কাজিরবাজার ডেস্ক :
ফেসবুকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সেজে বেকারদের চাকরি দেয়ার আশ্বাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রংপুরের জমসেদ আলীর ছেলে নওশাদ। তাকে ধরার পর র্যাবের শাসানিতে গলগলিয়ে বলে দিয়েছে কিভাবে মন্ত্রী সেজে নির্বিঘ্নে ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে টাকা আত্মসাত করেছে।
আইজিপি বেনজীরের আত্মীয় পরিচয়ে প্রতারণা করত সালাহ উদ্দিন ভুইয়া। সে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। তবে যেই মুহূর্তেই ব্রিগেডিয়ার সেজে এক জায়গায় গিয়ে ফুটানি মারে তখনই ধরা খায় র্যাবের হাতে। এখন আছে রিমান্ডে। জিনের বাদশাহ সেজে মালয়েশিয়া প্রবাসীর স্ত্রীর কাছ থেকে শুধু টাকাই নয়- ইজ্জতও লুটে নিয়েছে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার কবিরাজ মোহাম্মদ আলী (৬২)। শেষে তাকে গণধোলাই খেয়ে যেতে হয়েছে শ্রীঘরে।
এমবিবিএস ডাক্তার সেজে খোদ রাজধানীতেই আলিশান চেম্বার খুলে জটিল রোগের চিকিৎসা দিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়েছে অষ্টম শ্রেণী পাস কাদের। সব রোগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে রোগী দেখেছে একজন নামকরা ডাক্তারের আত্মীয়ের। তাতেই ধরা খাওয়া।
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানা এলাকার মালয়েশিয়া প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে কৌশলে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে এক জিনের বাদশাহকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তার নাম কবিরাজ মোহাম্মদ আলী (৬২)। ভিকটিম নারীর একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
প্রতারণার এমন কেস স্টাডি প্রতি সপ্তাহে কিংবা মাসেই মিলছে। গত এক মাসে খোদ রাজধানীতেই এ ধরনের কমপক্ষে অর্ধশত প্রতারক ধরা পড়েছে। বছরজুড়েই এমন কাহিনী ফাঁস হচ্ছে। গোয়েন্দারা যত দক্ষ হাতে তাদের ওপর নজর রাখে- ওরাও ততই নিত্যনতুন কৌশল উদ্ভাবন করে। যে কারণে থামছে না প্রতারণা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আইজিপি নুরুল আনোয়ার বলেন, প্রতারণা একটি আনন্দদায়ক শিল্প, যা অর্জন করতে হয় একান্তই নিজস্ব যোগ্যতা বলে। সবাই প্রতারণা করতে পারে না। সবাই প্রতারণা করে না। সাহেদ থেকে কাদের, সাবরিনা থেকে নাদিরা- কেউ-ই ফেলনা নয়। আমলে নেয়ার মতো যোগ্যতার বলেই তারা দিব্যি রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা, জায়গা জমি, গাড়ি বাড়ি, লাইসেন্স ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। প্রতারকদের নিখুঁত কৌশলে ধরাশায়ী হন ড. মুশা বিন শমসেরের মতো ধূূর্তরাও। একজন অষ্টম শ্রেণী পাস ব্যক্তি কিভাবে সচিব হয়ে সমাজের রথীমহারথীদের চোখে ধুলো দিয়ে হাতিয়ে নেয় তার স্বার্থ, কিংবা একজন মেট্রিক পাস যুবক কিভাবে এমবিবিএস হয়ে নির্বিঘ্নে রোগী দেখে সেজে যায় বিশেষজ্ঞ- তার নজির তো সাম্প্রতিককালেরই। সর্বশেষ এইট পাস কাদেরের প্রতারণার কাহিনী তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দারা পেয়েছেন অবিশ্বাস্য কাহিনী।
তিনি বলেন, এখন প্রতারণা হচ্ছে সেক্টরভিত্তিক। যেমন জিনের বাদশাহ, এইট পাস ডাক্তার, সচিব, জমির ক্রেতা বিক্রেতা, বিদেশে লোক পাঠানোর আদম ব্যবসায়ী, বেকারদের চাকরিদাতাসহ সব সেক্টরেই চলছে প্রতারণা। তবে প্রশাসন চাইলে কিছু কিছু প্রতারণা রোধ করতে পারে। যেমন জমিজমার প্রতারণা। এক শতাংশ জমি কিনে ওই এলাকায় বিশাল হাউজিংয়ের বিশাল সাইনবোর্ড লাগানোর সঙ্গে জড়িতরা প্রশাসনকে হাত করেই প্রতারণা করে। এসিল্যান্ড চাইলেই অফিসে বসে নিশ্চিত হতে পারেন কার জমিতে কে সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন। এ ধরনের প্রতারণা ধরা অনায়াসেই সম্ভব। কিন্তু এমন কিছু প্রতারণা আছে যা প্রথমেই ধরা কঠিন। যেমন দুবছর আগে করোনা ক্রান্তির শুরুতে ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ঘটনা। প্রতারক সাহেদ মন্ত্রী এমপি