ইউক্রেনে মুহুর্মুহু রুশ হামলা ॥ উচ্চ প্রযুক্তির নির্ভুল অস্ত্র ব্যবহার, বিমানবন্দর দখল

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে সামরিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো। বৃহস্পতিবার তিন দিক থেকে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছে রাশিয়া। রাজধানী কিয়েভসহ ইউক্রেনের প্রধান প্রধান শহরে মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করছে রুশ জঙ্গিবিমান। হামলার পরপরই ইউক্রেনের সামরিক বিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। ইউক্রেনের শহরগুলোর আকাশ অক্টোপাসের মতো ঘিরে ফেলে রুশ বিমান সেনারা। হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিক দিগি¦বিদিক ছোটাছুটি করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় এই যুদ্ধে উভয় পক্ষে বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। অন্তত ৫০ রুশ সৈন্য হত্যার দাবি করেছে ইউক্রেন। অপরদিকে মস্কো বলেছে, বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা ৫৫ মিনিট থেকে চালানো এই হামলায় অন্তত ৪০ ইউক্রেন সৈন্য নিহত হয়েছে। ইউক্রেনের কয়েকটি শহরও দখলের দাবি করেছে ক্রেমলিন।
ইউক্রেনের সামরিক অবকাঠামো, বিমান প্রতিরক্ষা ও বিমানবাহিনীকে নিশানা করে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। হামলায় উচ্চ প্রযুক্তির নির্ভুল অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে।
হামলা করে ইউক্রেনের একটি বিমানবন্দর দখল করে নিয়েছে রুশ বাহিনী। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষও এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। এমআই-৮ এ্যাসাল্ট কপ্টার দিয়ে রুশ বাহিনী হোস্টমেলের আন্তেনোভ বিমানবন্দরে বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে। ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাশিয়া বিমানবন্দরটি দখল করে নিয়েছে।
হামলার খবরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, রাশিয়াকে এই হটকারিতার জবাব দিতে হবে। পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বন্ধের শেষ চেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ভøাদিমির পুতিনকে বলেন, ‘মানবতার দোহাই’ যুদ্ধ বন্ধ করুন। রুশ বাহিনীর হাত থেকে দেশকে রক্ষায় প্রস্তুত নাগরিকদের যুদ্ধে নামার আহ্বান জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, যারা অস্ত্র চাইবে তাদের অস্ত্র দেয়া হবে।
খবরে বলা হয়েছে, কিয়েভে হামলার পর বহু মানুষ মেট্রো স্টেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। মাথার ওপর দিয়ে বিপুল গর্জন করে হুশ হুশ করে উড়ছে রুশ বিমান। শহরজুড়ে আপৎকালীন সাইরেন বাজানো হয়। রাস্তায় সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়ি। বৃহস্পতিবার ভোরের আলো ফুটতেই যেন আমূল বদলে যায় কিয়েভের ছবি। ইউক্রেনের সংসদ সদস্য সোফিয়া ফেডিনা বলেন, রুশ হামলা থেকে নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখতে তাদের বাঙ্কারগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য ওই বাঙ্কারগুলোতে নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু সরকারের সেই আশ্বাসে যেন ভরসা রাখতে পারছেন না বাসিন্দারা। ফলে বহু মানুষ বহু মেট্রো স্টেশনগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ফলে ক্রমে মেট্রো স্টেশনগুলো ভরে উঠছে। ইউক্রেনের মেট্রো স্টেশনগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বোমাবর্ষণেও রক্ষা পায়। তাই যাদের শহর ছাড়ার উপায় নেই তারা মেট্রো স্টেশনগুলোকেই নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। ইউক্রেনের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টন জেরাশেঙ্কো বলেছেন, কিয়েভ, খারকভ এবং নিপারের কাছে সামরিক সদর দফতর, বিমানবন্দর, সামরিক অস্ত্রাগারে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। কিয়েভেও কয়েকদফা বিস্ফোরণ হয়েছে।
ইউক্রেনে হামলার নির্দেশ দিয়ে এক টিভি ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনীয় সেনাদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানান। পুতিন বলেন, ইউক্রেনে আমি সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যে কেউ এতে হস্তক্ষেপ করলে তার কড়া জবাব দেয়া হবে। এর আগে ক্রেমলিন থেকে বলা হয়, পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহী নেতারা কিয়েভের বিরুদ্ধে মস্কোর প্রতি সামরিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরপরই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ানদের প্রতি এক আবেগঘন আবেদনে ইউরোপে বড় যুদ্ধ সমর্থন না করার আহ্বান জানান। জেলেনস্কি বলেন, তিনি পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নীরবতা ছাড়া কোন জবাব পাননি। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে ইউক্রেন সীমান্তে মস্কোর দু’লাখ সৈন্য রয়েছে।
অন্যদিকে পুতিনের ঘোষাণার আগে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক এই দুই অঞ্চলের দুই নেতার মস্কোর উদ্দেশ্যে লেখা পৃথক দুটি চিঠি প্রকাশ করা হয়। উভয় নেতাই চিঠিতে ইউক্রেনের আগ্রাসন মোকাবেলায় তাদের সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে পুতিন ইউক্রেনের এ দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেন।
দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দিয়ে মঙ্গলবার ভাষণে ভøাদিমির পুতিন বলেন, মস্কো পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। পুতিন ইউক্রেন সম্পর্কে বলেন, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি। একটি পুতুল সরকার ইউক্রেন চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন কোন দিনই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না এবং আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। পুতিনের এ বক্তব্যের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, আমরা শান্তি এবং কূটনৈতিক পথের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এই পথ অনুসরণ করব এবং কেবল এটিই করব। আমরা নিজেদের ভূমিতে আছি। আমরা কোন কিছু এবং কাউকে ভয় পাই না। আমরা কাউকে পরোয়া করি না, কাউকে দেশ দখল করতে দেব না। তিনি আরও বলেন, আমাদের অংশীদারদের কাছ থেকে পরিষ্কার এবং ফলপ্রসূ পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। কারা আমাদের প্রকৃত বন্ধু এবং অংশীদার, সেটি দেখাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়ার রুশ সিন্ধান্তের পর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস ও ইউরোপিয়ান ফরেন পলিসি প্রধান জোসেপ বোরেল একমত হয়েছেন, ব্রিটেন এবং ইইউ পুতিনের শাসনকালের ওপর দ্রুত নিষেধাজ্ঞা দেবে এবং ইউক্রেনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে।
মস্কোকে বেজিংয়ের সমর্থন : চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কয়েকদিন আগেই বেজিংয়ে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে নিজেদের সম্পর্ক ঝালাই করে নিয়েছে দুই দেশ। সে সময় ‘অভিন্ন শত্রু’ যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলায় ‘বন্ধুত্ব ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের পথ’ সুগম করারও ঘোষণা দিয়েছিল দুই দেশ।
এবার ইউক্রেন ইস্যুতেও ‘বন্ধু’ রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে চীন। বৃহস্পতিবার চীন ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। উল্টো যুক্তরাষ্ট্রকেই উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালার জন্য দুষছে চীন। এছাড়া দুপক্ষকেই ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছে এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দেশটি। খবর সিএনএন অনলাইনের।
বৃহস্পতিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৯০ মিনিটের বেশি সময় ধরে চলা একটি ব্রিফিংয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী হুয়া চুনয়িং ইউক্রেনে রাশিয়ার পদক্ষেপের বিষয়ে ১১টিরও বেশি প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। বেজিং রাশিয়ার কর্মকান্ডকে আক্রমণ বলে মনে করবে কিনা এবং তারা ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখন্ডতা লঙ্ঘন করেছে কিনা সে বিষয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করা হলেও কোন উত্তর আসেনি। বরং তিনি বারবার বলেছেন, চীন ‘গভীরভাবে সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ’ করছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এড়াতে দুপক্ষকেই ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছে বেজিং।
এদিকে যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। লাগাতার ধস শেয়ার বাজারে। একের পর এক সংস্থার শেয়ারের দাম পড়তে শুরু করেছে। সকালে বাজার খোলার পরেই এক ধাক্কায় ১৬০০ পয়েন্ট পড়েছিল সেনসেক্স। তার পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। একের পর এক বোমা বর্ষণ শুরু হয় ইউক্রেনের উপরে। ইউক্রেনের সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে রুশ সেনা। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম হু হু করে বেড়ে গিয়েছে। প্রবল অস্থিরতা তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে।-খবর ওয়েবসাইটের।
শেয়ার বাজারেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সকাল থেকে পতনের পর দিনের শেষে ৪.৭ শতাংশ পড়েছে শেয়ার বাজার। প্রভাব পড়েছে নিফটিতেও। ৮১৫ পয়েন্ট পড়েছে নিফটি। ৩০টি সংস্থার শেয়ারের দাম লাল দাগের নীচে নেমে গিয়েছে। এদিকে আবার রাশিয়ার সব ব্যাঙ্কের কাজ থামিয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি। কাজেই সেই দিক থেকেও আর্থিক ধাক্কা আসতে শুরু করেছে।
স্থল ও বিমানবাহিনী মোতায়েনের ঘোষণা ন্যাটোর : রুশ আক্রমণের মধ্যে পূর্ব ইউরোপে স্থল এবং বিমানবাহিনী বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ন্যাটো। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে পশ্চিমা এ সামরিক জোট জানায়, রাশিয়ার কর্মকাণ্ড ইউরো-আটলান্টিক নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মিত্রদেশগুলোর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য ন্যাটো প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ন্যাটো অতিরিক্ত স্থল এবং বিমানবাহিনী মোতায়েনের পাশাপাশি নৌবাহিনীও মোতায়েন করতে যাচ্ছে। সশস্ত্রবাহিনীর তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।
লিথুয়ানিয়ায় জরুরী অবস্থা : ইউক্রেনে রুশ হামলার পর লিথুয়ানিয়ার জরুরী অবস্থা জারি করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট গীতানাস নাওসেদা। বৃহস্পতিবার এ পদক্ষেপ নেয় রাশিয়ার অন্যতম মিত্র বেলারুশ সীমান্তের এই দেশ।
ইউক্রেন হামলায় অংশ নেবে বেলারুশ : প্রয়োজনে ইউক্রেনে রুশ হামলায় বেলারুশের সেনারাও অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। তবে এখন পর্যন্ত দেশটির সেনারা ইউক্রেন অভিযানে নামেননি বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার বেলারুশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার খবরে এ কথা বলা হয়।