কাজিরবাজার ডেস্ক :
শূন্য থেকে শুরু হওয়া এ যাত্রা। আজ বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচির রোল মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজ মিলে দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত টিকা দেয়া হয়েছে ২২ কোটি ডোজ। ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে প্রথম ডোজের লক্ষ্যমাত্রা। দ্বিতীয় ডোজও পেয়ে গেছেন সাড়ে ৮ কোটি মানুষ। বাকি থাকা আরও প্রায় ৪ কোটি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজের আওতায় আনতে ২৮ মার্চ বিশেষ ক্যাম্পেন পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
প্রথম ডোজের মতো দ্বিতীয় ডোজের এ বিশেষ ক্যাম্পেনেও ‘এক দিনে এক কোটি’ ডোজ টিকা দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। আর এই ক্যাম্পেনের মাধ্যমেই দ্বিতীয় ডোজের টিকাদান কর্মসূচীও সীমিত করা হচ্ছে। তাই এই সময়ের মধ্যেই দ্বিতীয় ডোজের টিকাপ্রত্যাশীদের টিকা নেয়ার আহ্বান সংশ্লিষ্টদের।
তবে শুধু প্রথম বা দ্বিতীয় ডোজ নয় বুস্টার ডোজের জন্যও বিশেষ ক্যাম্পেনের ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। যেহেতু চলতি মাসে দ্বিতীয় ডোজের টিকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিশেষ ক্যাম্পেন পরিচালিত হবে তাই বুস্টার ডোজের ক্যাম্পেন আগামী এপ্রিল মাসেই হতে পারে। আর এর মাধ্যমেই শেষ হবে দেশজুড়ে বৃহদাকারে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচী। এরপর নিয়মিতভাবে অন্যান্য টিকার মতোই চলবে এ কর্মসূচীও। প্রত্যেকেই টিকা পাবে তবে তা একেবারেই সীমিত কেন্দ্রে। এতে চলতি বছরের মাঝামাঝিতেই বড় আকারে টিকাদান কর্মসূচীর সমাপ্তি হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। মাত্র দু’বছরের মাথায় এত বড় একটি কর্মযজ্ঞ সম্পাদন সরকারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিরাট সাফল্যে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলের স্থান অর্জন করেছে বলে দাবি করছেন স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ১০ মার্চ পর্যন্ত দেশজুড়ে প্রথম ডোজের টিকার আওতায় এসেছেন ১২ কোটি ৫৮ লাখ ৪৮ হাজার ৪৫৩ জন। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৮ কোটি ৮৬ লাখ ৪ হাজার ৬১৫ জন। আর বুস্টার ডোজের আওতায় এসেছেন ৪ কোটি ৬ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬ জন। শুধু তাই নয় এখন পর্যন্ত ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ১ম ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯০ হাজার ১৯৪ জনকে আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫১ জন। টিকার আওতায় আসা ভাসমান মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৯০ হাজার ৮১২ জন। এখন পর্যন্ত সুরক্ষা এ্যাপে টিকা পেতে নিবন্ধন করেছেন ৯ কোটি ৭৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৬৪ জন।
তাদের মধ্যে অনেকেই টিকা পেতে অপেক্ষমাণ থাকলেও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় অনেকটাই স্বস্তিজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে শনাক্তের হার ১ শতাংশ ছিল, মৃত্যুও ছিল ৩ জনে। তবে এ পরিসংখ্যান থেকেও করোনাকে আমরা কমাতে চাই। একেবারে শূন্যের কোঠায় নামাতে চাই। এ জন্য সবাইকেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, দেশে এ মুহূর্তে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা এটিকে নিয়ন্ত্রণেই রাখতে চাই। এ লক্ষ্যেই টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এমনকি টিকা কর্মসূচী ভালভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। ইতোমধ্যেই আমাদের ২২ কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। যার সাড়ে ১২ কোটি প্রথম ডোজ ও সাড়ে ৮ কোটি দ্বিতীয় ডোজ। বিশেষ ক্যাম্পেনে এক দিনে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে টিকাদানে ২০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম স্থানে পৌঁছেছে। এ সব কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার গাইডলাইনে আমরা কাজ করেছি। তিনি বলেন, কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে করোনা প্রতিরোধে বুস্টার ডোজের ক্যাম্পেন শুরু হবে। যারা বুস্টার ডোজ নেয়নি, তারা যেন অতিদ্রুত নিয়ে নেয়, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।
তবে চলতি মাসেই বুস্টার ডোজের বিশেষ ক্যাম্পেন হবে কিনা তা নিশ্চিত নন স্বাস্থ্য অধিদফতরের টিকাদান কর্মসূচীর সমন্বয়ক অধ্যাপক ডাঃ শামসুল হক। তিনি বলেন, আমরা এখন দ্বিতীয় ডোজের বিশেষ ক্যাম্পেন পরিচালনার লক্ষ্যে কাজ করছি। আগামী ২৮ তারিখ দেশজুড়ে পরিচালিত এ ক্যাম্পেনের মাধ্যমে আমরা প্রথম ডোজের মতো দ্বিতীয় ডোজের কার্যক্রমও সীমিত করে ফেলব। এরপর যারা বাকি থাকবেন দ্বিতীয় ডোজের তাদের নির্দিষ্ট কয়েকটি কেন্দ্র থেকেই টিকা গ্রহণ করতে হবে। এরপর পরই আমরা জোর দেব বুস্টার ডোজে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আশা করছি আগামী এপ্রিল মাসেই বুস্টার ডোজের বিশেষ ক্যাম্পেন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সবচেয়ে বেশি জরুরী মানুষের আগ্রহ। টিকা নিতে মানুষ যদি কেন্দ্রে না আসে তাহলে তো মুশকিল। আর তাই এখনও যারা দ্বিতীয় ডোজের বাকি আছে তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে এই সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করুন। এখন যেমন প্রথম ডোজের টিকা সহজপ্রাপ্য হচ্ছে না ঠিক এরকমই ২৮ তারিখের পর দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেতেও ভোগান্তি হবে। শিক্ষার্থীদের টিকাদান কর্মসূচীর ব্যাপারে অধিদফতরের টিকা কর্মসূচীর দায়িত্বপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার্থীদের আমরা বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছি। এখন কেন্দ্র সীমিত করা হয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যেহেতু এখনও অনেকে শিক্ষার্থী দ্বিতীয় ডোজের টিকার বাকি রয়েছে তাদের জন্য ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালসহ কয়েকটি কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে প্রথম ডোজের টিকা কার্ড নিয়ে গেলেই তারা টিকা পেয়ে যাবে। একটা বিষয় নিয়ে কতদিন কাজ করা যায় বলেন? এক সময় না এক সময় তো শেষ করতেই হবে। এরপর টিকাদান কর্মসূচী চলবে এখন যেমন পোলিও বা অন্যান্য রোগের টিকা দেয়া হচ্ছে এরকম ভাবেই। কারণ আজ যে ১১ বছর ১১ মাসের সে তো আগামী মাসেই ১২ বছরে পা দেবে। তাহলে তার তো টিকা পেতে হবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবেই থাকবে। ১২ বছরের কম বয়সীদের টিকাদানের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ব্যাপারে এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলেনি তাই আমরাও এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আমাদের কাছে যথেষ্ট টিকাও মজুদ আছে। যে মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ঘোষণা আসবে আমরা কাজ শুরু করে দিতে পারব।
গত বছরের ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয় ভারত থেকে আসা অক্সফোর্ড এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে। কিন্তু ওই সময় দেশটিতে করোনার ডেল্টা ধরনের মহামারী আকার ধারণ করলে বন্ধ করে দেয় টিকা রফতানি। ফলে বাংলাদেশেও মুখ থুবড়ে পড়ে টিকাদান কার্যক্রম। কিন্তু টিকাপ্রাপ্তিতে সরকারের নানামুখী তৎপরতায় অবশেষে সাফল্য আসে। চীনের তৈরি সিনোফার্মের টিকা দিয়ে আবারও শুরু হয় টিকাদান কার্যক্রম। এরপর ধারাবাহিকভাবে কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় জাপান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ থেকে আসতে থাকে অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও। একসময় যুক্তরাষ্ট্রও পাঠাতে শুরু করে ফাইজারের টিকা। এতে টিকাদান কার্যক্রম চলে পূর্ণদ্যোমে। সাধারণ মানুষদের পাশাপাশি গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় ১২-১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদেরও টিকাদান কর্মসূচী। ১৬ নভেম্বর থেকে রাজধানীর বস্তিগুলোর বাসিন্দাকেও টিকা দেয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ভাসমান জনগোষ্ঠীকেও টিকার আওতায় নিয়ে আসার কর্মসূচী।