সচিবদের নাম ভাঙ্গিয়ে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছে সেটা খোদ র্যাবও বিশ্বাস করতে পারেনি। ওই সাহেদের উত্থান কাহিনী বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দাদের অভিমত হচ্ছে- সাহেদরা প্রতারণা করার সুযোগ পায় মানুষের অতিরিক্ত লোভের কারণে। দুর্যোগময় পরিস্থিতি কিংবা মহামারীর সুযোগটাকে প্রতারকরা কিভাবে পুঁজি করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে হয় তার বড় নজির ডাক্তার সাবরিনা। বছর দুয়েক আগে এই দুজনের প্রতারণার শিকার হাজার হাজার করোনা রোগীর আলাদা আলাদা কেস স্টাডি দেখে প্রতারণার অনেক রহস্য জানা গেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, ইদানীং প্রতারণার কৌশল পাল্টেছে। যেমন এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে ভিন্ন কৌশলে ডিজিটাল প্রতারণা চলছে। রংপুরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, এমপির নাম ও ছবি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ফেক আইডি খুলে ছবি ও কর্মসূচীর বিভিন্ন ছবি সেই এ্যাকাউন্টে পোস্ট করে প্রচারণা চালাচ্ছিল নওশাদ। অসহায় বেকারদের বাণিজ্যমন্ত্রীর বেশধরে চাকরি দেয়ার নাম করে প্রলোভনের মাধ্যমে আকৃষ্ট করতেন। ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে চাকরির বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। দীর্ঘদিন যাবৎ রংপুর জেলার মহানগরসহ আশপাশের এলাকার অসহায় বেকারদের টার্গেট করে চাকরি দেয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। সে নিয়মিত বাণিজ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন কর্মসূচীর ছবি পোস্ট দিতে যাতে মানুষ সত্যি বলে বিশ্বাস করে।
এক সাহেদেই কাবু : দেশে তোলপাড় সৃষ্টিকারী রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদের প্রতারণা নিয়ে মিডিয়ায় সিরিজ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তিনি নিজেকে দেশের উদীয়মান টকশো আলোচক হিসেবে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপি ও আমলাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার ছবি দেখে সবাই সমীহ করত। ফলে তার হাসপাতালে কি ধরনের চিকিৎসা দেয়া হতো সেটা জানারও প্রয়োজন মনে করত না খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও। মন্ত্রীরা তাকে ফোন করে করোনা রোগীর সুচিকিৎসার তদ্বির করতেন। দেশের খ্যাতমানা সাংবাদিক থেকে বুদ্ধিজীবীসহ অনেকেই তার আতিথিয়েতা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিতে তিনি গ্রেফতার হবার পরই বেরিয়ে আসে প্রতারণার ভয়ঙ্কর কাহিনী। নাইন পাস সাহেদ নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন, এমন বাচনভঙ্গিতে কথা বলতেন, বিদ্যা বুদ্ধি জাহির করতেন যে সত্যিকার মেধাবীরাও হা করে তা গিলতেন। অথচ এই সাহেদ যখন খাঁচায় বন্দী, তাকে হাতকড়া লাগানোর দৃশ্য দেখে অনেক খ্যাতিমানরা তাদের ফেসবুক পেইজ থেকে তার ছবি ডিলিট করে দিয়ে রক্ষা পেয়েছেন। সেই সাহেদ এখন কারাগারে। বিচারের মুখোমুখি। প্রতারণা মামলায় বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। সাহেদ ছাড়াও মামলার আসামি রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মাসুদ পারভেজ ও রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার শিপন আলী।
কীট প্রতারণায় ডাঃ সাবরিনা : প্রতারণায় কতটা মেধা কাজে লাগাতে হয়, কতটা দুঃসাহস দরকার- তার জ্বলন্ত উদাহরণ ডাঃ সাবরিনা দম্পতি। করোনার ভুয়া রিপোর্ট তৈরির ঘটনায় জেকেজি হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয় ২০২০ সালের ১২ জুলাই স্বামী-স্ত্রী মিলেই এই প্রতারণা করেন বলে অভিযোগ।
এই দম্পতির জীবনও রূপকথার গল্পের মতোই। আরিফের চতুর্থ স্ত্রী সাবরিনা। আরিফের এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, অন্যজন লন্ডনে। আরেকজনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তবে ছাড়াছাড়ির পরও সাবেক ওই স্ত্রী উচ্চমহলে আরিফের জন্য দেন দরবার করে যাচ্ছেন। মূূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি ভাগিয়ে নেয় অনেকটা অখ্যাত জেকেজি নামে এই প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তিতুমীর কলেজে মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা এবং অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তারা। স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্ট করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পেয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধর করেন আরিফ চৌধুরী। পরে এ ঘটনায় স্বামীর বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করেন ডাঃ সাবরিনা। এছাড়া জেকেজির এক কর্মীকে অশালীন প্রস্তাব দেয়ার ঘটনায় গুলশান থানায় আরিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। বিএমএর নেতার পরিচয় ভাঙিয়ে চলাফেরা করেন ডাঃ সাবরিনা। ওই নেতার ছত্রছায়াই এতদিন ছিলেন সাবরিনা। আরিফ-সাবরিনার প্রতিষ্ঠান জেকেজির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল এবং নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দিত। জানা গেছে- জেকেজি হেলথকেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনার টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনার আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। আরিফ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, জেকেজির ৭-৮ কর্মী ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেন। জেকেজির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতেন। প্রতি রিপোর্টে ৫-১০ হাজার টাকা নেয়া হতো। আর বিদেশীদের কাছ থেকে নেন ১০০ ডলার। সেই হিসাবে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টে প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জেকেজি।
এসএসসি পাস এমবিবিএস ডাক্তার : এসএসসি পাস, অথচ দাবি করত চীনের তাইশান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস পাস করেছে। কারোর পক্ষে সেটা চ্যালেঞ্জ করা বা সত্যতা দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। তাই দিব্যি চালিয়ে গেছে চিকিৎসা বাণিজ্য। তারপর নিজেই গড়ে তোলেন একটি হাসপাতাল। যেখানে বসে নিজেই সব রোগী দেখত। এভাবেই রাতারাতি হয়ে গেছেন গাজীপুরের খ্যাতিমান চিকিৎসক। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। তখনই প্রকাশ পায় ডাঃ মো, শিবলী সাদিক আসলে একটা দুর্র্ধষ প্রতারক ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনই অবিশ্বাস্য কাহিনী প্রকাশ করেছে দুদক। গত ১৯ জানুয়ারি এমবিবিএস পাসের ভুয়া সনদ ব্যবহার করে চিকিৎসক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নেয়া সাত চিকিৎসককে রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে গ্রেফতার করে দুদক। তাদের সূত্র ধরেই শিবলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ভুয়া ১২ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুদক। ওই মামলায় শিবলী সাদিককে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। মোঃ শিবলী সাদিক নামের ওই ব্যক্তি ১৯৯৮ সালে বিকেএসপি থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি পাস করলেও ২০০০ ও ২০০১ সালে দুবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এরপর একটি প্যারাডেমিক ডিপ্লোমা ডিগ্রী ও ভুয়া এমবিবিএস সার্টিফিকেট নিয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর মোড়ে কাশিমপুর ডক্টরস হাসপাতালে ডাঃ হিসেবে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছিল।
দুদক জানিয়েছে, আসলে সে চীনের ভুয়া ডিগ্রী দিয়ে বিএমএ ও বিএমডিসির নিবন্ধন নিয়েছে। এভাবে প্রতারণা করে সাভারে পাঁচতলা বাড়ি, দামি গাড়ি ও নিজের হাসপাতালসহ গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। এর আগে চীনের তাইশান মেডিক্যাল থেকে এমবিবিএস পাসের ভুয়া সনদধারী সাত চিকিৎসককে গ্রেফতার করে দুদক।
