কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ চার শহরে ফের সাময়িক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার জন্য কিয়েভ, খারকিভ, মারিওপোল ও সুমিতে সাময়িক সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। মস্কোর স্থানীয় সময় সোমবার সকাল ১০টা থেকে এসব শহরে মানবিক করিডর চালু হয়।
রুশ বাহিনীর অভিযানে মারিওপোল ও খারকিভে মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কিয়েভের পরিস্থিতিও একই রকম। শহরগুলোকে অনেকটা অবরুদ্ধ করে ফেলেছে রুশ বাহিনী। পরিস্থিতি বিবেচনায় সোমবার থেকে শহরগুলোতে মানবিক করিডর খোলার ঘোষণা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী। এর আগে মারিওপোল ও ভলনোভাখা শহরে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েও হামলা অব্যাহত রাখে রুশ বাহিনী। সাময়িক যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় ইউক্রেনকে পাল্টা দায়ী করেছে মস্কো। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ব্যক্তিগত অনুরোধে এবং সেসব শহরের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক করিডর খুলে দেয়া হচ্ছে। রাজধানী কিয়েভসহ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়া চারটি শহরই বর্তমানে ব্যাপক রুশ আক্রমণের অধীনে রয়েছে।
এর আগে ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বের শহর মারিওপোল থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্য দুই দফায় যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে একটি মানবিক রুট খোলার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। যুদ্ধবিরতি ও সাধারণ মানুষকে সরিয়ে নেয়ার ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় পরস্পরকে দোষারোপ করেছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন। গত শনিবার প্রথম দফায় একটি খ-কালীন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতির ঘোষণার কিছু সময় পরই নতুন করে বোমা হামলা শুরু হওয়ায় সেটি ব্যর্থ হয়। এরপর রবিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় খ-কালীন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়।
মোদি-জেলেনস্কি দীর্ঘ ফোনালাপ : ইউক্রেনের চলমান সঙ্কট নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনালাপ হয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। দুই নেতার মধ্যে ৩৫ মিনিট আলাপ হয়। ইউক্রেনের সুমি শহরে আটকে পড়া ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিতে জেলেনস্কির সহযোগিতাও চেয়েছেন মোদি। রুশ আগ্রাসনের ফলে শহরটিতে অবরুদ্ধ প্রায় ৭০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী। হামলার কারণে সেখানে সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দেয়ায় জমে থাকা তুষার সংগ্রহ করতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেন সঙ্কটের কারণে যে গভীর মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। একইসঙ্গে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধেরও আহ্বান জানান তিনি। মোদির বরাতে বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সঙ্কট উত্তরণে ভারত সবসময় আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। দেশটিতে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে দিল্লী। সুমিতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত থাকতে বলেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে দ্রুত তাদের নিরাপদে বের করার প্রচেষ্টা চালানো হবে।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করুন- পশ্চিমাদের জেলেনস্কি : রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করতে পশ্চিমা নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ইউক্রেনে রুশ অভিযান তীব্র থেকে তীব্র হওয়ার মধ্যেই এমন আহ্বান জানালেন তিনি। এক ভিডিও বার্তায় পশ্চিমা নেতাদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইউক্রেনের সামরিক এবং শিল্প স্থাপনায় আঘাত হানার ঘোষণা দিলেও এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি পশ্চিমা নেতারা। জেলেনস্কি বলেন, পশ্চিমা নেতাদের একটি সিঙ্গেল শব্দ প্রতিক্রিয়া দেখাতে আমি শুনিনি। আক্রমণকারীদের সাহসিকতা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, আগের নিষেধাজ্ঞাগুলো যথেষ্ট নয়। যারা এই ধরনের অপরাধের আদেশ দেয় এবং পরিচালনা করে তাদের বিচারের আওতায় আনতে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি।
চীন-রাশিয়া সম্পর্ক পাথরের মতো শক্ত- বেজিং : ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান সামরিক অভিযানে আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও বেজিং এবং মস্কোর মধ্যে বন্ধুত্ব এখনও ‘খুব শক্তিশালী’ বলে মন্তব্য করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া সঙ্কটে শান্তির জন্য মধ্যস্থতায় সহায়তা করতে প্রস্তুত আছে চীন। গত কয়েক মাস ধরে পূর্ব ইউরোপের প্রতিবেশী দুই দেশের মাঝে চলমান এই সঙ্কটে বেজিং অত্যন্ত কৌশলী কূটনৈতিক পথে হেঁটেছে। গত মাসে দুই দেশের ‘সীমাহীন’ কৌশলগত অংশীদারিত্বের কথা উল্লেখ করে ঘনিষ্ঠ মিত্র মস্কোর নিন্দা জানাতে অস্বীকার করে বেজিং। এমনকি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণকে ‘আগ্রাসন’ হিসেবে বলতেও নারাজ চীন। সোমবার এক বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে ওয়াং ই বলেছেন, দুই দেশের মাঝে বন্ধুত্ব একেবারে ‘পাথরের মতো শক্ত’ এবং উভয়পক্ষের ভবিষ্যত সহযোগিতার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তিনি বলেন, চীন প্রয়োজনীয় মধ্যস্থতা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। গত সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছিলেন, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যত শান্তি আলোচনায় চীনের মধ্যস্থতা করা উচিত।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বেকায়দায় যুক্তরাষ্ট্র : ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমারা। এই নিষেধাজ্ঞা মূলত সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার একটি কৌশল। আর সে কারণেই পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞাকে ‘যুদ্ধের শামিল’ বলে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। কিন্তু রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে সঙ্কটে পড়েছেন পশ্চিমাদের নেতৃত্ব দেয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তেল আর গ্যাস নিয়ে শুরু হয়েছে তাদের মাথাব্যথা। এরই মধ্যে এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ববাজারে। ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উঠেছে জ্বালানি তেলের দাম। সোমবার অপরিশোধিত তেলের দাম এশিয়ার বাজারে ব্যারেল প্রতি ১৩৯ ডলার ছুঁয়েছে। পরে প্রতি ব্যারেলে তেলের বাড়তি এ দাম গিয়ে স্থির হয়েছে ১৩০ ডলারে। জ্বালানি তেলের এই সঙ্কট যে শুরু হবে তা আগেই আঁচ করতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাই ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর আগেই গত মাসে রিয়াদে যান মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ দূত আমোস হোচস্টেইন। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে তেলের বাজারে সম্ভাব্য প্রভাব ঠেকাতেই সৌদি প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তবে সৌদি আরবের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি। এখন তেলের বাজারের অস্থিরতায় বিপাকে পড়ে ভেনেজুয়েলায় ছুটছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। গত শনিবার দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা। ইউক্রেন হামলার ঘটনায় রাশিয়াকে একঘরে করতে ভেনেজুয়েলাকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি জানিয়েছিলেন, জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। রাশিয়ার ওপর থেকে জ্বালানি নির্ভরতা কত দ্রুত কমানো যায়, সেদিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে এসব আশ্বাসের পরও জ্বালানি তেলের দাম কোনভাবেই কমছে না। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইউরোপের ৪৫ শতাংশ গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। যুদ্ধ শুরুর পরও সেই গ্যাস পাঠাচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু এর শেষ যে কোথায় হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। যদিও রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপ লাইনে গ্যাস নেয়া স্থগিত করে রেখেছে জার্মানি।