কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে অপরাধ উদ্ঘাটনের ধরন পাল্টে গেছে। এনালগ পদ্ধতির অপরাধ উদ্ঘাটনে এখন ডিজিটাল পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে অপরাধ উদ্ঘাটন। এতে করে অপরাধী শনাক্তকরণ ও গ্রেফতারের বিষয়টি আরও সহজ ও প্রমাণনির্ভর হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, মোবাইল ফোন কললিস্ট ও সিসি ক্যামেরা- এই তিন ধরনের প্রযুক্তির সাহায্যে এখন অপরাধ উদ্ঘাটন, অপরাধী চিহ্নিতকরণ ও গ্রেফতার করছে পুলিশ। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক অপরাধের ঘটনাই জানতে পারে না কিংবা জেনেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে পুলিশ। আবার কখনও অপরাধীদের ভয়ে অপরাধের বা ধর্ষণের শিকার হয়েও পুলিশকে জানায় না ভুক্তভোগীরা। প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তে বের হয়ে আসছে এ ধরনের অপরাধের অভিযোগের ঘটনা। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়েও পার পেয়ে গেছে অপরাধীরা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় অপরাধের ঘটনা শনাক্ত হচ্ছে, ধরা পড়ছে অপরাধীরা। ফেসবুকের কল্যাণে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ার পর কঠোর অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্ঘলা বাহিনী।
পুলিশ জানায়, দেশের বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা উদ্ঘাটনে সহায়তা করেছে ফেসবুক। এর মধ্যে সিলেটের এমসি কলেজে গৃহবধূ ধর্ষণ, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের নারীকে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়া ভিডিও এবং সর্বশেষ সাভারের আশুলিয়ায় ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী। এ ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিষয়ে অন্ধকারে ছিল পুলিশ। ফেসবুকে এসব ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশের টনক নড়ে। শুরু হয় তদন্ত। ধরা পড়েছে সব অপরাধী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রায় এক মাস আগে আশুলিয়ার প্রিন্স কিশোর গ্যাংয়ের কাছে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন দুই তরুণী। ধর্ষণের বিষয়ে কারও কাছে অভিযোগও করেননি তারা। বরং স্থানীয়ভাবে ভিডিও প্রকাশ হয়ে পড়লে ওই দুই বান্ধবী গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হন। মাসখানেক পর ফের সেই ভিডিও ফাঁস হয়ে পড়লে ঘটনাটি আবারও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে পুলিশ ভিডিওটি পেয়ে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে আটক করে।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী আশুলিয়ার ভাদাইল এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তারা স্থানীয় একটি চুল কারখানায় কাজ করতেন। তারা যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, একই বাসার ভাড়াটিয়া দুই কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে মাসখানেক আগে পবনারটেক এলাকার একটি হাউজিংয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওই সময় প্রিন্স কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দুই তরুণীর সঙ্গে থাকা কিশোরদের আটকে রেখে দুই তরুণীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে দুই তরুণী জানায়, তারা ভাদাইলের গুলিয়ারচক এলাকায় বেড়াতে গেলে তাদের ঘিরে ফেলে প্রিন্স কিশোর গ্যাংয়ের ১২-১৪ জন সদস্য। পরে দুই কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং মারধর করে এক জায়গায় আটকে রাখে। এরপর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দুই তরুণীকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ভিডিওধারণ করে। ওই ভিডিও প্রকাশ হয়ে পড়লে দুই বান্ধবী এলাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যান। তবে ঘটনার প্রায় এক মাস পর কিশোর গ্যাংয়ের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে ওই ভিডিও ফাঁস হয়ে পড়ে। তবে কিশোর গ্যাংয়ের দলনেতা সারুফের বাবা আকবর আলী ওই গ্যাংয়ের অন্য সদস্যসহ অভিযুক্তদের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে স্থানীয় মাতবরদের নিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পুলিশের হাতে ভিডিওটি পৌঁছালে ভিডিও থেকে শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে তিন অভিযুক্তকে আটক করা হয়।
আশুলিয়া থানার পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ধর্ষণের ঘটনাটি মাসখানেক আগে সংঘটিত হলেও এ বিষয়ে কোন অভিযোগ করেনি ভুক্তভোগীরা। জানতে পেরেছি, আতঙ্ক, হুমকি ও লোকলজ্জার মুখেই কোন অভিযোগ করতে সাহস করেননি দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার তরুণীরা। অভিযোগ না পেলেও ভিডিওটি হাতে পেলে আমরা আশুলিয়া থানা পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু করি। পরে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে আটক করা হয়। বাকিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও প্রযুক্তির সাহায্যে উদ্ঘাটিত হয়েছে ভয়াবহ এক ধর্ষণের ঘটনা।