অতিরিক্ত সচিব : ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাঠ প্রশাসন) কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে অর্থ দাবি করা প্রতারক ও মাদক কারবারি মোঃ সাজেদুর রহমানকে (৪০) গ্রেফতার করেছে র্যাব-১। এই প্রতারক সাজেদুর রহমান ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের রাজস্ব প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফোন করে বিকাশে অর্থ দাবি করে আসছিল। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দিয়ে কতিপয় প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য কিছুদিন ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা, মাদক ব্যবসাসহ নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত করে আসছিল বলে জানিয়েছিল মন্ত্রণালয়।
র্যাবের তদন্তে দেখা যায়, সে ২০০১ সালে রংপুর হতে বিএ পাস করে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে এসআর পদে যোগদান করে। চাকরির পাশাপাশি বিগত ১ বছর যাবত প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিল। সে নিজেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, জনসংযোগ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত তহসিলদারদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়ে তাদের নিকট হতে নগদ টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও সে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার পাশাপাশি মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত বলে ধৃত আসামি স্বীকার করে। এর আগে সে ডিবি সদস্য হিসাবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণামূলক কর্মকান্ড করায় পৃথক মামলায় গ্রেফতার হয়েছিল।
মিসেস আইজিপি : ‘আপনি কী পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার। আমার বাসায় একজন কাজের মেয়ে রয়েছে। তার ভরণ-পোষণ এবং বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। একটি ভাল ছেলে পেয়েছি ওই কাজের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য। এজন্য ছেলেটিকে পুলিশের কনস্টেবল পদে একটি চাকরি দিতে হবে। আমি ছেলেটির তথ্য পাঠালাম। ওর জন্য কনস্টেবল পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিবেন।
গত ৭ নভেম্বর এভাবেই পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে রুমা আক্তার (৩২) নামে এক কথিত নারী টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সারের ব্যক্তিগত মোবাইলে কথাগুলো বলছিলেন। এরপর পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আইজিপির স্ত্রী পরিচয় দেয়া ওই নারী একজন প্রতারক। পরে ১১ নভেম্বর রাতে ঢাকার সাভার থেকে ওই নারীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার রুমা আক্তার বাঘেরহাটের চিতলমারি উপজেলার আসলাম মিয়ার স্ত্রী। তার সম্পর্কে পুলিশ গত ৭ নবেম্বর বেলা ১১টা সাত মিনিটে ওই নারী টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপারের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন করে নিজেকে আইজিপির স্ত্রী পরিচয় দেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কনস্টেবল পদে একজন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে চাপ দেন এবং ১১টা ২৪ মিনিটে মোবাইলে এসএমএসে ওই প্রার্থীর তথ্য পাঠান। এ নিয়ে সন্দেহ হলে পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি শাখা গোয়েন্দা ও প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার আটিবাজার ঘাটারচর এলাকায় ওই নারী প্রতারকের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। পরে সাভার থেকে ওই প্রতারক রুমা আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়।
