চৈত্রসংক্রান্তি আজ

2

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাঙালির বর্ষবিদায়ের ঐতিহ্যবাহী দিন চৈত্রসংক্রান্তি আজ। পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়/নতুনেরা আসিতেছে ব’লে…। হ্যাঁ, নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার স্বার্থেই পুরনোকে বিদায় জানাবে বাঙালি। আজ ৩০ চৈত্রের সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালের গর্ভে হারাবে ১৪২৮ বঙ্গাব্দ।
বছরের সমাপনী দিনে এক সময় গোটা দেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে ব্যাপকভাবে পালন করা হতো চৈত্রসংক্রান্তি। এখন ততটা দেখা না গেলেও, ঐতিহ্য মেনে চলে নানা আনুষ্ঠানিকতা। এবারও বিভিন্ন প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
দীর্ঘ এক বছরে কত সুখস্মৃতি! পাওয়ার আনন্দ, না পাওয়ার বেদনা। হাপিত্যেশ। ঘটনা-দুর্ঘটনা। অমোঘ নিয়মে সবই পেছনে পড়বে। তবে পুরনো মানেই ছুড়ে ফেলার নয়। সবই একদিন পুরনো হয়। গত হয়। পাওয়া, না পাওয়া, পেয়ে হারানোর ব্যথা স্মৃতি হয় একদিন। তাই বলে মূল্যহীন হয়ে যায় না। প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে হয়। প্রিয় সময়কে ফেলে আসতে হয় পেছনে। একই নিয়মে পুরনো হয় মাস। বছর। সকল পুরনো থেকে শিক্ষা নিয়েই সাজাতে হয় নতুনকে। অভিজ্ঞতার আলোকে গড়তে হয় ভবিষ্যত। চৈত্রসংক্রান্তির তাৎপর্য এখানেই।
সংক্রান্তি মানে, এক ক্রান্তি থেকে আরেক ক্রান্তিতে যাওয়া। কিংবা বলা যায়, এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় পৌঁছানো। ক্রান্তির সঞ্চার। ক্রান্তির ব্যাপ্তি। সূর্যসহ বিভিন্ন গ্রহের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন। মহাকালের অনাদি ও অশেষের মাঝে ঋতু বদল করতে করতে এগিয়ে চলা। বর্ষ বিদায়ের এ দিনটি লোকজ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই উদযাপন করে থাকেন। গ্রামের ঘরে ঘরে চলে বর্ষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা। সনাতন প্রথার অনুসারীরা চৈত্রসংক্রান্তিকে গ্রহণ করেন পুণ্যের দিন হিসেবে। পঞ্জিকা মতে, দিনটি মহাবিষুব সংক্রান্তি। আদিবাসীরাও এই দিনে মহাআনন্দে মাতে। পাহাড়ে পাহাড়ে চলে বর্ণাঢ্য উৎসব আয়োজন।
এক সময় চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রামের নারীরা মাটির ঘরদোর লেপা-পোছা করতেন। এমনকি গোয়ালঘরটি পরিষ্কার করা হতো। সকাল সকাল গরুর গা ধুয়ে দিত রাখাল।
ঘরে ঘরে বিশেষ রান্না হতো। উন্নতমানের খাবার ছাড়াও তৈরি করা হতো নক্সি পিঠা, পায়েস, নারিকেলের নাড়ু। দিনভর চলতো খাওয়া দাওয়া। প্রিয়জন পরিজনকে নিমন্ত্রণ করা হতো। গ্রামের গৃহস্থরা নতুন জামা কাপড় পরতেন। নাতি-নাতনিসহ মেয়েজামাইকে সমাদর করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। তাদের জন্যও থাকত নানা উপহার সামগ্রী। বর্তমানেও এ ধরনের নানা আচার পালন করা হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করেন। ফোকলোরবিদদের মতে, চৈত্র মাসে স্বামী সংসার কৃষি ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারীরা ব্রত পালন করতেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকত। থাকত নিরামিষ, শাকসবজি আর সাত রকমের তিতা খাবারের ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশ বিল খাল থেকে শাক তুলে রান্না করতেন গৃহিণীরা। এই চাষ না করা, কুড়িয়ে পাওয়া শাক ক্ষেতে বাগানে বেশি বেশি পাওয়া গেলে বিশ্বাস করা হতোÑ সারাবছরের কৃষিকর্ম ঠিক ছিল। মানুষ, তার চারপাশের প্রকৃতি ও প্রাণগুলোর আপন হয়েছিল কৃষি। একই কারণে নতুন বছর নিয়ে দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠতেন তারা।
চৈত্রসংক্রান্তির মেলাও খুব আকর্ষণীয়। একসময় চৈত্রসংক্রান্তি মানেই ছিল চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। এ সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় চড়ক উৎসবের আয়োজন করা হতো। চৈত্র মাসজুড়ে সন্ন্যাসীরা উপবাস, ভিক্ষাণ্ন ভোজনসহ নানা নিয়ম পালন করতেন। সংক্রান্তির দিন তারা শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঝুলতেন। পাখির মতো শূন্যে উড়ে বেড়াতেন। গাছের চারপাশে ঘুরতেন। হাজার হাজার মানুষ তা উপভোগ করতে আগে থেকে সেখানে জড় হতেন। যে গ্রামে আয়োজন, সে গ্রামের আশপাশের, এমনকি দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন চড়ক উৎসব দেখতে আসতেন। এখানেই শেষ নয়, সন্ন্যাসীরা আগুনের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে অবাক করে দিতেন।
চৈত্রসংক্রান্তিতে আয়োজন করা হতো গাজনের মেলা। মেলার সঙ্গে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম সম্পৃক্ত। যেমনÑ শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি। এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পত্নীরূপে কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিয়ে দেয়াই এ উৎসবের উদ্দেশ্য। গাজন উৎসবের পেছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতন বিশ্বাস ক্রিয়া করে। ধারণা করা হয়, চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচ- উত্তপ্ত থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় অতীতে কোন এক সময় কৃষিজীবী সমাজ এ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিল। গাজনের মেলা ছাড়াও যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। মেলায় মাটি, বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা ইত্যাদি বিক্রি হয়। বিভিন্ন প্রকার খাবার, মিষ্টি, দই পাওয়া যায়। এক সময় মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল বায়স্কোপ, সার্কাস ও পুতুল নাচ। এসব আকর্ষণে দূর গ্রামের দূড়ন্ত ছেলেমেয়েরাও মেলায় যাওয়ার বায়না ধরত। এ সময় হালখাতার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, লাঠিখেলা, গান, আবৃত্তি, সঙযাত্রা, রায়বেশে নৃত্য, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো।