শ্রীলঙ্কায় সেনা শাসন ॥ পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অর্থনৈতিক সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা শ্রীলঙ্কায় কয়েক মাস ধরে চলা সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশকেও জরুরী ক্ষমতা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। এই ক্ষমতাবলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের সুযোগ পেয়েছে উভয় বাহিনী। বিক্ষোভের জেরে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে মঙ্গলবার বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে একটি সেনাঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। খবরে বলা হয়েছে, জনরোষ থেকে বাঁচতে সপরিবারে পালাতে বাধ্য হন দেশটির দীর্ঘদিনের এই প্রধানমন্ত্রী। রাজাপাকসের পদত্যাগের পর একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে তোড়জোড় শুরু করেছেন প্রেসিডেন্ট। সেনা শাসনের মধ্যেও মঙ্গলবার রাজধানী কলম্বোসহ অন্যান্য জায়গায় বিক্ষোভ হয়। কারণ মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগে বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। এবার তারা মাহিন্দার ভাই প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি করছে। কয়েক শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ-বিক্ষোভকারী সংঘর্ষে নিহত বেড়ে সাতজনে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনায় কয়েক শ’ মানুষ আহত হয়েছেন। মাহিন্দা তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরনগরী ত্রিনকোমালিতে গিয়ে নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা হেলিকপ্টারে করে কলম্বো থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দূরে ওই ঘাঁটিতে পৌঁছান। তবে এখন ওই নৌঘাঁটির বাইরেও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে ভারত।
শ্রীলঙ্কার চলমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরো এক টুইটে এ তথ্য জানায়। শ্রীলঙ্কা পুলিশ জানায়, মাহিন্দা রাজাপাকসেকে মঙ্গলবার সশস্ত্র সৈন্যরা কলম্বোতে তার সরকারী বাসভবন থেকে সরিয়ে নেয়। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ভবনটির সদর দরজা ভেঙ্গে ফেলার পর তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা রাজধানীর ‘টেম্পল ট্রি’ বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয়ে দুই তলাবিশিষ্ট ভবনটিতে হামলা চালানোর চেষ্টা করে। রাজাপাকসে সেখানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভোরের আগে সেখানে অভিযান চালানোর পরে সৈন্যরা সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেন। এ সময় কমপক্ষে ১০টি পেট্রোল বোমা বাসভবন চত্বরে ছুড়ে মারা হয়।’ সহিংস বিক্ষোভের একদিন পর রাজাপাকসেকে সরিয়ে নেয়া হয়। ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তা আরও জানান, পুলিশ উপনিবেশ শাসনামলের এ ভবনের তিনটি প্রবেশ পথের সব ক’টি থেকে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং আকাশের দিকে সতর্কতামূলক গুলি ছোড়ে। ‘টেম্বল ট্রি’ ভবনকে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক মনে করা হয়। সোমবারের ঘটনার পর থেকেই কার্যত থমথমে কলম্বো। ওই দিন কার্ফু উপেক্ষা করে রাস্তায় নামে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। দোকান, বাড়ি, সরকারী কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। হামলা চালানো হয় সরকার পক্ষের এমপি এবং নেতাদের বাড়িতেও। বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে রেহাই পেতে বহু সরকার সমর্থক পানির মধ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
মঙ্গলবার সরকারী নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী কাউকে গ্রেফতার করলে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের আগে ২৪ ঘণ্টা নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং যানবাহনে তল্লাশি চালাতে পারবে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, ‘একজন পুলিশ অফিসার কর্তৃক গ্রেফতারকৃত যে কোন ব্যক্তিকে নিকটস্থ থানায় নিয়ে যাওয়া হবে।
তবে জরুরী ক্ষমতার অপব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কয়েক বিশ্লেষক। কলম্বোভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভের কর্মকর্তা ভবানি ফনসেকা বলেন, ‘জরুরি ক্ষমতা এবং কার্ফু উভয়ই বলবত থাকা অবস্থায় এর অপব্যবহার হতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের টুইটে বলা হয়েছে, ‘শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ওয়াশিংটন। আমরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারী এবং নিরপরাধ পথচারীদের ওপর সহিংসতায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সব শ্রীলঙ্কানদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খুঁজে বের করার প্রতি মনোনিবেশ করে।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির সাবেক ক্রিকেট তারকা অর্জুনা রানাতুঙ্গা বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল মানুষ। কিন্তু তাদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করা হলো তা অপ্রত্যাশিত। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। বিভোক্ষকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেনি। যদি ঠিকমতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হতো, তা হলে এই ঘটনা ঘটত না। কলম্বো পুলিশের মুখপাত্র নিহাল থালদুয়ার বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত, তবে বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, সোমবার যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের তিন জন গুলিবিদ্ধ ছিলেন। মঙ্গলবার কলম্বোর কেন্দ্রস্থলের রাস্তাগুলোতে ভাঙ্গা কাচের টুকরা ও জুতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কাছেই আটটি পোড়া গাড়ি একটি একটি লেকের পানিতে আংশিক নিমজ্জিত অবস্থায় ছিল। এলাকাটি এখন সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সরকারী কর্মকর্তাদের দফতরজুড়ে এলোমেলো কাগজপত্র, ফাইল ও ভাংচুর করা আসবাবের আবর্জনা ছড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটে রয়েছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। বিরোধী দলগুলো এই দুর্দশার জন্য প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া এবং তার বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকেই দায়ী করে আসছেন। সোমবার রাজাপাকসের পরিবারের সমর্থকরা প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভে থাকা সরকারবিরোধীদের ওপর হামলে পড়লে সংঘাত ব্যাপক মাত্রা পায়। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন মাহিন্দা রাজাপাকসে। সন্ধ্যার দিকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা কলোম্বো থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে হাম্বানটোটায় রাজাপাকসে পরিবারের পৈত্রিক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। কয়েক এমপি এবং সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতেও এ সময় আগুন দেয়া হয়। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রায় ২০ বছর ধরে আধিপত্য করে আসছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। তার সরকারই শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে তামিল টাইগারদের নির্মূল করেছিল। সেই পরাক্রমশালী নেতাকে বিদায় নিতে হল অর্থনৈতিক দুর্দশা আর বিক্ষোভের মধ্যে। তামিল টাইগারদের নির্মূল করে প্রশংসা কুড়ালেও মাহিন্দা রাজাপাকসে সরকার পরে মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের অভিযোগে জর্জরিত হয়। সমালোচকরা তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেন। শ্রীলঙ্কার বড় সঙ্কট হয়ে এসেছে হাতে বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার না থাকা। এ জন্য সরকার মহামারীকে দায়ী করলেও বিশেষজ্ঞরা দুষছেন অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে।
শ্রীলঙ্কা সরকার এখন ৫১ বিলিয়ন ডলার দেনার ভারে ডুবতে বসেছে। ঋণের কিস্তি হিসেবে দেশটির এই বছর ৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের কথা থাকলেও ওই অর্থও দেশটির হাতে নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে হাত পাতলেও তেমন সাড়া পায়নি।