কাজিরবাজার ডেস্ক :
চীনের মধ্যস্থতায় কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার সরকার। এ লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়ে বাংলাদেশকে চিঠিও দিয়েছে। মিয়ানমারের নেপিদো থেকে জানানো হয়েছে, প্রথম ধাপে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে তারা প্রস্তুত। জাতিসংঘও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবে। মঙ্গলবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গণমাধ্যমকর্মীদের এ কথা জানান।
সূত্র জানায়, চীনের মধ্যস্থতার কারণে মিয়ানমারের নেপিদো থেকে জানানো হয়েছে, প্রথম ধাপে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রস্তুত তারা। এর ফলে যে কোন মুহূর্তে শুরু হতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে ঢাকা-নেপিদো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান নিয়ে চীন সরকার মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয়। এ উপলক্ষে চীনের প্রতিনিধিদল একাধিকবার বৈঠকও করেছে ঢাকা ও নেপিদোর সঙ্গে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠকে দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত তিনটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোকে সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ।
তবে ২০২১ সালে হঠাৎ করোনার কারণে এই প্রক্রিয়া মাঝপথে পুরোটাই থেমে যায়। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দুদেশের কারিগরি কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু করতে আবারও আলোচনা শুরু করে চীন। এতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে। তারা (মিয়ানমার জান্তা) প্রথম ধাপে ৭০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে প্রস্তুত বলে ঢাকাকে একটি তালিকাও পাঠিয়েছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, মিয়ানমারে নির্বাচন, সামরিক অভ্যুত্থান এবং করোনার কারণে বহুদিন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পুরোটাই থমকে ছিল। চলতি বছরের ২৭ জানুয়াারি দুদেশের কারিগরি কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে আবারও রোহিঙ্গা ফেরত নেয়া বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। আরআরআরসি তথা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের তালিকা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। তারা যাচাই বাছাই করে এই তালিকার পর্যায়ক্রমে তালিকা প্রস্তুত করে পাঠানোর কথা। এখন পর্যন্ত তারা (মিয়ানমার) ফেরত নিতে মাত্র ২৮ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছে ঢাকায়। কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা শামসুদ্দোজা নয়ন মঙ্গলবার বিকেলে বলেন, বিভিন্ন দফে এ পর্যন্ত ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে মিয়ানমারের নিকট। এরপর ২০২১ সালে করোনা পরিস্থিতির কারণে থমকে যায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত কার্যক্রম। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবকিছু এলামেলো হয়ে পড়ে। করোনা পরিস্থিতি কেটে ওঠায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ফের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, এ পর্যন্ত মিয়ানমার মাত্র ২৮হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই বাছাই সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো আরও ৮লাখ এক হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে ইতোপূর্বে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের জানিয়েছিল মিয়ানমার। সম্প্রতি প্রথম ধাপে সাতশ’ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে আগ্রহের কথা জানিয়ে ঢাকাকে চিঠি দিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। যাচাই-বাছাই শেষে এই ৭শ’ রোহিঙ্গাকে দ্রুত ফেরত নিতে তালিকাও পাঠিয়েছে ঢাকায়। তবে বাংলাদেশ চাইছে পরিবারভিত্তিক ১১০০ জন রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে প্রথম ধাপে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, মিয়ানমারের নেপিদো থেকে জানানো হয়েছে, প্রথম ধাপে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুতে প্রস্তুত তারা। এখন পর্যন্ত ২৮ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই শেষ করেছে মিয়ানমার। পর্যায়ক্রমে আশ্রিত সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব বলে আশা করছে বাংলাদেশ। আর এই প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায় ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করেই সম্পন্ন হবার কথা রয়েছে। জাতিসংঘও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর উভয়পক্ষ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের পূর্ববর্তী আবাসিকতা নিশ্চিতে দেরির কারণ খুঁজে বের করতে কারিগরি পর্যায়ের এই আলোচনায় নিজেদের স্বদিচ্ছার কথা জানায়। বৈঠকে কারিগরি জটিলতা ও তথ্যের ঘাটতির কথা তুলে ধরে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল অনিষ্পন্ন ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া শেষ করতে সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছিল।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়া টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রিত সাধারণ রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে রাজি বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে প্রত্যাবাসন শব্দ মুখে নিলেই ক্যাম্পে তাদের ওপর বিপদ ঘটায় সন্ত্রাসীরা। হয়তো অপহরণ নতুবা খুন করে লাশ গুম করে ফেলে আরসা ক্যাডাররা। ক্যাম্পে আশ্রিত একাধিক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, যেভাবে ভাসানচরে নেয়া হচ্ছে-ঠিক তদ্রƒপ প্রত্যাবাসনে রাজি রোহিঙ্গাদের প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যেতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় ওই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে মিয়ানমারে। নিজ দেশে ফেরত যাচ্ছে খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে ওই রোহিঙ্গাদের ওপর চড়াও হবে আরসা ক্যাডাররা। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের মংডু, রাচিদং, বুচিদং ও আকিয়াবে এখনও বসবাসরত অবস্থায় রয়েছে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা।
বলা বাহুল্য, রাখাইনে সেনা অভিযানে ঠিকতে না পেরে ২০১৭সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী ২ মাসে বাংলাদেশে চলে আসে সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি এ পর্যন্ত।