মুসাও প্রতারণার শিকার : প্রতারণার ফাঁদে ধরা খেয়েছেন মুসা বিন শমসেরের মতো ব্যক্তির। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়ে তিনিও বলেছেন-জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের একজন মিথ্যাবাদী। আমিও প্রতারণার শিকার হয়েছি। এ ভুয়া অতিরিক্ত সচিবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব, তার বিরুদ্ধে মামলা করব।
গত ১২ অক্টোবর ডিবি কার্যালয়ে যান মুসা বিন শমসের। সেখানে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে সন্ধ্যায় তিনি ডিবি কার্যালয় থেকে বের হন। এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুসা বিন শমসের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন- একজন ফ্রড লোক অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে ভুয়া কার্ড ছাপিয়ে আমার অফিসে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে বিভিন্ন সময় ছবি তুলেছিল এবং সে মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বসে ঊর্ধ্বতন লোকদের সঙ্গে কথা বলত। তাদের মধ্যে আইজিপি, আর্মির জেলারেলসহ ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলত। আমার বিশ্বাস ছিল যে, সে অতিরিক্ত সচিব। কিন্তু পরে প্রমাণিত হলো, সে অতিরিক্ত সচিব না, সে একজন ভুয়া অতিরিক্ত সচিব। পরে তাকে বের করে দিলাম আমি। ডিবি আমাকে আব্দুল কাদেরের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং আমি যা যা জানি সবকিছু স্পষ্ট বলেছি। আমার বক্ত্যব্যে ডিবি পুলিশ সন্তুষ্ট।
আইন উপদেষ্টা পরিচয় দেয়ার বিষয়ে মুসা বিন শমসের বলেন, আব্দুল কাদের মিথ্যা কথা বলেছে। সে আমার আইন উপদেষ্টা ছিল না। তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ছবি তোলার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে অনেক লোক এসে ছবি তোলে। কেউ ছবি তুলতে চাইলে আমি তাকে না করতে পারি না। আমার ছবি দেখিয়ে যদি কেউ প্রতারণা করে, সেটার দায়-দায়িত্ব আমি নিতে পারি না। প্রতারক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে ২০ কোটি টাকার চেকের লেনদেনের তথ্য পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওটা আমি ফেরত দিয়ে দিয়েছি।
ফেসবুকে প্রতারণা : প্রতারণার সর্বশেষ সংস্করণ হচ্ছে ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুকে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে প্রবাসী নারীকে ব্ল্যাকমেইল করার অপরাধে এসএম হুমায়ুন কবীর রকি (৩০) নামে এক যুবককে আলাদা দুটি ধারায় পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে ওই আসামিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। গত ২০ জানুয়ারি রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ জিয়াউর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। দন্ডিত আসামি এসএম হুমায়ুন কবীর রকি রাজধানীর মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার এসপি রোডের বাসিন্দা এসএম আজিজুল হকের ছেলে।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর বগুড়া সদর থানায় রকির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ৫৭ বছর বয়সী বগুড়ার এক নারী বাদী হয়ে ওই মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, বাদীর মেয়ে ও জামাতা ওমানে থাকেন। আসামি হুমায়ুন কবীর রকির সঙ্গে তাঁর মেয়ের ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয়। সেই সুবাদে হুমায়ুন কৌশলে তাঁর মেয়ের কিছু ছবি নেন। এরপর সেসব ছবি সম্পাদনা করে ফেসবুকে প্রচার করার হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করে। এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে এক লাখ টাকা নেয়ার পরও আরও টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন হুমায়ুন। বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীর মা থানায় মামলা করেন।
