহার ছিল নমনীয় এবং আচরণ ছিল উদার ও ভালোবাসাপূর্ণ। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় বান্দা ও রাসুল (সা.)-কে জন্মগতভাবেই শিক্ষকসুলভ আচরণ দান করেছিলেন। তাই তো নবী (সা.) নিজেই বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আমি মু’আল্লিম (শিক্ষক) হিসেবে (দুনিয়ায়) প্রেরিত হয়েছি’। (দারিমী) আল্লাহ বলেন- ‘হে মানুষেরা! আমি তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছি। যে তোমাদের কাছে আমার আয়াত (কোরআন) পাঠ করে শোনায়, তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে, তোমাদের কিতাব ও হিকমত (কোরআন ও বিজ্ঞান) শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যে বিষয়ে কিছুই জানতে না, সেটা শিক্ষা দেয়’ (২ : ১৫১)। আল্লাহ যেখানে নিজেই নবীজিকে শিক্ষা দিয়েছেন, সেখানে নবীজির উক্তিগুলো যে বিজ্ঞানসম্মত হবে, তাতে আর সন্দেহ কোথায়?
মূলত মহানবী (সা.) একজন বিশ্বসেরা শিক্ষক ছিলেন এবং মহান আল্লাহই তাঁকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বানিয়েছিলেন, তাঁর শিক্ষাকে মানুষ অতি সহজেই গ্রহণ করতে বাধ্য হতো এবং তাঁর পদতলে এসে আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামে দীক্ষিত হতো। তিনি প্রথমে নিজে শিখতেন এবং পরে অন্যকে সেই জ্ঞান শিক্ষাদান করতেন, ফলে সেই শিক্ষা সহজেই কার্যকর হতো।
শিক্ষাবিস্তারে মহানবী (সা.)-এর বাস্তব পদক্ষেপ
মহানবী (সা.)-এর আগমনের আগে যেখানে সীমাহীন মূর্খতা বিরাজমান ছিল, সম্ভ্রান্ত পরিবারে লেখাপড়া দোষ হিসাবে বিবেচিত হতো। মহানবী (সা.) আগমনের পর সেখানে প্রতিটি ঘর ফিকহ, হাদিস ও তাফসিরের বিদ্যালয়ে পরিণত হয়ে গেল। এতদসত্তে¡ও প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে ফিকহ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ ও শিক্ষাদানের উপযোগী সময় করে নেওয়া খুব কঠিন ছিল। এ কারণে প্রত্যেক দল ও গোত্রের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক লোককে মহানবী (সা.) দায়িত্ব দিলেন, যাতে তারা শিক্ষাদান ও উপদেশ দানের কর্তব্য সম্পাদন করতে পারে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত- ‘আরবের প্রত্যেক গোত্রের একটি দল মহানবী (সা.)-এর কাছে যেত এবং তাঁর কাছে ধর্মীয় বিষয়াদি জিজ্ঞেস করে ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করত।’ শিক্ষা ও উপদেশ দানের বিভিন্ন নিয়ম পদ্ধতি ছিল। প্রথমত, ১০-২০ দিন কিংবা এক মাস দুই মাস অবস্থান করে আকায়েদ বা মৌলিক বিশ্বাস ও অন্যান্য জরুরি মাসয়ালা শিখে নিত। এরপর আপন গোত্রে ফিরে গিয়ে তাদের তা শিক্ষা দিত। উদাহরণস্বরূপ মালেক ইবনে হুয়াইরেস (রা.) প্রতিনিধি দল নিয়ে এসে ২০ দিন অবস্থান করলেন এবং জরুরি মাসয়ালা শিখে নিলেন। দ্বিতীয় পদ্ধতি ছিল খুব স্থায়ী। অর্থাৎ মুসলমানগণ স্থায়ীভাবে মদিনায় বাস করতেন এবং চরিত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতেন। তাদের জন্য ‘সুফ্ফা’ নামের বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এতে বেশির ভাগ ওইসব মুসলমান অবস্থান করতেন, যারা যাবতীয় পার্থিব ক্রিয়া-কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে দিন-রাত ইবাদত ও জ্ঞানার্জনে মগ্ন থাকতেন। মহানবী (সা.) শিক্ষক ও শিক্ষার প্রতি যে অনুরাগী ছিলেন এবং শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতেন এর প্রমাণ নিম্নে বর্ণিত হাদিস থেকে আমরা তার শিক্ষা পাচ্ছি। নবী (সা.) একদিন মসজিদে গেলেন। মসজিদে তখন দুটি মজলিস চলছিল: একটি হচ্ছে জিকিরের মজলিস, অন্যটি পাঠদানের। নবী (সা.) পাঠদান তথা জ্ঞানচর্চার মজলিসটিতে বসলেন এবং মন্তব্য করলেন যে আমাকে শিক্ষকরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। (মিশকাত, কিতাবুল ইলম পর্ব)
