সিলেটের নদ-নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এখন প্রকট সমস্যায় রূপ নিয়েছে। নদী থেকে অপরিকল্পিত ও অবৈধ্যভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদ-নদীর তীর ভাঙনে নদীর মানচিত্র পরিবর্তন হচ্ছে। নদী ভাঙনে বিলিন হচ্ছে অনেক ফসলি জমি, বাড়ি ঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে মঙ্গলবার দুপুরে বাপাসহ ছয়টি পরিবেশবাদী সংগঠন একটি নাগরিক শুনানি কর্মসূচির আয়োজন করে। হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বেলা ১১টায় বাপা হবিগঞ্জের সভাপতি অধ্যাপক মো. ইকরামুল ওয়াদুদ এর সভাপতিত্বে এই নাগরিক শুনানি’র কার্যক্রম শুরু হয়।
সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন নদ নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও নাগরিক প্রতিনিধিরা শুনানিতে অভিযোগ উত্থাপন করেন।
পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট জুরি বোর্ড অভিযোগকারীদের বক্তব্য শোনেন। জুরি বোর্ডের প্রধান ছিলেন বাপা কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, সদস্য ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুদীপ্ত অর্জুন, প্রবীণ সাংবাদিক এডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল, লেখক তাহমিনা বেগম গিনি ও প্রবাসী কমিউনিটি নেতা এডভোকেট রাফি চৌধুরী।
প্রতীকী এই কর্মসূচিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিনিধিত্ব করেন সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আব্দুল করিম কিম, প্রশাসনের পক্ষে ছিলেন এডভোকেট তাহমিনা খান এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিনহাজ উদ্দিন শুভন।
অভিযোগগুলোর পক্ষ অবলম্বন করে সাক্ষী হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছামির মাহমুদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক সোয়েব চৌধুরী, এডভোকেট বিজন বিহারী দাস, লেখক ও গবেষক সিদ্দিকী হারুন প্রমুখ।
শুনানিতে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন নদী থেকে অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলনের অভিযোগ তুলে ধরেন ভুক্তভোগী মানুষেরা। তারা জেলা প্রশাসনের কাছে এসব সমস্যার প্রতিকার চেয়েছেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বাপা হবিগঞ্জ এর সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল।
নাগরিক শুনানির আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ( বাপা), ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার, সারি বাঁচাও আন্দোলন এবং বাঁচাও বসিয়া নদী ঐক্য পরিষদ।
নাগরিক শুনানিতে বলা হয়, সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই, মনু, যাদুকাটা, সারি, গোয়াইন, পিয়াইন, ধলা, লোভা, ধলাই, লাঘাটা, করাঙ্গি, চেঙেরখাল, কালনি, রত্না, নলজুর, চেলা, চলতি, ধোপাজান নদীসহ বিভিন্ন পাহাড়ি ছড়া থেকে অবৈধ্যভাবে নির্বিচারে বালু উত্তোলন চলছে। যা বন্ধে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা রয়েছে। অবাদে বালু উত্তোলনের কারণে নদীগুলোর তীর ভেঙে সাধারণ মানুষকে সর্বশান্ত করছে। নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য সরকার নির্ধারিত বালু মহাল ইজারা প্রদান করে। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ ইজারা নেয় এক জায়গার আর বালু উত্তোলন করে অন্য জায়গায়। ইচ্ছেখুশি মতো ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করতে থাকে। যা নদীর ক্ষতিতো করেই, পাশাপাশি নদী তীরবর্তী মানুষকে সর্বশান্ত করে দেয়।
নাগরিক শুনানি শেষে আট দফা পর্যবেক্ষণসহ রায় ঘোষণা করেন জুরি বোর্ডের প্রধান শরীফ জামিল।
রায়ে বলা হয়, বালু উত্তোলনের জন্য সিলেট অঞ্চলের নদ-নদী ও জলাশয়সহ সংশ্লিষ্ট গ্রাম ও কৃষি জমি এবং প্রাণ-প্রকৃতি চরম হুমকির সম্মুখীন। এতে সমাজে একটি অবৈধ সুবিধাভোগী শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে। যা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি। বালু মহাল ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ ও নাগরিক প্রতিনিধির সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। জুরি বোর্ড লক্ষ্য করেন যে, বালু উত্তোলন একটি প্রয়োজনীয় বিষয় তবে তা পরিকল্পিত হওয়া বাঞ্চনীয়। এক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। বালু মহালের তালিকা যথাযথভাবে প্রণয়ন করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে এবং নির্দিষ্ট বালু মহালের সীমানায় সাইনবোর্ড লাগাতে হবে।
আদালতের রায় অনুযায়ী জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা ও নদী কমিশন আইনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সাথে উপজেলা-জেলা ও বিভাগীয় কমিটিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক গঠন ও কার্যকর করতে হবে। যৌথনদী কমিশনকে দেশের সীমান্তবর্তী নদী সমূহের পানি, পলি, বালু এবং অন্যান্য খনিজ উপাদানের প্রবাহ ও পরিমান সংক্রান্ত তথ্যপ্রাপ্তি ও তা ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সরকারী ও স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা, শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বালু উত্তোলন, নদী ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি, বেসরকারী সামাজিক সংগঠন সমূহকে সক্রিয় ও দৃশ্যমান ভূমিকা পালন করতে হবে।
নাগরিক শুনানিতে পিয়াইন, ডাউকি, ধলা, লোভা ও চেঙেরখাল নদীর পক্ষে আব্দুল হাই আল হাদী, খোয়াই নদী মাসুলি এলাকা থেকে অভিযোগ করেন শেখ ওসমান গনি রুমি, খোয়াই নদী শায়েস্তাগঞ্জ এলাকা ও সুতাং নদী নিয়ে সাংবাদিক মামুন চৌধুরী, সারি নদী নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন শামিম আহমেদ, খোয়াই নদীর চুনারঘাট অংশ নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন মনসুর আহমেদ এবং নুর উদ্দিন সুমন, কুশিয়ারা নদী নবীগঞ্জ অংশ নিয়ে অভিযোগ করেন সাংবাদিক সনি চৌধুরী, জাদুকাটা, ধোপাজান নদী নিয়ে কথা বলেন শিমন চৌধুরী, কুশিয়ারা ও কালনী নদীর আজমিরীগঞ্জ এলাকার পক্ষে সাংবাদিক শরীফ চৌধুরী, রত্না, কুশিয়ারা এবং হাওর অঞ্চলের বালুচর নিয়ে কথা বলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মোমিন, সাংবাদিক আব্দুল হালিম প্রমুখ। বিজ্ঞপ্তি