সুন্দরী সেজে প্রতারণা : চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি সুন্দরী নারী সেজে প্রবাসীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায়ের অভিযোগে তিন প্রতারককে গ্রেফতার করে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব-১১। প্রবাসী মোঃ আনোয়ার হোসেনের (৪০) অভিযোগের প্রেক্ষিতে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো- সদর উপজেলার পূর্ব এহজবালিয়া গ্রামের আব্দুল মতিনের বাড়ির আব্বাস উদ্দিনের স্ত্রী মাহমুদ আক্তার আঁখি ওরফে সুমাইয়া আক্তার বিথী ওরফে সাবিনা (২৬), নোয়াখালী শল্লা ঘাটাইয়ার মোঃ আরিফুল ইসলাম (৩০) এবং মধ্যম চর উরিয়া গ্রামের ইস্কান্দার মিয়া বাড়ির আবুল কালামের ছেলে মোবারক হোসেন ওরফে সোহেল (২৭)। লক্ষ্মীপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার খন্দকার মোঃ শামীম হোসেন জানান- কয়েক বছর আগে বিথীর সঙ্গে ইমুতে সৌদি আরব প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর বিথী প্রতারণার আশ্রয় বিভিন্ন সুন্দরী তরুণীদের ছবি আনোয়ারের কাছে পাঠিয়ে ওই ছবির তরুণী হিসেবে নিজেকে দাবি করেন এবং তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেন। একপর্যায়ে বিয়ে করার কথা বলে কয়েক ধাপে বিকাশে ও ব্যাংক এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা এবং স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নেন। কিছু দিন আগে ওই প্রবাসী দেশে ফিরে ওই নারীকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিলে তিনি নানা টালবাহানা করেন। প্রবাসী প্রতারণার শিকার হয়েছেন বুঝতে পেরে র্যাব-১১ এর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
নানক সেজে প্রতারণা : আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক পরিচয় দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ফোন করে চাকরির সুপারিশ করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তারেক সরকার নামে এক প্রতারক। ১৯ জানুয়ারি পল্টনের পলওয়েল সুপার মার্কেট এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত ডিভাইস ও সিমকার্ড জব্দ করে পুলিশ। ডিবি জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের ফোনে আওয়াামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের পরিচয়ে একটি নম্বর থেকে কল করেন তারেক। তিনি একটি চাকরির বিষয়ে সিনিয়র সচিবকে সুপারিশ করেন। সন্দেহ হলে সিনিয়র সচিব ডিএমপির উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানান। ডিএমপির উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিবি মিরপুর ওই ফোন নম্বরের খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে- নম্বরটি জাহাঙ্গীর কবির নানকের নয়। এটি এক প্রতারকের। তিনি নানকের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তার রাজনৈতিক ও সামাজিক সুনাম ক্ষুণ্ন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন। তারেক জিজ্ঞাসাবাদে ডিবিকে জানান, তিনি গত ২১ নবেম্বর নরসিংদী জেলার সদর থানা এলাকার ইনডেক্স প্লাজা মার্কেটে অবস্থিত এক্সচেঞ্জ গ্যালারি নামক দোকান থেকে অপো ব্র্যান্ডের একটি ফোন কেনেন। কেনার সময় ওই দোকান থেকে অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা রবি অপারেটরের সিমকার্ড নিয়ে যান। এ ফোন এবং রবি নম্বর ব্যবহার করে তিনি গত ১৬ জানুয়ারি বিকেলে নানকের নাম-পরিচয় ব্যবহার করে সিনিয়র সচিবকে কল করেন। অথচ তারেক নরসিংদী জেলা জাতীয়তাবাদী প্রচারদলের সদস্য সচিব। তিনি ২০০৬ সালে কারারক্ষী পদে নিয়োগ পান। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার কারণে চাকরিচ্যুত হন। বর্তমানে তিনি প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার নাম ব্যবহার করে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কল দিয়ে তদবির বাণিজ্য করেন। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের মধ্যে নিয়োগ সংক্রান্তহ বিভিন্ন কাগজ-পত্র (যেমন, এডমিট কার্ড, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, নিয়োাগ প্রতি আর্থিক লেনদেনের হিসাব ইত্যাদি) পাওয়া গেছে।
সিনেম্যাটিক প্রতারণা : সিনেমার কাহিনীর মতোই টাকা বিনিময়ে নিজের সাজা আরেকজনকে দিয়ে খাটানোর পরিকল্পনা করে প্রায় পার পেয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বিধি বাম। টিকেট ভিসা সব কিছু ঠিক থাকার পরও করোনা পরিস্থিতির দরুন দুবাই যাওয়া হয়নি। এ অবস্থায় টিকা নিতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন র্যাবের হাতে। এই ভয়ঙ্কর প্রতারক ও অপরাধীর নাম সোহাগ ওরফে বড় সোহাগ। অন্যদিকে তার পক্ষে প্রক্সি দিয়ে জেলে গিয়ে এখনও বন্দিত্বের অভিশাপে আটকা আরেক মাদকাসক্ত হতভাগা। তার নাম মোঃ হোসেন (৩৫)। তিনি চেষ্টা করেও আর বের হতে পারছেন না কারাগার থেকে। এমন প্রতারণায় বিস্মিত উভয়ের পরিবারই।
কী বলছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা : এ সব প্রতারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ড. জিয়া রহমান বলেন- একই ধরনের প্রতারণা বারবার সুযোগ পায় প্রতারকরা দুটো কারণে। প্রথমত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের লোভ ও দ্বিতীয়ত অজ্ঞতা। এ দুটো ক্ষেত্রে যত দিন পরিবর্তন না আসবে ততদিনই এ ধরনের সমস্যা বা অপরাধ থেকেই যাবে। যেমন আমি মেজর অমুক বলছি, মন্ত্রীর পিএস বলছি। ফোনে এমন বাণী পেয়েই মানুষ কিছুটা হলেও প্রাথমিকভাবে একটা বিশ্বাস বা ধারণা পেয়ে যায়। যাকে ফোন করা হয় তার হয়তো দেখা গেছে ফোনের ওপ্রান্তের মেজর বা পিএসকে যাচাই করার মতো তাৎক্ষণিক কোন উপায় বা সুযোগ থাকে না। ফলে সব মানুষ না হলেও কিছু মানুষ তাতে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলেও হয়তো সাড়া দিয়ে তার সমস্যার সমাধান পেতে চাইবে। মানুষের দুর্বল দিকগুলোা সম্পর্কে জেনেই যখন প্রতারক ফোন করে তখন তো আরও সহজে বিশ্বাস জন্মে। যেমন স্বামীর চরিত্রগত কোন দুর্বল দিক নিয়ে যদি রাত গভীরে জিনের বাদশাহ পরিচয়ে ফোন করেন-তাহলে স্ত্রী কিছুটা হলেও তাতে সাড়া দেবে। অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কারে বিশ্বাসী লোকদের তো প্রতারকরা অনায়াসেই কাবু করতে পারে। কিংবা দীর্ঘদিনের কোন বেকার যুবকের কাছে যদি কোন মন্ত্রীর পিএস এপিএস পরিচয়ে ফোন করে চাকরির আশ্বাসে কিছু চায়- যৌক্তিক তথ্য দিয়ে- তখন ওই যুবকও শেষ চেষ্টা হিসেবে ধরা দিবে। এভাবেই মূলত প্রতারকরা সুযোগ নেয়।
এগুলো কিভাবে রোধ করা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমাদের তো অনেক সীমাবদ্ধতা। প্রথমত, আমরা বেশির ভাগই অজ্ঞ ও অসচেতন। প্রতারকদের সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা ও সতর্কতামূলক প্রচার চালাতে হবে। দ্বিতীয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি করে সক্রিয় হতে হবে। যেমন জনবল বাড়ানো ও লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কোন প্রতারক সম্পর্কে জানতে চেয়ে যদি ভুক্তভোগীরা যদি থানাতে ফোন করে কিংবা ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়ে না পায় তাহলে তো আর কোথাও যাওয়ার থাকে না। সেজন্য আইনশৃৃঙ্খল বাহিনীকে আরও এ বিষয়ে শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান আইনে প্রতারণার যে সাজা রয়েছে তা কার্যকর নয়। ভয়ঙ্কর প্রতারণা করেও অপরাধী ক’দিন পরই জামিনে এসে ফের সক্রিয় হয়। সাজাও তেমন বেশি নয়। এজন্য দ্রুত বিচার আইনে যদি অজামিনযোগ্য ধারা সংযোজন করা যায়- তাহলে প্রতারকরা অপরাধ করার আগে সাত বার চিন্তা করবে।
সাহেদ ও ডাঃ সাবরিনাদের মতো সমাজের তথাকথিত সুশীল প্রতারকদের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, এরা আবার একটু ভিন্ন ধরনের বা এক্সক্ল’ুসিভ প্রতারক। তারা যেভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ছবি তুলে প্রচার করে বেড়ায় তাতে তো অন্যরা তাদের খাতির করাটাই স্বাভাবিক। প্রতারক সাহেদের সঙ্গে তো একটা টকশোতে আমারও ছবি আছে। আমার পক্ষে তো সেটা যাচাই বা সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। কারণ আমার চেয়েও অনেক সেলিব্রেটির সঙ্গে তার ছবি রয়েছে। আসলে এদের সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে।