কাজিরবাজার ডেস্ক :
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সকল দলের সমর্থন প্রয়োজন। আর বিএনপি না এলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
এছাড়া নির্বাচন প্রার্থীভিত্তিক না করে দলভিত্তিক আয়োজনের ব্যবস্থা করা উচিত।
রবিবার (১২ জুন) নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারগণ (সিইসি)।
সাবেক সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জাতীয় পরিচয় পত্রের (এনআইডি) কোনো বিকল্প নাই। কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। সামনে নির্বাচনে কী করবো- ফান্ডামেন্টাল কিছু করতে যাবেন না। আইন পরিবর্তন ইত্যাদি করে কিছুই করতে পারবো না। আইন কানুন যা আছে, তা দিয়ে সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব। তা দিয়েই আমরা তো সুষ্ঠু নির্বাচন করেছি।
১/২২’র এ সিইসির বলেন, ইসির কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসার করবেন। তবে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে করতে হবে। আমি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সব জায়গায় পারিনি। সব জায়গায় উপযুক্ত লোকবল নাই, প্রশিক্ষিত লোকবল দরকার। বেছে বেছে করেছি, বাকিদের করতে পারিনি। বাকিদের ডিসি নিয়োগ করেছি। সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ইসি কর্মকর্তাদের নিয়োগ একেবারে বাদ দেওয়া ঠিক হবে না।
এবারে নির্বাচনে সব দল না আসলে গ্রহণযোগ্য হবে না উল্লেখ করে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা এ সিইসি আরও বলেন, তাদের কীভাবে আনবেন, সেটা উপর নির্ভর করবে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা। আমার সময় অনেক সময় লেগেছে বিএনপির আত্মবিশ্বাস আনতে। উনারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা নির্বাচনে যেতে রাজী নন। রাজনৈতিক দল যে দেশে গণতন্ত্র আছে ও নির্বাচন আছে, বেশিদিন নির্বাচনের বাইরে থাকতে পারে না। আমরা যদি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি অবশ্যই আসবে।
কমিশনের উদ্দেশ্যে ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, এখন পর্যন্ত কার্যকলাপ আপনাদের যা দেখেছি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না কেউ। এটা যদি বজায় রাখতে পারেন, যেসব কর্মকর্তা আছে তাদের নিয়ে ভালো নির্বাচন করতে পারবেন। আমরা চাই একটা সুন্দর নির্বাচন হোক। সবাই চায়।
২০১৭ সাল থেকে চলতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিইসি’র দায়িত্ব পালন করা কেএম নূরুল হুদা বলেন, আমাদের নির্বাচন কমিশন ৭২ সালে থেকে ধীরে ধীরে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সুসংহত করার চেষ্টা করছে। আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি অন্য দেশের সঙ্গে মেলালে হবে না। ৭৫ পর্যন্ত একরকম ছিল। পরে আরেক রকম ছিল। সব নির্বাচন ইসিকেই করতে হয়েছে। ৯১ সালের পর একরকম নির্বাচন আবার পরবর্তীতে আরেক রকম হয়েছে। অর্থাৎ বারবার পরীক্ষামূলক অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। যখন যে রাজনৈতিক অবস্থান ছিল; ইসি সেই অবস্থার আলোকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চেষ্টা করেছে।
তিনি বলেন, কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময় শত শত লোক নিহত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নষ্ট করা হয়েছে। পরিস্থিতি ব্যাপক সহিংস হয়েছে। সেই অবস্থার মধ্যেও কষ্ট করে নির্বাচন করতে হয়েছে। ড. শামসুল হুদা সাহেবের সময় একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। তাদেরকে ধন্যবাদ দিই- সেই সময় ভালো ভালো কিছু আইন হয়েছে। এই যে ভবন, এগুলোর পেছনে তার অবদান ছিল। তখন রাজনৈতিক সরকার ছিল না। সিদ্ধান্ত সহজ ছিল। এখন যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে ছয় মাস সময় লেগে যায়। সুতরাং কেউ কম ভোগেননি। এখন যে পরিস্থিতি অনেক উন্নত পরিস্থিতি। আমাদের সময় দুবছর করোনার কারণে কাজই করতে পারিনি। অনেকগুলো সংস্কারের বিষয় ছিল হাত দিতে পারিনি। কাজেই প্রত্যেকেই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে। বর্তমান কমিশনও চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কেএম নূরুল হুদা আরও বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বাংলাদেশের নির্বাচনে যেভাবে মোতায়েন করা হয়, পৃথিবীর তা বিরল। বন্দুক দিয়ে যুদ্ধের মতো অবস্থা হয়। এগুলোর আসলে প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনীর একেবারেই প্রয়োজন নেই। নির্বাচন পরিচালনায় তারা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব নিয়োজিত একটি বাহিনীকে নির্বাচনে দায়িত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
সবেক এ সিইসি আরও বলেন, নির্বাচনে ৭৫ শতাংশ অর্থ আইন শৃঙ্খলা রক্ষার পেছনে ব্যয় হয়। এখন আর্মি, এয়ার ফোর্স, র্যাব, বিজিবি নামে। একটা কেন্দ্রে যে পরিমাণ সশস্ত্র ফোর্স থাকে, তা একটা থানার সমান।
ব্যালট বাক্স রেখে গেলাম লোকজন এসে ভোট দিয়ে যাবে এমনও পরিস্থিতি নেই। এক্ষেত্রে আমি ইভিএম’র কথার বলি। এতে বাক্স নেওয়া যায় না, একজনের ভোট আরেকজন দেওয়া যায় না। কেন্দ্রেই ভোটের ফলাফল ঘোষণা হয়। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ৯৫ শতাংশ লোকবল চেষ্টা করে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য। কিছু কিছু লোক তো থাকেই।
নির্বাচন পরিচালনা জন্য ডিসি না ইসি অফিসার, তা নিয়ে কথা হচ্ছে। আমি মনে করি আমার সময় স্থানীয় সকল নির্বাচন ইসির কর্মকর্তারা করেছে। কোনো অসুবিধা হয় নাই। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও প্রস্তাব থাকবে যারা যোগ্য তারা থাকুক। তাহলে একটা তুলনা দেখা যাবে। সারাজীবন জেলা প্রশাসকদের ওপর নির্ভর করে নির্বাচন করা যাবে না। এছাড়া ইসির কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হলে দায়বদ্ধতা থাকবে। ডিসিদের নির্বাচনের পর আর ধরা যায় না।
নির্বাচন নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে আমাদের দেশে। রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। বিশ্বাস করি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। এজন্য সব দলের সমর্থন প্রয়োজন হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বিচারপতি মো. আব্দুর রউফ। ইসি আয়োজিত সংলাপে তিনি বলেন, রাজনৈতিকরা মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন। নতুন রাজনৈতিক পাওয়া দুষ্কর। যে অবস্থা বিরাজ করছে, জাতীয় নির্বাচন আসলেই ২০ কোটি খরচ করবো। ভোটের পার হলেও ২০০ কোটি আয় করবো। সোজা হিসাব।
প্রার্থী ভিত্তিক না হয়ে দলভিত্তিক নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে যে দল যতটি আসনে প্রার্থী দেবে এবং যত সংখ্যক ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দলের আসন সংখ্যা নির্ধারণ হবে।
বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে আরও অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ, আবু হাফিজ ও মাহবুব তালুকদার, সাবেক ইসি সচিব ড. সাদিক ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী ও মোখলেছুর রহমানসহ, বর্তমান নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
নির্বাচন কমিশনার এ সময় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের প্রতি জোর দেন। এছাড়া প্রায় সকলেই ইভিএমে নির্বাচন করার পক্ষে মতামত দেন।