হাওরে বরাদ্দ বাড়ে উন্নয়ন হয় না, ফের কৃষকের কান্না

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সুনামগঞ্জের হাওরে হাওরে চলছে কৃষকের কান্না। পাহাড়ী ঢলে ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে ১৭টি হাওরের অন্তত ২০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। এখনও ঝুঁকিতে রয়েছে শতাধিক হাওর। উজানের ঢলে একের পর এক হাওর তলিয়ে যায় আর দুখের আকাশ ভারি হয় কৃষকের। দিন দিন সেই পরিমাণ বাড়ছে। অনিয়মের কথা খোদ কৃষিমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখে। এখনও অনেক বাঁধে ফাটল ধস। এর-ই মধ্যে নতুন করে ফাটল কিংবা ধস দেখা দিচ্ছে। ‘খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম উপসর্গ ধান’ এবং সেই ধান সুরক্ষায় বাঁধ। ২০১৭ সালে বাঁধ সংস্কারে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল তলিয়ে ব্যাপক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। লাখো কৃষকের সারাবছরের জীবিকার উৎস বিনষ্ট হয়। এই জনগোষ্ঠীকে সান্ত্বনা দিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সুনামগঞ্জ সফর করেন। কৃষকের আন্দোলনের মুখে দাবি উঠে নীতিমালা সংস্কারের। সংস্কার হয় নীতিমালা। দেয়া হয় আশ্বাস। সারাবছর দেয়া হয় কৃষকদের প্রণোদনা।
ফসলহানি হলেই কর্তৃপক্ষ মুখস্থ কথা বলে উজানের ঢলে (ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে অত্যধিক বৃষ্টিপাত) হাওড়ে পানি ঢুকেছে। এসব কথা বিভ্রান্তিকর। হাওড়াঞ্চলের অবস্থান ভারতের চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে। যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে ঢল নেমে ছড়া-খাল-নদী দিয়ে ভাটিতে চলে যায়। এটাই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম। আগাম বন্যা তিন-চার বছর একটানা নাও হতে পারে। যা আমরা ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত দেখেছি হাওরাঞ্চলসহ দেশবাসী। একমাত্র ফসল বোরো ধান রক্ষায় বাঁধের কাজ করাই হয় পাহাড়ী ঢল ঠেকানোর জন্য। বারবার হাওরে বিপর্যয়ের কারণ মূলত ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি দাবি করছেন হাওর বিশ্লেষকরা।
জানা যায়, ফসল রক্ষা বাঁধের কার্যক্রম ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবোর) একক নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। বাঁধের কাজ করা হতো প্রধানত ঠিকাদারদের মাধ্যমে। বরাদ্দ দেয়া হত দশ থেকে ১২ কোটি। এখন যেটি প্রতি বছর শতকোটির উপরে। জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদারি ব্যবস্থা রহিত করে হাওড় এলাকায় পাউবোর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত, নদী বা খাল পুনর্খননের জন্য স্কিম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ করা হয়। নীতিমালা পরিবর্তন হলো কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে। ভাগ্য কৃষকের পরিবর্তন না হয়ে ভাগ্য পরিবর্তন হয় ৩য় আরেক পক্ষের। কৃষকরা নিজেদের ফসল রক্ষায় নিজেরা কাজ করবে। টাকা দেবে সরকার। সঠিকভাবে বাঁধ মেরামত করতে পারবে এই আশাবাদ তৈরি হয়। এর পরও কেন ফসলহানি হচ্ছে ? এই প্রশ্ন সুধী মহলে।
২০১৮ সাল থেকে কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। তখন থেকেই নতুন ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। লুটপাটের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক অপ্রয়োজনীয় বাঁধ তৈরি করা হয়। প্রয়োজনীয় বাঁধগুলোতে দুরমুজ করা হয় না নীতিমালানুযায়ী। লাগানো হয় না ঘাস। অথচ এসব খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকে। গোড়া থেকে মাটি কেটে করা হয় দুর্বল বাঁধ। থাকে না নিয়ম অনুযায়ী বাঁধের ঢাল। এসব বিষয়ে প্রতি বছরই কথা হয়। আন্দোলনও হয়। সক্রিয় হয়না কেবল কর্তৃপক্ষ। বিগত চার বছর পাহাড়ী ঢল না আসায় বাম্পার ফলনে নীতিমালার দুর্বলতা ও অনিয়ম নিয়ে কেউ আসেনি এভাবে। এবারের ফসলহানির পর ফের বিষয়গুলো সামনে চলে আসে দাবি করছেন হাওড় আন্দোলনে সংশ্লিষ্টরা।
সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী স্কিম প্রস্তুত, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কাজের সমন্বয়ের জন্য জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি রয়েছে। আছে উপজেলা পর্যায়েও ইউএনও সভাপতি, পাউবোর একজন প্রকৌশলী সদস্য সচিব কমিটি। পিআইসি গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ৬(৩) দফায় বলা হয়েছে, পিআইসির ক্ষেত্রে বাঁধের সন্নিকটবর্তী জমির প্রকৃত মালিকদের সমন্বয়েই কেবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিআইসি গঠন করবেন। প্রয়োজনে ভূমি অফিস, কৃষি অফিস ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পরামর্শ করবেন। পিআইসিগুলোর কাজ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করে পূর্বোক্ত একই উপজেলা কমিটি। একটি প্রকল্পে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ হয়। কোন কোন উপজেলায় শতাধিক প্রকল্পও হয়। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের দায়িত্ব মূলত দুজন ব্যক্তির ওপর অর্পিত। কমিটি রাবার স্ট্যাম্প মাত্র। তদুপরি পিআইসি গঠন এককভাবে ইউএনওর দায়িত্ব। রয়েছে এমপি-সচিবদের ডিও লেটারের উৎপাত ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ। অভিযোগ খোদ পিআইসি সদস্যসহ সংশ্লিষ্টদের।
পিআইসি গঠিত হবে গণশুনানির মাধ্যমে। শুধু সংশ্লিষ্ট হাওরে ধান আবাদ করেছেন এমন কৃষকদের নিয়ে। ফসল সুরক্ষার স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের আগ পর্যন্ত বাঁধনির্ভরতা মূলত অস্থায়ী ব্যবস্থা। হাওরের ফসল সুরক্ষা করতে হাওরের জন্য প্রকল্প সেই হাওরের কৃষক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি। বর্তমানে বিদ্যমান উপজেলা কমিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন তদারকি করবে। সংশোধিত ২০১৭ নীতিমালানুযায়ী মনিটরিং কমিটিতে স্থানীয় কৃষক সংগঠন প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মীদের রাখার বিধান রয়েছে। রাখাও হয় ঠিক। তবে সেটি সভাপতির একান্ত নিজস্ব লোক। হয়না কোন আলোচনা-পর্যালোচনা। ভূত শর্ষেতেই। বিগত চার বছর ধরে এই তদারকি কমিটিতে একই লোক রয়েছেন। জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী নীতিমালা সংশোধন হয়েছে ঠিকই। বাস্তবায়নে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে স্থানীয় প্রশাসন, পাউবো ও তদারকি কমিটির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট। পিআইসি মূলত আইওয়াশ বা রাবারস্ট্যাম্প কমিটি। বাঁধে দেখভালে থাকে ওই সিন্ডিকেটচক্র। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য অগ্রিম এক থেকে দুই লাখ টাকা দিতে হয় এবং ওই সিন্ডিকেট চক্রকে আবার কাজ শেষ করার পর ফাইনাল বিল নেয়ার সময় আবারও বিভিন্ন অজুহাতে পূর্ণাঙ্গ বিলে অর্ধেক রেখে যেতে হয় পিআইসি কমিটিকে। ফলে ২০% থেকে ৩০ % কাজ হয়। বাকি টাকা সিন্ডিকেট চক্রের।
হাওড় বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, প্রথমত যত দ্রুত সম্ভব মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারাসহ হাওরাঞ্চলের সব নদী-নালা হাওড়ের ভেতরে অবস্থিত বিলসমূহ সীমানা নির্ধারণ করে খনন করতে হবে। নীতিমালার বাস্তব প্রয়োগ যাতে হয় তার জন্য পিআইসি গঠন থেকে ফসল উঠানো পর্যন্ত জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও পাউবোর অনলাইন পেইজ আপডেট রাখতে হবে। এ সময় তিনি বলেন, আমাদের কাছে প্রমাণ আছে একই পরিবারে বাবা, ছেলে, ভাই, চাচা, শ্যালক মিলে এগারোটি পিআইসি নেয়ার। নিয়মানুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর পিআইসি কাজ শুরু করবেন এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করতে হবে। ১৮ সাল থেকে কোন বছর এটি করতে পারেনি প্রশাসন ও পাউবো। দেখা গেছে ১৯ মার্চেও কাজ শুরু করেছে। এভাবে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা থেকে প্রশাসন ও পাউবোকে বের হয়ে আসতে হবে। তদারকি কমিটি আরও শক্তিশালী করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবিও তুলেন এই হাওর আন্দোলনের নেতা।
এদিকে আবারও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বুধ ও বৃহস্পতিবার দুদিনের সফরে সুনামগঞ্জ আসছেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ পরিদর্শন করবেন বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে।