মুহাম্মদ ইমদাদ হোসেন
হাওরপার বা গ্রামের মানুষেরা স্বপ্ন বুনে বৈশাখ ঘিরে। বৈশাখ মাসে সোনালি ফসল ঘরে তুলে স্বপ্ন পূরণের আশা বুকে লালন করে। হাওরপার বা গ্রামের মানুষদের জীবিকা নির্বাহ এবং স্বপ্ন পূরণের সবচেয়ে বড় সোপান বোরো ফসল। আর এই বোরো ফসল বৈশাখ মাসেই ঘরে তোলা হয়। তাই বৈশাখ ঘিরেই বিস্তৃত হয় তাদের স্বপ্ন-আশার জাল। লালিত হয় স্বপ্নের প্রজাপতি। এমনি এক স্বপ্ন বুনা চাষির নাম কুদ্দুস মিয়া। কুদ্দুস মিয়ার এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলেটা বিয়ের উপযুক্ত, মেয়ে দুটুও পিঠাপিঠি বড় হচ্ছে। কুদ্দুস মিয়া এবার নিজের এবং বর্গাসহ দুই হাল জমি চাষ করেছেন। স্বপ্ন দেখছেন এবার বৈশাখি তোলে ছেলের বিয়ে দিবেন। কুদ্দুস মিয়ার স্ত্রীর ইচ্ছাও তাই। একদিন কুদ্দুস মিয়া বউকে ডেকে বলতে লাগলেন..
কোয়াইগো শেফালির মা? অবাইদি আও, তোমার লগে আমার কিছু দরকারি মাত আছে।
কিতা এমন দরকারি মাত?
ভাবতাছি এইবার বৈশাখি তোলে পুয়ার বিয়া গাইলিতাম।
অয়গো আমিও তাই ভাবতাছি, দেখতে দেখতে ফুরি দুইটাও ঢাংগর অইগিছে। পুয়াটা তো আরো আগেই বিয়ার উপযুক্ত। তার লগের পুয়াইনতে বিয়া খইরা বাচ্ছ্যা-কাচ্ছ্যা অইগিছে। দেখতেছোনা আইজকাইল পুয়ায় কোনো কাজকামও করেনা। সারাদিন বাউন্ডারি ঘুরায়, আর রাইতে মোবাইল টিপায়। তাই বিয়েশাদি করাইয়া দেখিলাই কাজকামে মনযোগি অয়নি। ঘরগাইট লয়নি। স্বভাবটা বদলেনি।
তুমি এক্কেবারে ঠিক কথা কইছো শেফালির মা। তাইলে এখন থাইক্যা মনে মনে কইন্যা দেইখ্যা কিছু আলাপ আলোচনা কইরা রাখা দরকার। আল্লাহ যদি সুহালে বৈশাখি দিয়া যায়, তাইলে এইবার বিয়াটা গাইলিমু।
কইন্যার ব্যপারে আমার একজন পছন্দ আছে যদি তোমার মত থাকে তাইলে আমরা আলাপ দিতাম পারি।
কার কথা কইতাছো তুমি?
তোমার ভাগ্নি আছমার কথা, ফুরিটা আমার খুব পছন্দ। মা মরা ফুরিটা আমাদের কাছে থাকলেই ভালা অইব।
তুমি দেখি আমার মনের কথা কইলিছো শেফালির মা। আমিও তাই চিন্তা করছিলাম।
মা-বাবার কথা আড়াল থেকে শুনে শেফালিও বলে ওটে..
আব্বু আমারও তাই পছন্দ। আছমা আপা খুব মিষ্টি মেয়ে। তা ছাড়া আছমা আপাও ভাইয়াকে খুব পছন্দ করে।
তাইলে এটাই ফাইনাল, এইবার বৈশাখি তোলে রাহেল কে বিয়া করাইলিমু। আমি আজই আছমার বাপের সাথে আলাপ কইরা রাখমু।
যেই ভাবা সেই কাজ কুদ্দুস মিয়া বিকালেই বোনের বাড়িতে গেলেন। আছমার মা মানে কুদ্দুস মিয়ার বোন মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বোন না থাকলেও কুদ্দুস মিয়া বোনের বাড়িতে নিয়মিতই আসা যাওয়া করেন। খোঁজখবর রাখেন। বোন জামাই এনং ভাগনা ভাগ্নিদের যতœ আত্তিতে এক্টুও কমতি করেন না। আইয়রি-নাইওয়রি সবই ঠিকটাক মতো হয়। বোনের বাড়িতে গিয়ে কুদ্দুস মিয়া বোন জামাইর সাথে মনের কথা স্বনের কথা আলাপ করেন।
বোন জামাই রশিদ মিয়া কুদ্দুস মিয়ার কথা শোনে খুশি হয়ে বললেন.
ভাই, আপনি যা ভালা মনে করেন আমি তাতেই রাজি। আপনি তো সব সময়ই আমাদের ভালার চিন্তা করেন।
তাই আমি আপনার সিদ্ধান্তে একমত।
আব্বু আর মামার কথা আড়াল থেকে সবই শোনে আছমা। খুশিতে সে আত্মহারা হয়ে যায়। রাহেলের সাথে যদিও তার প্রেমের সম্পর্ক নেই তবুও রাহেল কে সে খুব পছন্দ করে। মামাতো ভাই হওয়ার সুবাদে ছোট বেলা থেকেই দুজনের বেশ সখ্যতা ছিল, একসাথে খেলাধূলা আড্ডার রয়েছে অনেক প্রীতিময় স্মৃতি। স্মৃতির পায়রাগুলো আজ উঁকি মারছে আছমার মনের আকাশে। স্মৃতিগুলো স্বপ্ন হয়ে সুন্দর আগামির দিকে হাতছানি দিচ্ছে।
কুদ্দুস মিয়া বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করেই বাড়ি ফিরলেন। ঘরে ডুকেই বউকে ডাকলেন..
কোয়াই গো শেফালির মা অবাইদি আও।
কিতাগো তোমারে দেখি খুব খুশি খুশি লাগের।।
অয়গো আমার আজ খুব খুশি লাগের। আমি আমার রাহেলের বিয়া পাক্কা কইরা আইলাম। বৈশাখিটা আল্লায় ভালা মতো দিয়া গেলেই রাহেলের বিয়াটা গাইলিমু।
বিষয়টা রাহেলের কানে পৌছালে সেও খুশিতে বিভোর হয়ে যায়। স্বপ্ন দেখে নতুন জীবনের। সারাদিন টু টু করে বেড়ানো ছেলেটাও মনের গভীরে বুনতে থাকে সোনালি সপ্নের জাল। সোনার ফসল ওঠবে ঘরে, আসবে নীড়ে নববধু। ভাবতেই রাহেলের মনে জাগে আনন্দের শিহরণ। মনে মনে ভাবে এবার আর টুটু করে বেড়ানো নয়, দায়িত্ব কাধে নিয়ে বাবার সাথে কাজ করতে হবে আমাকে। বদলে নিতে আমার চালচলন জীবন ধারা। সময় চলে যায় বৈশাখ ঘনিয়ে আসে। স্বপ্নের জাল আরো বিস্তার হয়।
আর মাত্র কয়েক দিন পরেই সোনার ফসল ঘরে তোলা যাবে। ক্ষেতে ধান পাকতে শুরু করেছে। ফলনও মন্দ নয়।
আজ বিকালে কুদ্দুস মিয়া ক্ষেতে ধান দেখতে যায়, সাথে রাহেলও যায়। ধান ক্ষেতে অল্পপাকা ধান দেখে দুজনের মনেই বয় আনন্দের স্রোত। অন্যবারের চেয়ে এবার তাদের বৈশাখ নিয়ে আলাদা একটা আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে মনে।ফসলের ফলনও এবার মন্দ নয়।
সময়ে বয়ে যায়, ক্ষেতে ধান প্রায় পেকে গেছে। তবে কয়েক দিন ধরে আবহাওয়া সুবিধের নয়। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে লাগাতার। ঢল নামছে উজান থেকে। নদীতে পানি দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। কুদ্দুস মিয়া ভাবছেন আর অপেক্ষা নয়, দুয়েক দিনের মধ্যেই ধান কাটা শুরু করে দিবেন। সেই মোতাবেক প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
আবহাওয়ার তেমন পরিবর্তন নেই। থামছেই না বৃষ্টি, পানিও বাড়ছে অস্বাভাবিক ভাবে। প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। সময় যত যাচ্ছে কৃষক মনে শংকা বাড়ছে। কুদ্দুস মিয়া ভাবলেন আর দেরি নয় যেটুকু ধান পেকেছে তাই কেটে আনতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন কাল থেকেই ধান কাটা শুরু করবেন।
মাগরিবের নামাজ শেষে কুদ্দুস মিয়া বাড়ি ফিরছিলেন। হটাৎ কানে আওয়াজ আসে মসজিদের মাইকে এলান হচ্ছে। হাওড়ের বাধ ভাঙার উপক্রম, আপনারা যার যার
উড়া কুদাল নিয়ে বান্দে চলে যান। এলাকাবাসীকে তাড়াতারি বান্দে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। এলান শোনে কুদ্দুস মিয়ার যেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ে। বাড়ি গিয়ে দ্রুত উড়া-কুদাল নিয়ে
বান্দে চলে যান। বাবার সাথে রাহেলও বান্দে যায়। ইতোমধ্যে গ্রামের অনেকেই বান্দে হাজির হয়। বান্দের ফাঁটা দিয়ে পানি হাওড়ে ডুকতে শুরু করেছে। গ্রামবাসী সবাই মিলে প্রাণপণে চেষ্টা করেন বাধ রক্ষা করার জন্য। কিন্তু পানির প্রবল বেগের কারণে কয়েক ঘন্টা চেষ্টা করেও বাধ রক্ষা করা যায়নি। বাধ ভেঙে পানি হাওড়ে ডুকতে থাকে। চোখের সামনে দেখতে দেখতেই হাওড়ের কাচাপাকা ধান ডুবতে থাকে পানিতে। কুদ্দুস মিয়া নিস্তেজ হয়ে বসে পড়েন বান্দে। বাবার পাশে রাহেলও
বান্দে বসে চেয়ে চেয়ে দেখছে তাদের পরিশ্রমের ফসল ক্ষেতভরা ধান ডুবছে পানিতে। সেই সাথে বানের জলে ভেসে যাচ্ছে তাদের হৃদয়ে লালিত স্বপ্ন। কুদ্দুস মিয়া রাহেল কে জড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কেদে ওঠেন। একাকার হয়ে যায় তাদের চোখের জল আর বৃষ্টি-বানের জল। জলের স্রোতে ভেসে যায় তাদের হৃদ গভীরে বপন করা সকল স্বপ্ন-আশা।