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শারীরিক সম্পর্কে রাজি না হওয়ায় বেগমগঞ্জের গৃহবধূকে শ্লীলতাহানি’ করে ভিডিওধারণ করা হয়। ভিডিওটি কে বা কারা ভাইরাল করেছে এবং কার কাছ থেকে ছড়িয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান চলছে। তবে গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানিয়েছে, কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণেই তারা ওই নারীকে নিপীড়ন করেছে। এক মাসের আগে করা ভিডিওটি ভাইরাল হয়। ভাইরাল হয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওই গৃহবধূকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে তার মুখমন্ডলে উপর্যুপরি লাথি মারছে দুর্বৃত্তরা। ভিডিওধারণের সময় গৃহবধূ বখাটেদের বহুবার পায়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করেছেন। তিনি দুর্বৃত্তদের বারবার বাবা-বাবা বলে ডাকলেও তারা ভিডিওধারণ বন্ধ রাখেনি। জঘন্য ও নারকীয় কায়দায় ওই গৃহবধূকে তারা নির্যাতন করতে থাকে। শুধু তাই নয়, ধারণ করা ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং লাইভ করতে হবে বলেও ওই সময় একে অন্যকে জানায় নির্যাতকরা।
নির্যাতনের শিকার ওই নারীর বিয়ে হয় তিন বছর আগে। পরে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে তিনি বাবার বাড়িতে থাকতেন। স্বামীর সঙ্গে অনেকদিন হলো যোগাযোগও নেই তার। ওই নারীর স্বামী তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। পরে রাত ১০টার দিকে দেলোয়ার তার কথিত বাহিনী নিয়ে ওই নারীর ঘরে প্রবেশ করে, তার বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ করার অভিযোগ এনে মারধর ও ধর্ষণ চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে ওই অবস্থার ভিডিওধারণ করে পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ঘটনাটির ভিডিও প্রকাশের পর টনক নড়ে পুলিশ প্রশাসনের। পুলিশ অনুসন্ধান চালিয়ে ওই ভুক্তভোগী নারীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় জড়িত মোট ৯ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক মাস আগের ধর্ষণের ঘটনাটির প্রায় সব আসামিই ধরা পড়েছে প্রযুক্তির সাহায্যে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, অপরাধী শনাক্তকরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুলিশ এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোথাও কোন ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটলেই কেউ না কেউ ফেসবুকে ভিডিও বা বক্তব্য ছেড়ে দেয়। ফেসবুকে অপরাধের ঘটনা ছেড়ে দেয়ার পর পরই শুরু হয় তোলপার। এছাড়া অপরাধীরা পালিয়ে গেলে তাদের ধরার ক্ষেত্রে শুরু হয় ওই এলাকায় ব্যবহৃত মুঠোফোনের ওপর নজরদারি। সেই মুঠোফোন মালিকদের থেকে বাছাই করা সন্দেহভাজনদের পরিচয় সম্পর্কে তথ্য নিয়ে খোলা হয় তদন্তের খাতা। কেউ হত্যার শিকার হলে তার মুঠোফোন নম্বর আগেই চলে যায় পুলিশের কব্জায়। শুরু হয় বিস্তর বিশ্লেষণ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে এক তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনার পর আত্মগোপনে ছিল মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামি। কলেজের এক ছাত্রের মোবাইল ফোন নম্বর ট্র্যাক করেই বাকিদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এ বিষয়ে অভিযান-সংশ্লিষ্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে ‘ফোনকল ম্যাজিক’। তিনি বলেন, এক ছাত্র নেতার ফোন নম্বর ট্র্যাক করে বাকি চার আসামির অবস্থান শনাক্ত হয়। এরপর তাদের গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ ঘটনায় জড়িতদের তথ্য ওই রাতেই জানাজানি হয়। তাদের ছবিও ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন সকালে মামলা হয়। ওইদিন মাত্র তিন ঘণ্টায় এক ছাত্র নেতার মোবাইল ফোনে অসংখ্য কল আসে। এতে পুলিশের সন্দেহ হলে তার নম্বর ট্র্যাক করে। এর মাধ্যমে আসামিদের অবস্থান শনাক্ত হলে একে একে ধরা পড়ে সব আসামি।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ ঘটামাত্রই অপরাধীরা পালিয়ে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলের এলাকায় কোন সিসি ক্যামেরা আছে কি না, তা খোঁজা শুরু করেন পুলিশের কর্মকর্তারা। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের শনাক্ত করার চেষ্টা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে গাড়ির নম্বর চিহ্নিত করতে পারে এমন সিসি ক্যামেরা। আর কোথাও ক্যামেরা না থাকলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী সন্দেহভাজন ব্যক্তির চেহারা এঁকে ফেলার প্রযুক্তিও পুলিশের কাছে রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধও বেড়েছে। আর তা দমনে ‘সাইবার পুলিশিং’ও বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্যাংকের লেনদেন এসব পর্যালোচনা করেও একজন ব্যক্তি সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায়। মানি লন্ডারিং আইন হওয়ার পর সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করার এখতিয়ারও পেয়েছে সিআইডি। এখন মাঠের চেয়ে প্রযুক্তিনির্ভর কাজের পরিমাণই বেশি। পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের দিন শেষ হয়ে গেছে, সময় এখন প্রযুক্তির। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্ত করলে সেটা যেমন নির্ভুল হবে, তেমনি মানুষও হয়রানির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে।