কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে আশ্রিত মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি জটিল রূপ নিচ্ছে ক্রমশ। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনার শুরুতে এটিই ছিল একটি আশার বিষয়। দিন যতই গড়িয়েছে, তাতে হতাশার জন্ম নিয়েছে। আর এখন এটি যেন পরিণত হয়েছে রীতিমতো মহা এক দুঃস্বপ্নে। মিয়ানমার পক্ষ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আগের অবস্থানেই আছে, যে অবস্থান থেকে তারা এক চুলও সরেনি।
মিয়ানমার পক্ষ প্রত্যাবাসন ইস্যু থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছে। বাংলাদেশ সরকার পক্ষ প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বাস্তবায়নে জাতিসংঘসহ সারা বিশে^র দরবারে ক্রমাগতভাবে আবেদন করে আসছে গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে। কিন্তু কাক্সিক্ষত কোন সুফল আসছে না। এমনিতর পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি পাঁচদিনের সফরে বাংলাদেশে এসে উখিয়ার আশ্রয় শিবিরসহ দুদিনের কক্সবাজার সফর শেষ করে সোমবার ঢাকায় ফিরেছেন। আজ মঙ্গলবার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডির ভাসানচর পরিদর্শনের কথা রয়েছে।
কক্সবাজারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউএনএইচসিআর প্রধান গত রবিবার উখিয়ার কুতুপালংয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে জানতে চেয়েছিলেন তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবেন কি না? রোহিঙ্গাদের পক্ষে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, নাগরিকত্ব প্রদান না করা পর্যন্ত তারা নিজ দেশ হলেও মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। অপরদিকে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে চীন এবং ভারত সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সমঝোতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে বলে কূটনৈতিক পর্যায়ের ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে প্রশ্ন উঠেছে, প্রত্যাবাসনের পূর্বে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করছে কি না। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত না হলে রোহিঙ্গারা যেহেতু মিয়ানমারে ফিরে যাবে না, সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআরসহ সকল সংস্থার তৎপরতায় সুফল আসার সম্ভাবনা মোটেও নেই।
এ অবস্থায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বেশকিছু রোহিঙ্গা। এ সংখ্যা সে দেশের সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে তারতম্য রয়েছে। সেখানে এদের শরণার্থী হিসেবে তালিকাভুক্তও করা হয়েছে। কিন্তু এখন সেখান থেকে অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটছে বাংলাদেশে। গত বছর থেকে এ পর্যন্ত দুই সহ¯্রাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে এবং এদেরকে উখিয়া- টেকনাফের ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে- তা নিয়ে নানা পর্যায়ে নানা গুঞ্জন চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পে থাকা, খাওয়া এবং ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার যে সুবিধা রয়েছে, তা সর্বজন সমাদৃত। বাংলাদেশে ৩৪টি আশ্রয় ক্যাম্পে যে সব রোহিঙ্গা রয়েছে, তাদের কারও না কারও আত্মীয়স্বজন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আশ্রিত। এদের সকলের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্প। এখানে রয়েছে সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গভীর রাতে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর এরা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর এসব আশ্রয়কেন্দ্রে গত প্রায় পাঁচ বছরে দেড় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে। এ ছাড়া বহু আগে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ছিল ২৮ হাজার, যা বেড়ে ৬৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। এরা সবাই শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃত। আর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর যারা এসেছে, তারা মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে লিপিবদ্ধ। লিপিবদ্ধের সংখ্যা ১১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৫। আর জাতিসংঘ বরাবরই বলে থাকে এ সংখ্যা ৭ লাখ। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে একে একে নাম ধরে তালিকাভুক্ত করেছে ১১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৫। এদের সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন আরও দেড় লাখ শিশু। ইতোমধ্যে এসব শিশুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। এদের জন্মসনদ হচ্ছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে। কক্সবাজারের আরআরসি অফিস, বিভিন্ন এনজিও, স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সেখানকার স্থানীয়দের তুলনায় বেশি। বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী উখিয়া টেকনাফের স্থানীয় জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ লাখ। কিন্তু আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকে পালিয়ে এসেও এরা বাংলাদেশে আশ্রয় পাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয় পেয়েছে। এরা অবৈধভাবে এসেছে, যার কারণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধে পত্র দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আগামীতে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর একটি ব্যাপার হচ্ছে, উখিয়া টেকনাফের ৩৪ আশ্রয় ক্যাম্পের বাইরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু কোনারপাড়া জিরো লাইনে (মিয়ানমার অংশ) একটি ক্যাম্প রয়েছে। যেখানে শুরুর দিকে ৬ হাজার রোহিঙ্গা ছিল। বর্তমানে কমে চার হাজারে রয়েছে। এদের জন্য নিয়মিত ত্রাণসামগ্রী যায় এপার থেকে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। কয়েকটি এনজিও এ ক্যাম্পে আশ্রিতদের জন্য নিয়মিত ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়ে থাকে, যা ওপেন সিক্রেট। কিন্তু অফিসিয়ালি কেউ স্বীকার করে না। বিষয়টি শুরু থেকেই রহস্যে দানা বেঁধে আছে।
এদিকে, ইউএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি এবার যে বাংলাদেশে এলেন- এটা এ দেশে তার তৃতীয় সফর। আবার আগামী বছর ৩০ জুন ইউএনএইচসিআর থেকে তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করে তার রোহিঙ্গা ইস্যুতে ঝটিকা সফরের নেপথ্যে তাৎপর্য রয়েছে। অতীতে দুবার তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির সফর করে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এবার দেননি। ঢাকায় দেবেন কি না- তা অজানা। বুধবার তার বাংলাদেশ সফর শেষ করার কথা রয়েছে।
উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তিনি বারবার জানতে চেয়েছেন, আশ্রিতরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি আছেন কি না। এর পাশাপাশি জেনেছেন তারা এ দেশে কেমন আছেন। দুটি উত্তর তিনি পেয়েছেন। প্রথমত, নাগরিকত্ব ছাড়া তারা ফিরে যাবে না। আর এ দেশে তারা ভাল আছেন। তাদের নিরাপত্তাহীনতা নেই। এ ম্যাসেজ নিয়ে ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি ফিরে যাবে। এরপর তার মিয়ানমার সফর কর্মসূচী রয়েছে কি না- তা অঘোষিত। তবে দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তিনি মিয়ানমার সফর করতে পারেন।
অপরদিকে, কক্সবাজারের স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ে রোহিঙ্গাবিরোধী একটি সেন্টিমেন্ট ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। কেননা, একদিকে এরা আশ্রিত হলেও তাদের কর্মকা- ও চলাফেরা ড্যামকেয়ার মনোভাবের। আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে খুন, অপহরণ, মাদকের কারবার ও মিয়ানমারের জঙ্গী সংগঠন সদস্যদের তৎপরতা রয়েছে, যা সীমান্তবর্তী উখিয়া টেকনাফের জন্য হুমকিস্বরূপ। শুধু তাই নয়, আগামীতে এ হুমকি পর্যটন নগরী কক্সবাজারের জন্যও হয়ে আসলে তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কোন বিকল্প পথ বাংলাদেশ সরকারের জন্য নেই। অথচ, সে পথ বহুদূর। কেননা, মিয়ানমার এ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার মনোভাব দেখাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এরা রোহিঙ্গা নামটিও মুখে আনছে না। সে দেশে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নাম মিয়ানমার সরকার মুখে নিলেও রোহিঙ্গা নামটি উচ্চারণ করতে নারাজ। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘসহ বিশ^ ফোরামে এবং এর পাশাপাশি দুদেশের কূটনৈতিক পর্যায়েও তারা এ নাম উচ্চারণ করে না। অথচ, ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং সত্য যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। শত শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় তারা মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে।
আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন এখন একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। কারণ, মিয়ানমার যদি প্রত্যাবাসনে প্রস্তুতি নিয়েও আসে, রোহিঙ্গারা যাবে না। কারণ, তারা তো দাবিই দিয়ে রেখেছে, নাগরিকত্বের ঘোষণা ছাড়া তারা ফিরে যাবে না। তাহলে পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে যে, নাগরিকত্বের ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমার তাদের নেবে না। আর ওই ঘোষণা ছাড়া রোহিঙ্গারা এ দেশ ছাড়বে না।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী- জোর করে কোন আশ্রিত বা শরণার্থীকে কোন দেশে ফেরত পাঠানো যায় না, এ ক্ষেত্রেও যাবে না। সুতরাং এটি স্পষ্ট প্রতিভাত যে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের ঘোষণা দিয়ে জামাই আদরে মিয়ানমার তাদের কখনও ফিরিয়ে নেবে না।