শিক্ষাবিস্তারে রাসূল (সা.)-এর বাস্তব পদক্ষেপের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হলো- বদরের যুদ্ধে যুদ্ধাহত বন্দিদের মুক্তিপণ নির্ধারণে। দ্বিতীয় হিজরি ১৭ রমজান শুক্রবার বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে পরাজিত ৭০ জন কাফিরকে বন্দি করে মদিনায় আনা হয়। এসব বন্দির প্রত্যেকের মুক্তিপণ হিসেবে অর্থ জরিমানার নিয়ম ছিল। কিন্তু প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এতটা বিচক্ষণ ছিলেন, তিনি ঘোষণা দিলেন- ‘বন্দিদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তারা ১০ জন করে নিরক্ষরকে শিক্ষাদান করতে পারলে বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পাবে। তিনি এতটা শিক্ষানুরাগী ছিলেন যে মদিনায় মসজিদে নববীর একাংশ ইবাদতের জন্য নির্ধারিত রেখে বাকি অংশের কিছুটা প্রশাসনের জন্য এবং অন্য অংশকে শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহার করেন। এই ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ‘সুফ্ফা’ নামে পরিচিত ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই সুফ্ফাটি দেখাশোনা করতেন এবং হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাইদ আল আ’স (রা.)-কে এখানকার শিক্ষক নিযুক্ত করলেন। এই সুফ্ফাটি অবৈতনিক ছিল এবং এখানে সর্বপ্রকার লেখাপড়ার ব্যবস্থা ছিল। ‘মুসনাদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলে’ বলা হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) বলেন- সুফ্ফা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ৭০ জন রাতের বেলায় এক শিক্ষকের কাছে যেতেন এবং সকাল পর্যন্ত শিক্ষালাভে মশগুল থাকতেন। (৩য় খÐ, পৃ. ১৩৭)
বস্তুত সাহাবায়ে কিরাম প্রিয়নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে যে শিক্ষাই লাভ করতেন, সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর আমল শুরু করতেন। এটি ছিল প্রিয়নবীর শিক্ষার বৈশিষ্ট্য এবং সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ। মহানবীর আগমনের আগে আরবে লেখার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। তখন অল্প পরিসরে প্রস্তরখÐ, কাঠ ও গাছের ছাল বা পাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখা হতো। কিন্তু রাসূল (সা.) আগমনের সঙ্গে সঙ্গে যেন লিখনপদ্ধতিও নিয়ে আসলেন। তখন কোরআন মজিদকে লিপিবদ্ধ ও সুসংহত করার প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক। প্রথমদিকে কোরআনের সঙ্গে হাদিসের সংমিশ্রণের আশঙ্কায় হাদিস লিখতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সংমিশ্রণের আশঙ্কা দুরীভ‚ত হওয়ায় লেখার মাধ্যমে কোরআন ও হাদিস প্রচার ও প্রসারে নতুন মাত্রা যোগ হলো। তাই এ কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, রাসূল (সা.) কিভাবে শিক্ষা বিস্তারের কাজকে ত্বরান্বিত করেছিলেন এবং অশিক্ষিত লোকদের শিক্ষাদানের বাস্তব পদক্ষেপকে সফল করে তুলেছিলেন।
মোটকথা, মানবসমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার বিস্তারে রাসূল (সা.)-এর আদর্শকে এক কথায় ‘ গরষব ংঃড়হব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রায় ১৫০০ বছর আগেই আরবের মরুভ‚মিতে মহানবী (সা.) বিদ্যা শিক্ষাকে ফরজ করে দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি এর জন্য গ্রহণ করেছিলেন অসংখ্য বাস্তবমুখি পদক্ষেপ। ইদানীং বিভিন্ন দেশের শিক্ষাবিদগণ যে সমস্যা নিয়ে দিনরাত কাজ করছেন, কমিশনের পর কমিশন ও শিক্ষানীতি গ্রহণ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করার যে প্রাণান্তকর শ্রম সাধনা করে চলেছেন, মূলত মহানবী (সা.) প্রায় ১৫০০ বছর আগেই তা করে দেখিয়েছেন। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যেন উপরোক্ত আলোচনার প্রতি আমল করার তাওফিক দান করেন আমীন।