আজ পাক পার্লামেন্টে ভোট ॥ কোন প্রধানমন্ত্রীই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি

2

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে দেশটির কোন প্রধানমন্ত্রীই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ক্রিকেট মাঠ থেকে প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসা ইমরান খানের বেলায়ও তাই ঘটল। শনিবার দিন ও রাতভর উত্তেজনা এবং নাটকীয়তার পর মসনদ হারান ইমরান খান। জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান গদিচ্যুত হওয়ার পর থেকে দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নর্বাচনে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও পাক মুসলিম লীগ-(নওয়াজ) প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ ও সদ্য ক্ষমতাচ্যুত পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পিটিআই নেতৃত্বাধীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি এ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য রবিবার মনোনয়ন দাখিল করেন। আজ দুইটার পর দেশটির জাতীয় পরিষদের নিম্ন্নকক্ষে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ভোট হবে। এখানে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবেন তিনিই চলমান মেয়াদের বাকি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত স্পীকার আয়াজ সাদিক বলেন, শনিবার মধ্যরাতে ইমরান খানের সরকার অপসারণের পরপরই নতুন সরকার নির্ধারণে তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। সোমবার পাকিস্তানের স্থানীয় সময় বেলা ২টার দিকে পার্লামেন্টে সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। আয়াজ সাদিক বলেন, প্রার্থীদের রবিবার দুপুর ২টার মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে।
পাক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী পদে মুসলিম লীগ নেতা শাহবাজ শরীফ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ছোট ভাই। পাশাপাশি ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন শাহবাজ শরীফ।
অপরদিকে পাক রাজনীতির ঝানু খোলোয়ার ও ইমরানের ডান হাত হিসেবে পরিচিত শাহ মাহমুদ কোরেশিও জয়ের ব্যাপারে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। মনোনয়ন দাখিলের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অপেক্ষা করুন, আমরাই ফিরতে পারি।
বিরোধী নেতা শহীদ খাকান আব্বাসি, সৈয়দ নাভিদ কামার, খুরশিদ আহমেদ শাহ, মহসিন দাওয়ার এবং অন্যদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় পরিষদের সচিবালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন শাহবাজ শরিফ।
এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, জাতীয় সম্প্রীতিই হবে তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়। পাশাপাশি ধসে পড়া পাক অর্থনীতি চাঙ্গা করে জনগণকে স্বস্তি দেয়া হবে তার প্রধান কাজ। সিনিয়র এই মুসলিম লীগ নেতা আরও বলেন, বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করার পর তিনি নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করবেন এবং একটি নতুন যুগের সূচনা এবং দেশে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতির ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। পরমাণু সমৃদ্ধ চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তিনি বলেন, আমরা ভারতের সঙ্গে শান্তি চাই। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ছাড়া তা সম্ভব নয়। তিনবারের সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মামলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শাহবাজ শরিফ বলেন, মামলা আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
এদিকে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছে ওয়াশিংটন। ইমরান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে ওয়াশিংটনের ষড়যন্ত্র আছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে সেটি নাকচ করে দিয়ে রবিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, এটি একেবারেই সত্য নয়। এই ধরনের কথা ¯্র্েরফ গুজব। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ইমরান দাবি করেন তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির কারণে কিছু ‘বিদেশী শক্তি’ বিরক্ত। তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে বিরোধীদের অর্থায়ন করেছে সেই শক্তিরা। এখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করেন। শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ইমরান খান পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠী পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ একজন কূটনীতিক হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। অপর এক বিবৃতিতে ইমরান খান মার্কিন ওই কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেন। তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
এসবের প্রেক্ষিতে রবিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জেলিনা পোর্টার বলেন, আমি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলছি, ইমরানের এসব অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। তিনি আরও বলেন, আমরা পাকিস্তানের ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর রাখছি। পাকিস্তাননের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ও আইনের শাসনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এবং সমর্থন রয়েছে। কিন্তু আমি আবারও বলছি, এসব অভিযোগ একেবারেই সত্য নয়।
