কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি, সামাজিক অনেক সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু মরণনেশা তামাকের কারণে এ লক্ষ্য থেকে প্রতিনিয়ত বিচ্যুত হতে হচ্ছে। শুধু তামাকজাত পণ্য সেবনের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবছর দেশে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এক পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে মোট তামাকপণ্যের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগেরই উৎপাদন হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তামাকপণ্য সিগারেটের একটি শলাকা থেকে বায়ুমন্ডলে নির্গত হয় ১৪ গ্রাম কার্বনডাই-অক্সাইড, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। শুধু তাই নয়, এই তামাকপণ্যের ধোঁয়ায় প্রতিবছর বাতাসে যুক্ত হয় ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন ফরমালডিহাইড। আর ১২ হাজার থেকে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত তৈরি হয় নিকোটিন বাষ্প। আর নির্গত হয় কয়েক হাজার টন গ্রিনহাউজ গ্যাস। এই ধারা অব্যাহত থাকলে মানবকুল খুব শীঘ্রই ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তামাকের পরিবেশগত ক্ষতির আরেকটি বড় কারণ পরোক্ষ ধূমপানকে দায়ী করে প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা)’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৪ কোটিরও অধিক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়, যার সিংহভাগই নারী। কর্মস্থলে এবং গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়, এমন ব্যক্তির সংখ্যা যথাক্রমে ৮১ লাখ এবং ২.৫ কোটি। ঢাকা শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী শিশুদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় শতকরা ৯৫ ভাগের মুখের লালাতে উচ্চ মাত্রায় নিকোটিন পাওয়া গেছে, যা মূলত পরোক্ষ ধূমপানের ফল। পরোক্ষ ধূমপান মৃত্যু ঘটায় এবং হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের অন্যতম কারণ।
তাই এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার তাগিদ তাদের। এ ক্ষেত্রে জনসমাগম তথা সব ধরনের পাবলিক প্লেসে তামাকজাত পণ্য সেবন বন্ধ করার যে আইন রয়েছে, তা বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান সব শ্রেণী-পেশার মানুষের। এমন অবস্থার মধ্যে আজ দেশজুড়ে পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। পরিবেশের ওপর তামাকের ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি এবং এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী তামাক কোম্পানির মুখোশ উন্মোচন করতে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর দিবসটি নানা আয়োজনে পালিত হয়ে থাকে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘টোব্যাকো : থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্ট।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রতিপাদ্যটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বের ৯০ ভাগ তামাক উৎপাদন হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই বাংলাদেশে দিবসটি উদ্যাপিত হচ্ছে ‘তামাকমুক্ত পরিবেশ, সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে।
দিবসটি উপলক্ষে প্রজ্ঞা তাদের প্রতিবেদনে দাবি করে, তামাক কোম্পানির বছরে ৮৪ মিলিয়ন টন কার্বনডাই-অক্সাইড র্নিমন, ৬ ট্রিলিয়ন সংখ্যক সিগারেট শলাকা উৎপাদনের জন্য ২২ বিলিয়ন টন পরিমাণ পানি অপচয় এবং ৬০ কোটি বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন হয়। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট এবং ইকোসিস্টেমে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। প্রতিবছর ৪.৫ ট্রিলিয়ন সিগারেট ফিল্টার আবর্জনা হিসেবে প্রকৃতিতে জমা হচ্ছে, যার ওজন প্রায় ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন। ফেলে দেয়া বর্জ্য হিসেবে এটির অবস্থান শীর্ষে।
প্রজ্ঞা তাদের প্রতিবেদনে বলে, বাংলাদেশের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সমাজের ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব ব্যাপক। বিশ্বের মোট তামাকের ১.৩ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। আবাদযোগ্য জমিতে তামাক চাষের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। টোব্যাকো এ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বন নিধনের জন্য তামাক দায়ী। এ ছাড়া তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশে ক্ষতিগ্রস্ত করছে দেশের মৎস্য উৎপাদন। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদা নদী ইতোমধ্যে হুমকির মুখে পড়েছে বলে দাবি করেন সংগঠনটির নেতারা।
প্রজ্ঞা বলছে, বাংলাদেশে সিগারেটের ফেলে দেয়া ফিল্টার পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট ৭১ বিলিয়ন সিগারেটের শলাকা উৎপাদিত হয়েছে। সিগারেটের ফেলে দেয়া ফিল্টার প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে প্রায় এক দশক সময় নেয়, আর মিশে যাওয়ার সময় এ থেকে সাত হাজারেরও বেশি রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। কেবল সিগারেটই নয়, জর্দা, গুলের মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যগুলোও প্লাস্টিক কৌটা ও পলিথিন প্যাকেটে ভরে বিক্রি করা হয়, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে এক প্রতিক্রিয়ায় তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, সরকারের উচিত হবে শক্তিশালী আইন ও কর পদক্ষেপের মাধ্যমে তামাকের আগ্রাসন বন্ধ করা।
তিনি বলেন, তামাকের বহুমুখী ক্ষতির প্রভাব থেকে সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্তসহ সকল পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং তামাক কোম্পানির ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচী’ বা সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
এদিকে, দিবসটি উপলক্ষে টোব্যাকো এ্যাটলাসের ৬ষ্ঠ সংস্করণের এক পরিসংখ্যানের উদ্বৃত্তি দিয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ এ জেড এম মোস্তাক হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে প্রায় পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। বিপুল পরিমাণ তামাক সেবনের ফলও ভয়াবহ। প্রতিবছর দেশে তামাকজনিত রোগে মৃত্যু হয় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের। আর বছরে অন্তত ৪ লাখ লোক হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের রোগে ভোগে। অন্যদিকে, তামাক ব্যবহারের ফলে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ও উৎপাদনশীলতা নষ্ট হওয়ার কারণে প্রতিবছর দেশে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ত্রিশোর্ধ জনগোষ্ঠীর ৯.১ শতাংশ তামাক ব্যবহারের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত। এ ছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে প্রায় ৬১ হাজার শিশু ধূমপান না করেও তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি জানান, হাউসহোল্ড ইনকাম এ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে-২০১৬ অনুসারে, বাংলাদেশে দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারগুলো তামাকপণ্যের পেছনে তাদের আয়ের ২১ শতাংশ ব্যয় করে। এ ছাড়া, গ্লোবাল এ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-২০১৭ অনুসারে, একজন ধূমপায়ী প্রতিমাসে সিগারেটের পেছনে গড়ে ১০৭৭ টাকা এবং বিড়ির পেছনে গড়ে ৩৪১ টাকা ব্যয় করেন। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর (১৬ বা তদুর্ধ) ৩৫.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক সেবন করেন। গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে-২০১৩ অনুসারে, দেশের ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬.৭ শতাংশ তামাক ব্যবহার করে।
কেবল জনস্বাস্থ্য নয়, গোটা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তামাক। উৎপাদন থেকে সেবন পর্যন্ত অর্থাৎ সরবরাহ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে তামাকের ধ্বংসাত্মক প্রভাব পৃথিবীর সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়া ইকোসিস্টেমের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রজ্ঞা একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে। ওই তথ্যচিত্রে বলা হয়, তামাকপণ্যের ধোঁয়া থেকে বিশ্বের বায়ুম-লে বছরে প্রায় ৩০০০-৬০০০ মেট্রিক টন ফরমালডিহাইড, ১২০০০-৪৭০০০ মেট্রিক টন পর্যন্ত নিকোটিন বাষ্প এবং কয়েক হাজার টন গ্রিনহাউস গ্যাস (কার্বনডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস-অক্সাইড) যুক্ত হয়। এ ছাড়া, ব্যবহৃত সিগারেটের ফিল্টারকে পৃথিবীব্যাপী একটি বড় বর্জ্য উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবছর মোট ৪.৫ ট্রিলিয়ন ব্যবহৃত সিগারেট ফিল্টার আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেন ব্যবহারকারীরা। বিষাক্ত এই বর্জ্যরে ওজন প্রায় ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন। সিগারেটের কার্টন এবং মোড়ক থেকে আরও প্রায় ২ মিলিয়ন টন সমপরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়। সমুদ্র থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা বর্জ্যরে প্রায় ১৯ থেকে ৩৮ শতাংশই সিগারেট ফিল্টার।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমি এবং উৎপাদিত তামাক পাতার পরিমাণ- এই দুই বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ১৪তম এবং ১২তম। বিশ্বের মোট তামাকের ১.৩ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে।
তাই প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা বাস্তবায়নে অবিলম্বে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এফসিটিসির আলোকে সংশোধনের দাবি বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, তামাক চাষ নিরুৎসাহিতকরণে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরী, তামাকের ওপর ২৫ শতাংশ রফতানি শুল্ক পুনর্বহাল করতে হবে। তামাকের অধিক ব্যবহারের ফলে হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিরোগ, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ হতে পারে। তামাক ব্যবহার বন্ধে এখনই কঠোর অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আমি মনে করি।