কাজিরবাজার ডেস্ক :
নির্বাচন কমিশনের জন্য সুপারিশ চূড়ান্তের দ্বারপ্রান্তে সার্চ কমিটি। আজ শনিবার বেলা ১১টায় আবারও বৈঠকে বসছে এ কমিটি। সুপ্রীমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে আজকের বৈঠকে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য ১০ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হতে পারে। আর সার্চ কমিটির কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পর সেখান থেকে ১ জনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও ৪ জনকে কমিশনার নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
এর আগে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করলেও নির্বাচন কমিশনের জন্য ১০ জনের নামের তালিকা চূড়ান্ত করেনি সার্চ কমিটি। একটি শর্ট লিস্ট করে রাখলেও সমালোচনা এড়ানোর কৌশল হিসেবে অধিকতর যাচাইবাছাই করার জন্য তারা ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করে। তবে আজকের বৈঠকে তালিকা চূড়ান্ত করা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
পর্যালোচনা করে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য ২৬ রাজনৈতিক দল, ৬ পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তাব করা ৩২২ নামের মধ্য থেকে ১০ জনের তালিকা ঠিক করতে কয়েক দফা বৈঠক করেছে সার্চ কমিটি। সুপ্রীমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে সার্চ কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয় বুধবার। প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে আরও যাচাইবাছাই করে অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন ১০ নামের তালিকা ঠিক করতে আজ শনিবার আবারও বৈঠক করবে সার্চ কমিটি।
সার্চ কমিটির সভাপতি আপীল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সভাপতিত্বে আগের সবগুলো বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারী কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক। বৈঠকে সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে তিনদিনে চার দফা বৈঠকে ১০ নাম চূড়ান্ত করার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব এসেছে সার্চ কমিটির পর্যালোচনা বৈঠকে সেগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে শেষ মুহূর্তের যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অধিকতর বিশ্লেষণ শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম পাঠাবে সার্চ কমিটি। এরপর রাষ্ট্রপতি এখান থেকে ১ জনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও ৪ জনকে কমিশনার নিয়োগ দেবেন।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সুপ্রীমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে ১২ ফেব্রুয়ারি ২ দফা ও ১৩ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় দফা এবং মঙ্গলবার চতুর্থ দফা বিশিষ্টজনদের বৈঠক করে মতামত নেয় সার্চ কমিটি। ৩ দফা বৈঠকে বিশিষ্টজনদের দেয়া প্রস্তাব অনুসারে নির্বাচন কশিনের জন্য ২৬ রাজনৈতিক দল, ৬ পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তাব করা ৩২২ জনের নামের তালিকা ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করে সার্চ কমিটি। এতে অবসরপ্রাপ্ত প্রায় ১০০ জন সাবেক আমলা ছাড়াও বিচারবিভাগ, শিক্ষাবিদ, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম স্থান পায়। ১৬ ফেব্রুয়ারি সার্চ কমিটি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে শেষ বৈঠক করে। এর পর প্রায় নিজেরা ২ ঘণ্টা বৈঠক করে নাম চূড়ান্ত করার বিষয়ে পর্যালোচনা করে। তবে অধিকতর পর্যালোচনার জন্য আরও সময় নেয় এ কমিটি।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলকে নাম জমা দেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল সার্চ কমিটি। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায় থেকেও ই-মেইলে নাম পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়। এরই মধ্যে প্রথমে আওয়ামী লীগসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল ও ৬টি পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে আরও অনেকে নাম প্রস্তাব করে। ১৫টি রাজনৈতিক দল নাম প্রস্তাব না করায় পরে আরও ২ দিন সময় বাড়ানো হয়। এর পর ওই ১৫টি দল থেকে ২টি দল নাম জমা দিলেও বিএনপিসহ ১৩টি দল দেয়নি।
সার্চ কমিটিকে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য ১০ জনের নামের তালিকা সুপারিশ করতে ১৫ কার্যদিবস সময় দেয়া হয়। তবে সার্চ কমিটি ইচ্ছে করলে এর আগে যে কোন সময় রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশ করতে পারে। ইচ্ছে করলে আজকের মধ্যেই তারা রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশ করতে পারে। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই এখন আর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে কোন তাড়া নেই। কারণ নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগে কিছুদিন দেরি হলেও এতে আইনগত কোন সমস্যা নেই।
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য নাম সুপারিশ করতে ৫ ফেব্রুয়ারি সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ অনুসারে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আপীল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে সভাপতি করে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে গেজেট প্রকাশ করে। সার্চ কমিটির অন্য ৫ সদস্য হলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারী কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন এবং কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক। সার্চ কমিটির কর্ম সম্পাদনে সাচিবিক সহায়তার দায়িত্ব দেয়া হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে। আইন অনুযায়ী এ কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ১০ ব্যক্তির নাম সুপারিশ করতে বলা হয়। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত ১০ জনের তালিকা থেকে ১ জনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ৪ জনকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিতে না পারায় কোন সমস্যা নেই। যেদিন থেকে নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেবে সেদিন থেকে তাদের কার্যকাল শুরু হবে। আর নতুন ইসি দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত কমিশন সচিবের নেতৃত্বে স্থায়ী কর্মচারীরা রুটিন কাজ চালিয়ে যাবেন। তবে তারা কোন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।
দেশে এ পর্যন্ত সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে দুইবার নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। ২০১২ সালে জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে সার্চ কমিটির মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৭ সালে বর্তমান নির্বাচন কমিশনও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। ওই সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুসারে ২০১৭ সালে ৫ বছরের জন্য গঠন করা হয়েছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশন। ওই নির্বাচন কমিশন ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তারা বিদায় নিয়েছেন।
১৭ জানুয়ারি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ এর খসড়া মন্ত্রী সভায় উত্থাপন ও অনুমোদন করা হয়। এ আইন পাসের উদ্দেশে ২৩ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ উত্থাপন করেন। ওইদিনই বিলটি যাচাই বাছাই করে রিপোর্ট পেশ করার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রেরণ করেন স্পীকার। এর পর ওই কমিটি বিলটি রিপোর্ট আকারে সংসদে উপস্থাপনের পর এর ওপর ১২ জন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য ছাঁটাই ও সংশোধী প্রস্তাব দেন। এর পর কিছু সংশোধনীসহ ২৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। বিলের শিরোনামেও সামান্য সংশোধন হয়। সংশোধনীসহ বিলটি পাস হয় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনরার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ শিরোনামে। ২৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি এ বিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে এটি আইনে পরিণত হয়। ওইদিনই জাতীয় সংসদ থেকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ এর গেজেট প্রকাশ করা হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সংবিধান নির্দেশিতভাবে এবারই প্রথম জাতীয় সংসদে আইন পাস করে সে আইনের আলোকে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়।
নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার কারা হতে পারবেন এবং তাদের যোগ্যতা কি হবে সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে। কোন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী, আধা-সরকারী,স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারী বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে যদি কেউ অপ্রকৃতস্থ হিসেবে ঘোষিত হন, দেউলিয়া ঘোষণার পর দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্ত না হন, অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, নৈতিক স্খলন এবং সেক্ষেত্রে যদি ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদ-ে দ-িত হন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) এ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২ এর অধীনে কোন অপরাধের জন্য দ-িত হন এবং আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে কেউ অধিষ্ঠিত থাকলে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না।