ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভোগ্যপণ্যের দাম কমাতে এবার পাইকারি-খুচরা বাজারের সরবরাহ চেইন নিরবচ্ছিন্ন করার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেয়া হয়েছে। ভোজ্যতেলের সঙ্কটের মুখে দেশ থেকে আর রাইস ব্র্যান তেলের ক্রুড রফতানি হতে পারবে না। এ ছাড়া বোতলজাত সয়াবিন তেল রফতানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চাল, আটা, ডাল ও পেঁয়াজের দাম যাতে আর না বাড়তে পারে সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। পণ্য মজুদ করে যারা বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে থাকেন সেই সব অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করাসহ মামলা করবে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। সংস্থাটির এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিশেষ বিশেষ ভোগ্যপণ্য রফতানি বন্ধসহ ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ানো এবং আটা-ময়দার দাম কমাতে ভারতসহ অন্যান্য উৎস থেকে গম আমদানি বাড়ানো হবে। চালের দাম কমাতে আপাতত পণ্যটি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে থাকছে বেশকিছু নতুন পদক্ষেপ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি সরকার কর্তৃক গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। একদিকে করোনা মহামারীর পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি। গত কয়েক বছরের মধ্যে দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম এতটা বাড়েনি। চাল, ডাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, মসলাপাতি ও মাছ-মাংসসহ সব ধরনের জিনিসের দাম এখন উর্ধমুখী। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষ আছেন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায়। তবে স্বল্প আয়ের মানুষ সেই তুলনায় এখন কিছুটা ভাল আছেন। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর মানুষের জন্য আগামী জুন মাস থেকে সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবি ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে দেশের এক কোটি মানুষের হাতে ভর্তুকি মূল্যের খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেবে।
েেট্রাডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এতে করে স্বল্প আয়ের মানুষ উপকৃত হবেন। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য তেমন কোন সরকারী কর্মসূচী দেখা যাচ্ছে না। আগামী জুলাই মাসে কোরবানির ঈদ রয়েছে। ওই ঈদ ঘিরে ভোগ্যপণ্যের অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা তৎপর হতে শুরু করেছে। এ কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে এখন থেকে কাজ শুরু করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পূর্বাভাস সেল আগাম প্রস্তুতি শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। ওই সভায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে সিদ্ধান্তগুলো সুপারিশ আকারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে বাজারে দ্রব্যমূল্য কমে আসবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, বৈশ্বিক সঙ্কটের প্রভাবে দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিশেষ কৌশল রয়েছে। ইতোমধ্যে টাস্কফোর্স কমিটির সভায় বেশকিছু সিদ্ধান্ত এসেছে, যেগুলো বাস্তবায়ন হলে দ্রব্যমূল্য কমে আসবে। তিনি জানান, চাল ও আটার দাম বাড়ার বিষয়টি খাদ্য মন্ত্রণালয় দেখলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে চাল, ক্রুড রাইস ব্র্যান ও ভোজ্যতেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ভোজ্যতেল উৎপাদন বাড়াতে টাস্কফোর্স থেকে কিছু সুপারিশ এসেছে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে পাইকারি ও খুচরা বাজারের সরবরাহ চেইন নিরবচ্ছিন্ন করার ওপর। এ কারণে অসাধু ব্যবসায়ী যারা আছেন তারা সরকারের নজরদারির মধ্যে থাকবে। এ লক্ষ্যে কাজ করছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর।
জানা গেছে, টাস্কফোর্স কমিটির সভায় পরিশোধিত সয়াবিন, পাম, সানফ্লাওয়ার অয়েল, অলিভ অয়েল রেপড সীড-ক্যান ২.৫ কেজি পর্যন্ত আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কে অনুরোধ করা হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি সয়াবিন, ক্যানোলা তেল আমদানি করবে টিসিবি। সরিষা, সয়াবিন ও সানফ্লাওয়ার তেল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এগুলোর উন্নতমানের বীজ সংগ্রহপূর্বক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে। রাইস ব্র্যান তেলের ক্রুড রফতানি বন্ধে রফতানি অনুবিভাগ কাজ করবে। এছাড়া রাইস ব্র্যান তেল উৎপাদন বাড়াতে উৎপাদনকারী ও অংশীজনদের নিয়ে বাংলাদেশ েেট্রাড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ভারত থেকে জি-টু-জি পর্যায়ে গম আমদানিতে খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করবে। জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর তাদের মনিটরিং কার্যক্রমকে জোরদার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে রাইস ব্র্যান, সরিষা ও ক্যানোলা তেলের গুণাগুণ বিষয়ে টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করবে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরবরাহ চেইন নিশ্চিত করা এবং সয়াবিন ও ভোজ্যতেল আমদানি বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার মতো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
এদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ সঙ্কটে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। এতে মূল্যস্ফীতির হার লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে জ্বালানি তেল ও কৃষকের সারের ভর্তুকিতে। এতে হতদরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষ, শিক্ষিত বেকার ও সব শ্রেণীর ভোক্তাসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সঙ্কট থেকে বের হতে পারছেন না। এ কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ভর্তুকি মোকাবেলা হচ্ছে আগামী বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই নতুন বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। সব ধরনের উদ্যোগ নিয়ে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির সম্ভাব্য হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ বিভাগ। অবশ্য চলতি অর্থবছরে সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য মার্চের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
অর্থাৎ এটি লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। বৈশ্বিক পণ্য সরবারহ সঙ্কটের কারণে ভোজ্যতেল, গম, চিনিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যপণ্য আমদানিতে সহায়ক শুল্ককর ও ভ্যাটনীতি অবলম্বন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির কার্যক্রম বেগবান করার মতো কৌশল থাকবে নতুন বাজেটে। এ প্রসঙ্গে ইউএনডিপির কা›িট্রো ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি সাধারণ মানুষকে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এটা বৈশ্বিক প্রভাব ছাড়াও অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ব্যবস্থার অভাবের কারণে প্রকট হয়েছে। আর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গরিব মানুষের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা কি তারা ঠিকমতো পাচ্ছেন কি না সে বিষয়ে আরও গভীর মনিটরিং প্রয়োজন। জানা গেছে, খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা গেলে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের মতো নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে বলে মনে করছে সরকার। এ লক্ষ্যে নতুন বাজেটে খাদ্যপণ্য আমদানিতে সহায়ক শুল্ককর ও ভ্যাটনীতি অবলম্বন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি প্রদান এবং বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির কার্যক্রম বেগবান করা হবে।