কাজিরবাজার ডেস্ক :
বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল অভিন্ন অনেক বিষয়। তাই ভাষার মাসজুড়ে ঘটেছিল নানামুখী ঘটনাপ্রবাহ। বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে শুধু ছাত্র আন্দোলনকেই দমাতে চায়নি শাসকগোষ্ঠী, সেই সঙ্গে কণ্ঠরোধ করতে নিয়েছিল নানা অনাকাক্সিক্ষত পদক্ষেপ। সেই সূত্রে সংবাদপত্রের ওপরেও নেমে এসেছিল দমননীতি। সেই চক্রান্তমূলক রাজনীতির শিকার হয়েছিল পূর্ববঙ্গের একমাত্র ইংরেজী ভাষার দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজারভার’। এই পত্রিকাটির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পৌঁছে যেত ইংরেজী জানা মানুষের কাছে। এমনকি, গ্রহণ না করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকশ্রেণীর কাছে চলে যেত প্রকৃত খবর। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল নুরুল আমীন সরকার। সেই দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতে নিষিদ্ধ করা হয় পাকিস্তান অবজারভারকে। এই ঘটনা প্রকাশিত হয় মুসলিম লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট চরিত্রে। অন্যদিকে, পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয় বাঙালির বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগে থাকা ‘মর্নিং নিউজ’ নামের নবাববাড়ির মালিকানাধীন ইংরেজী দৈনিককে।
জননিরাপত্তা আইনের সুযোগ নিয়ে ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তান অবজারভারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নুরুল আমীন সরকার। ১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এই ঘোষণা দেয়া হয়। পত্রিকা নিষিদ্ধের পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় পত্রিকাটির মালিক সাবেক মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী এবং সম্পাদক আবদুস সালামকে। যদিও এই দুজনকে শেষ পর্যন্ত জামিন দেয়া হয়। আর অবজারভারের ওপর আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞায় চরমভাবে খুশি হয় মর্নিং নিউজ কর্তৃপক্ষ। সে কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি মর্নিং নিউজের সম্পাদকীয়তে অবজারভারকে নিষিদ্ধ করার জন্য অভিনন্দন জানানো হয় সরকারকে। শুধু কি তাই? ওই সম্পাদকীয়তে অপসাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে নির্লজ্জভাবে অবজারভারকে ভারতপন্থী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এদিকে, অবজারভারকে নিষিদ্ধ করার প্রেক্ষাপটে পত্রিকাটির পাশে দাঁড়ায় ‘ইত্তেফাক’, ‘ইনসাফ’ ও ‘নববেলাল’ নামের অন্য পত্রিকাগুলো। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তারা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আহ্বান জানায়।
এর আগে ১৯৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অবজারভারে মুসলিম লীগ শাসনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সম্বন্ধে একটি সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘ক্রিপটো ফ্যাসিজম’ (ছদ্ম ফ্যাসিজম) শিরোনামে। এতে পাকিনস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। এদিকে ছাত্ররা ঠিকই বুঝে ছিল যে, ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচী ব্যাহত করার উদ্দেশ্যেই আন্দোলনের সমর্থক পত্রিকাটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেছে নুরুল আমীন প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার এক ছাত্রসভায় সরকারের স্বৈরাচারী পদক্ষেপের প্রতি নিন্দা জানিয়ে অবজারভারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা বাতিলের দাবি তোলা হয়। এ ছাড়া এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা আলাদাভাবে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলের কমনরুমে ছোটখাটো একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে এবং অবজারভারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানায়। শুধু ছাত্রসমাজই নয়, যুবলীগও সরকারের ওই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। তাদেরও ছিল একই ভাবনা- সরকার ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন হ্রাস করতে পাকিস্তান অবজারভারের প্রকাশনা বন্ধ করেছে। তাই তাদেরও দাবি, অবিলম্বে বিনা শর্তে যেন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।