শনিবার রাতে পাক জাতীয় পরিষদে ইমরানের আনা বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হয়। ভোটাভুটিতে ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট পড়ে ১৭৪টি। ৩৪২ আসনের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবটি পাসের জন্য দরকার ছিল ১৭২ ভোট। পাকিস্তানে এ পর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রীই তার পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। তবে এভাবে অনাস্থার মাধ্যমে ইমরান খানই প্রথম তার প্রধানমন্ত্রিত্ব হারালেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী। রবিবার ইসলামাবাদের রাস্তায় বিরোধীরা উল্লাস প্রকাশ করে। রাজধানীতে ব্যাপক নিরাপত্তা সদস্যদের উপস্থিতি রয়েছে। তবে তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটার খবর পাওয়া যায়নি। পাক সুপ্রীম কোর্টের রায় অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্য নির্ধারণে শনিবার সকালে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যথারীতি শুরু হলেও ক্ষমতাসীন দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) অনাস্থা প্রস্তাব বিলম্বিত করার কৌশল গ্রহণ করে। বিরোধীরা হট্টগোল শুরু করলে পাকিস্তানের স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি করেন স্পীকার আসাদ কায়সার। অধিবেশন ১২টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুর দুইটার পর শুরু হয়। দ্বিতীয় দফা অধিবেশন শুরু হলে পিটিআই আবারও অধিবেশন করার কৌশল নেয়। দলটির নেতা ও মন্ত্রীরা বেশি সময় ধরে বিরোধীদের উদ্দেশে আক্রমণাত্মক বক্তৃতা শুরু করেন। এ সময় পার্লামেন্টে বারবার উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে শনিবারের অধিবেশনে ইমরান খান যোগ দেননি। স্থানীয় সময় শনিবার রাত আটটায় ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট গ্রহণের কথা রয়েছে। মুলতবি হয়ে যাওয়া অধিবেশন দুপুর আড়াইটায় শুরু হলে শাহ মাহমুদ কোরেশি বক্তব্য শুরু করেন। বিরোধীরা বলেন, অধিবেশন ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করা হয়েছে এবং ইমরান খানের দলের মন্ত্রীরা বক্তৃৃতা দীর্ঘ করার চেষ্টা করছেন। সাংবাদিক হামিদ মীর বলেন, ‘সংসদের অধিবেশন মুলতবি হওয়ার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি ভাষণ দেন। তার ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই অধিবেশন স্থগিত করা হয়। বিরতির পর তিনি আবারও ভাষণ শুরু করেন। ইমরান খান তাকে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা কথা বলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।’ এদিকে, অনাস্থা ভোট যাতে অনুষ্ঠিত না হয় সেজন্য অধিবেশন দীর্ঘায়িত করার সরকারের পরিকল্পনার পাল্টা কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফের চেম্বারে পরামর্শক বৈঠক করে দেশটির বিরোধী দলগুলো। সংসদের অধিবেশনের বিরতির সময় এই বৈঠক করে তারা। পরে সরকারী ও বিরোধী দল সংসদে শৃঙ্খলা বজায় এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে বক্তৃতা দেয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায়।
বৃহস্পতিবার পাক সুপ্রীমকোর্ট প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব খারিজের সিদ্ধান্ত বাতিল করেন এবং জাতীয় পরিষদ পুনর্বহাল করে ফের অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট গ্রহণের আদেশ দেন। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, অন্তর্র্বতী প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বনিম্ন্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১ বছর। এই সময়ের মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন দিতে হবে অন্তর্র্বতী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারকে। সুপ্রীমকোর্টের রায়ে আনন্দ প্রকাশ করে টুইটারে পিপিপি নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি লিখেন, ‘গণতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ প্রতিশোধ ! জিও ভুট্টো, জিও আওয়াম, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। জাতীয় পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শীর্ষ আদালতের এ রায় গণমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। তিনি আরও বলেন, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সংবিধান ও পাকিস্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে। আদালতের স্বতন্ত্র ও মর্যাদা সমুন্নত থেকেছে। পার্লামেন্ট ও এর সার্বভৌমত্বকে দৃঢ় করতে সর্বসম্মতক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়ায় শীর্ষ আদালতকে ধন্যবাদ জানান শাহবাজ শরিফ। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াই লড়ব।’ গত বৃহস্পতিবার রাতে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের এক বেঞ্চ ওই আদেশে পাক মন্ত্রীসভাকে পুনর্বহাল এবং শনিবার পার্লামেন্টে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আয়োজনের নির্দেশ দেন। প্রধান বিচারপতি ওমর আতা বন্দিয়াল বলেন, জাতীয় স্বার্থ এবং বাস্তব সম্ভাবনা দেখেই আদালত এগিয়ে এসেছেন। পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেয়ার অধিকার নেই প্রধানমন্ত্রীর। এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। এদিকে সর্বোচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার আগে ইমরান খান বলেছিলেন, শীর্ষ আদালতের যেকোনও সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত তিনি। ইমরান বলেছিলেন, আমরা সুপ্রীমকোর্টের যেকোন সিদ্ধান্ত মেনে নেব। পিটিআই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত এবং আমরা কোন বিদেশী ষড়যন্ত্র সফল হতে দেব না।